উপন্যাসঃ বহ্নিমান // দিব্যেন্দু দ্বীপ

follow-upnews
0 0

ছেলে মেয়ে দূরে থাকায় মর্জিনার মধ্যে বর্তমানে ভয়ঙ্কর একাকীত্ব তৈরি হয়েছে। কোরআন শরীফ পড়ে, টিভিতে ইসলামীক ভাষণ শুনে দু’এক ঘণ্টা কাটলেও বাকী সময় সে যেন সারাক্ষণ অজানা কোনো ক্ষুধায় জ্বলছে। ও ঠিক ধরতে পারে না, ধরতে পারলেও ধরতে চায় না।

নিজের নগ্ন শরীর দেখবেনা বলে বাথরুমের আয়না সরিয়ে ফেলেছে। ভয়ে ভয়ে ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বোরকাটা পরে নেয়, খুব সতর্কভাবে নিজেকে এড়িয়ে। আজকে এই প্রথম সে পাগলের মতো শরীরের সব কাপড় খুলে ফেলেছে। এরপর গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছে। ভূত দেখার মতো মর্জিনা আজকে নিজেকে দেখছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির শরীরটা কিছুতেই আজ সে দেখে শেষ করতে পারছে না।

একটা রহস্যের মর্জিনা কোনোদিনও কূলকিনারা করতে পারেনি— এতটা ইসলাম সম্মতভাবে সে বোরকা পরে, একেবারে ঢিলেঢালা বোরকা, তবু কেন বাইরে গেলে পুরুষগুলো এমন হা করে তার দিকে তাকায়। মর্জিনা এটা জানে না যে, পাহাড় তবু লুকানো যায়, কিন্তু পুরুষের চোখ হতে নারীর শরীর লুকানো যায় না। ও আজকে প্রথম এভাবে নিজেকে দেখে অনেক কৌতুহল অনুভব করলেও ইসলামের কথা ভেবে আচমকাই আবার নিজেকে গুটিয়ে নেয়। নিজেকে অপরাধী ভেবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। ঝটপট কাপড় পরে মূর্ছা যাওয়ার মতো ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ ছোটাছুটি করে, এরপর ইউটিউব থেকে মিজানুর রহমান আজাহারীর ওয়াজ বের করে শুনতে থাকে।

কিছুতেই আজকে ওয়াজে মন বসছে না, বারে বারে চোখ চলে যাচ্ছে আজাহারীর শরীরের দিকে। সে বুঝতে পারছে তার শরীর আজকে পুরুষ খুঁজছে, এতদিন পাত্তা না দিলেও আজকে সে বেসামাল হয়ে পড়েছে। স্বামী মাঝে মাঝে তাকে আরো তাতিয়ে দেয়। ধর্মের নামে সব মেনে নিয়েছে সবসময়, কিন্তু আজকে কোথা থেকে কী হলো মর্জিনা কিছুই বুঝতে পারছে না। সে নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছে না। প্রায় ঘণ্টা দুই কেটে গিয়েছে, কিন্তু এখনো সে একই ঘোরের মধ্যে আছে। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রাস্তাঘাটে তার দিকে ধেয়ে আসা হাজার হাজার ‍পুরুষের চোখ। সে ভাবছে, সে দেখছে, কিন্তু কিছুতেই মানতে পারছে না।

অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়েছে। শশুর বাড়িতে খুব কঠিন ধর্মীয় পরিবেশ, নিজেকে নারী হিসেবে সে প্রকৃতিগতভাবে কিছুই চেনেনি, আধুনিকতা বা কোনো বই পড়ে বা টিভি দেখে কিছুই না, ইসলাম নারীর যে মূর্তি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, নিজের কাছে ওটাই সে। আজকে হঠাৎ তার ব্যত্যয় ঘটছে, নিজের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসছে যেন এক ‘মানব’ মূর্তি। মর্জিনা বিষয়টাকে শয়তানের আছর ভাবছে। একবার সে ভেবেছে বিষয়টা স্বামীকে জানাবে, পরক্ষণেই ছোটবেলায় দেখা এক নারীর কথা মনে পড়ে যায়— যার ওপর থেকে শয়তানের আছর সরাতে হুজুর তাকে  ইচ্ছেমতো পিটিয়েছিলো। এটা ভেবে স্বামীকে আর কিছু বলে না। কিন্তু কিছুতেই এই ভাবনার মধ্যে সে আর থাকতে চায় না। বোরকাটা পরে নেয়, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে থাকে— এভাবে বোরকা পরার পরও পুরুষেরা কেন  যে তাকে গিলে খায়!

মর্জিনা একটা ওষুধের দোকানে যায়, খেয়াল করে দেখে ঠিকই আশেপাশের সবাই তাকে দেখছে। আগেও দেখতো, তবে এভাবে সে নিজেকে পূর্বে কখনো আবিষ্কার করেনি বলে বিষয়টা তার কাছে নতুন মনে হচ্ছে। দু’টো ঘুমের ওষুধ কিনে নিয়ে চলে আসে। এসে বোরকা পরা অবস্থায় আয়নায় আবার নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে। বুকটা পেটের তুলনায় অনেক উচু দেখায়, পিছন থেকে দেখলে মনে হয় কোমর থেকে নিতম্ব যেন খুলে পড়ছে। মনে পড়ে— পাশের বাসার ভাবী একদিন বলেছিলো একদিন একজন পুরুষ নাকি তার পিছন পিছন হেঁটেছে। মর্জিনা বুঝতে না পারলেও ঐ ভাবী বুঝতে পেরেছিলো। ও বলেছিলো, “আমার পিছনে কেন, আপনার পিছনেও তো হাঁটতে পারে।” ভাবী শুধু একটা মুচকি হাসি দিয়েছিলো, সেই হাসির মানে সেদিন বুঝতে না পারলেও আজকে বোঝার চেষ্টা করছে।  কিছুতেই এসব ভাবনা আর সে মানতে পারছে না। শয়তানের আছর কাটাতে নিজেই সে ব্যবস্থা নেয়— একসঙ্গে দু’টো ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে।

রাতে মর্জিনার স্বামী বাসায় এসে অনেকবার কলিংবেল বাজায়, ডাকাডাকি করে, কিন্তু মর্জিনা কিছুই শুনতে পায় না। অবশেষে লোক নিয়ে এসে দরজার লক ভেঙ্গে ঘরে ঢোকে রকিবুল ইসলাম। ঢুকে অনেক ঠেলাঠেলি করে মর্জিনাকে ডেকে তোলে। মর্জিনা ঘুম ঘুম চোখে অপরাধীর মতো স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে। রকিবুল ইসলাম কিছুই বুঝতে পারে না। মর্জিনা বারে বারে শুধু স্বামীর পা ধরে মাপ চাইতে থাকে। রকিবুল ইসলামের মেজাজ গরম হয়ে যায়, সে কিছু একটা সন্দেহ করতে শুরু করে। ঠাস ঠাস করে মর্জিনার গালে কয়েকটি চড় বসিয়ে দেয়। মর্জিনা ব্যথায় এবং ভয়ে কাঁপতে থাকে। আবারও সে বারে বারে স্বামীর পা ধরে মাপ চাইতে থাকে। রকিবুল ইসলাম টিভি রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ গুম মেরে বসে থাকে। মর্জিনা রান্নাঘরে গিয়ে রান্না চাপায়, তখনো তার শরীর কাঁপছে। হঠাৎ রকিবুল এসে তাকে টেনে হিঁচড়ে টিভি রুমে নিয়ে আসে। পাগলের মতো মর্জিনাকে উলঙ্গ করতে থাকে। মর্জিনার শরীরে তখন একটুও কাম-উদ্দীপনা নেই, শুধু ভয় আর ধর্মীয় বিধানমতে স্বামীর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। রকিবুল তখন অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসে— ঘর থেকে রটি বানানোর বেলনা নিয়ে এসে চিকন অংশটুকু মর্জিনার যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে দেয়। চিৎকার করে বলতে থাকে— “কার সাথে শুইছিস ক, না হলে এই বেলনাটা পুরো ঢুকিয়ে দেব।” মর্জিনা ব্যথায় কুকড়ে যায়। রকিবুল বেলনা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঢুকাতে থাকে, আর চিৎকার করতে থাকে।

এই ঘটনার পর থেকে মর্জিনা নিজেকে অপরাধী ভেবে আরো সংকুচিত হয়ে যায়। রকিবুল ইসলাম ‘জেনাকারী’ স্ত্রীকে একজন হুজুরের কাছে নিয়ে যায়। হুজুর দেখেশুনে বিধান দিতে চায়। হুজুর দেখে নিশ্চিত হতে চায় যে, মর্জিনা আসলে কী ধরনের জেনা করেছে। রকিবুল ইসলাম হুজুরের কাছে স্ত্রীকে সমর্পণ করতে রাজি হয়। কষ্ট লাগলেও সে জানতে চায়— আসলে তার স্ত্রী কী করেছে। হুজুর মর্জিনাকে তার বিশেষ রুমে নিয়ে যায়।

রকিবুল ইসলামকে হুজুর বলে, “আপনার স্ত্রী পর পুরুষের সাথে মিলনে অভ্যস্ত। তালাক দিতে না চাইলে এজন্য এক মাস প্রতিদিন তাকে বেত্রাঘাত করতে হবে। বেত্রাঘাত করাতে হবে কোনো আলেমকে দিয়ে। এরপর তাকে সারাজীবন কঠিন তওবা ও কান্নাকাটি করে যেতে হবে। তওবা ইস্তেগফার ও দোয়া বন্ধ করা যাবে না। মৃত্যু পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।” রকিবুল বলে, “আপনিই তো আলেম। বেত্রাঘাতের দায়িত্বটা আপনিই নিন।” হুজুর রাজি হয়, আগামীকাল থেকে বেত্রাঘাত শুরু হবে। রকিবুল ইসলাম মর্জিনাকে কড়া নির্দেশ দেয়— সে যেন নিজেই এসে হুজুরের কাছ থেকে বেত্রাঘাত নিয়ে যায়।

আজকে বেত্রাঘাতের প্রথম দিন। হুজুর বিশেষ রুমে নিয়ে মর্জিনাকে প্রথমে উলঙ্গ করে। এরপর বেত্রাঘাত করতে থাকে। মর্জিনা চিৎকার করতেও ভয় পায়। শুধু বলে, “হুজুর, এভাবে রোজ বেত্রাঘাত করলে তো আমি মারা যাব।” হুজুরের সম্বিত ফেরে। ভাবে— ত্রিশদিন ধরে একে পেতে হলে এভাবে মারা যাবে না। বেত্রাঘাতে মর্জিনার গোলাপী শরীরের লাল লাল দাগ হয়ে যায়। ব্যথায় অজ্ঞানের মতো বিছানায় পড়ে থাকে মর্জিনা। হুজুর মর্জিনার শরীরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মর্জিনা সীমাহীন ব্যথা এবং যন্ত্রণা সহ্য করতে থাকে।

রাতের বেলায় স্বামীর আরেক দফা অত্যাচার। রকিবুল ইসলাম প্রথমেই জানতে চায় হুজুরের সাথে মর্জিনা শুয়েছে কিনা। মর্জিনা ‘না’ বলে। মর্জিনা বলে, “হুজুর খুব ভালো মানুষ। ধর্মীয় বিধান মেনে শুধু বেত্রাঘাত করে ছেড়ে দিয়েছেন।” এক সপ্তাহের মধ্যে মর্জিনা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। ডাক্তার এসে আঙ্গুল দিয়ে দিয়ে শরীরের দাগগুলো পরীক্ষা করতে থাকে। ডাক্তার জানতে চায়— শরীরের আর কোথায় কোথায় এরকম জখম আছে। মর্জিনা বলে, সমস্ত শরীরে। ডাক্তার দেখতে চায়। অবরোধ-বাসিনী মর্জিনা ভাবে এটাই তো নিয়ম, ডাক্তারকে তো দেখাতেই হবে। ডাক্তার তার চেম্বারের দরজা লাগিয়ে মর্জিনাকে উলঙ্গ করে সমস্ত শরীরে হাত চালাতে থাকে। মর্জিনা যন্ত্রণা সহ্য করতে থাকে। এরপর ডাক্তারও তাকে ধর্ষণ করে। মর্জিনা অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে থাকে।

পনেরো দিন হাসপাতালে থাকার পরে মর্জিনা সুস্থ হয়। এরমধ্যে ডাক্তার মর্জিনাকে তিনবার ধর্ষণ করেছে। মাঝে মাঝে স্বামী এসে জানতে চেয়েছে— ডাক্তার মর্জিনার শরীরের দাগগুলো দেখেছে কিনা। মর্জিনা ‘না’ সূচক জবাব দিয়েছে। বাসায় আসার পর থেকে মর্জিনা আরো বেশি করে ধর্মের মধ্যে ডুবে গিয়েছে। সারাক্ষণ কোরআন শরীফ পড়ে, একা একা বিড়বিড় করতে থাকে। স্বামী বাসায় ফেরার সাথে সাথে পা ধরে মাপ চায়, কেন এরকম করে নিজেও জানে না। মর্জিনা কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গিয়েছে। রকিবুল সারাদিন দোকানদারি করে রাতে বাসায় ফেরে, সামনে রান্না খাবার আর স্ত্রীকে বিছানায় পেলেই তার চলে, এর চেয়ে খুব বেশি কিছু সে খেয়াল করে না।

মর্জিনা এখন শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও মানসিক ট্রমা থেকে কোনোভাবেই বের হতে পারছে না। স্বামীকে দেখলে সে ভয় পায়, অপরাধবোধে ভোগে। নিজেকে তার নষ্ট মনে হয়। সে আরো বেশি করে ধর্ম আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে। কোনোমতে ঘরের কাজটুকু শেষ করে বাকী সময় কোরআন খতম দেয়। ওদিকে মেয়ের বাচ্চা হবে, মেয়ে বলেছে তাকে কিছুদিন মেয়ের কাছে গিয়ে থাকতে। অন্তত হাসপাতালের কয়েকটা দিন। মর্জিনার স্বামীর সময় নেই, মর্জিনা একা যাওয়ার কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত রকিবুল তাকে ঢাকা যেতে বলে। পিরোজপুরের হুলারহাট ঘাট থেকে লঞ্চে তুলে দেয়। তবে কেবিনে পাঠাতে রাজি হয় না, রকিবুল চিন্তা করে— সবার মাঝে ডেকে গেলেই বরং নিরাপদ। মর্জিনা সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে পৌঁছালে জামাই এসে তাকে নিয়ে যায়। তিনদিন পরে মাত্র আঠারো বছর বয়সে ইয়াসমীনের দ্বিতীয় বাচ্চা হয়। মর্জিনা এরই মধ্যে দ্বিতীয়বার নানি হলো। সপ্তাহখানেক মেয়ের সেবাযত্ন করে আবার স্বামীর ঘরে ফিরতে চায়। জামাই সদরঘাট থেকে লঞ্চে উঠিয়ে দেয়। আজকে বৃহস্পতিবার হওয়ায় লঞ্চে অনেক ভিড়। মর্জিনা ডেকের কোণায় গিয়ে একটা পরিবারের পাশে একটু জায়গা করে নেয়। এ কয়দিন মেয়ে আর মেয়ের বাচ্চা সামলিয়ে ঠিকমতো ঘুম হয়নি। নিজের অজান্তেই লঞ্চের ডেকের এই ভিড়ের মধ্যে, হাঁকডাকের মধ্যে মর্জিনা ঘুমিয়ে পড়ে। গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে ব্যাগ থেকে ছোট কোরআন শরীফ বের করে পড়তে থাকে। আশেপাশে অনেকেই জেগে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফজরের আযান দিয়ে দেয়। মর্জিনা এত লোকের মধ্যে নামাজ পড়তে কুণ্ঠা বোধ করে। একটু বেরিয়ে গিয়ে নামাজ পড়ার জায়গা খুঁজতে থাকে। ওপরে গিয়ে ছাদের সাথে একটা জায়গা পায়। ঠিক নামাজ পড়ার জায়গা না হলেও এখানে নির্বিঘ্নে নামাজটা আদায় করে নেওয়া যেতে পারে। নিচে নেমে এসে জায়নামাজ নিয়ে আবার উপরে যায়।  

গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। নদী আজ খুব শান্ত, লঞ্চ চলার শব্দের সাথে ফজরের আযানের মধুর ধ্বনি ভেসে আসছে নদীর দুই পাড়ের কোনো মসজিদ থেকে। মর্জিনার চোখ বেয়ে পানি গড়াতে থাকে, সে আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে ক্ষমা চায়। মাত্র সে নামাজে দাঁড়িয়েছে, একটু নিচু হওয়া মাত্র টের পায় একটা শক্ত হাত পিছন থেকে তার মুখ চেপে ধরেছে। মর্জিনা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরেকটি হাত তার কোমর চেপে ধরে। ফিসফিস করে পিছন থেকে বলতে থাকে— বাধা দিলে ছুড়ে নদীতে ফেলে দেব। হ্যাঁচকা টানে মর্জিনাকে ঘুরিয়ে মুখোমুখি করে। ছোট্ট একটা ছুরি বের করে মর্জিনার বুকের উপর ধরে। মর্জিনা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। লোকটি সুঠাম, এবং হাত দু’টি তার লোহার মতো শক্ত। ছুরিটা ঘুরিয়ে খচ করে টান দিয়ে মর্জিনার বুক থেকে বোরকা কেটে নেয়। ব্রা বেরিয়ে পড়ে। মর্জিনার গোলাপি দুধ দু’টো তখন কম্পমান বুকে ছোট ছোট দোল দিচ্ছে। লোকটা ছুরিখানা মর্জিনার গলায় একবার বুলিয়ে নেয়। আবার হ্যাঁচকা টানে মুর্জিনাকে ঘুরিয়ে পিছনে ছুরি ঢুকিয়ে ব্রার ফিতে কেটে ফেলে। টপ করে ব্রা খুলে নিচে পড়ে যায়। মর্জিনার বড় বড় দুধ দু’টো তখন একেবারে অনাবৃত। মর্জিনা ধপাস করে পড়ে যায়। কিছুটা মুর্ছা যাওয়া মতো। লোকটি ছুরিখানা পাশে রেখে মর্জিনার বুকের উপর হামলে পড়ে। মর্জিনা ব্যথায় কাতরাতে থাকে, একবার চিৎকার করতে গিয়ে প্রাণের ভয়ে আবার থেমে যায়। বৃষ্টি হঠাৎ জোরে পড়ছে। চিৎকার করলেও এখন কেউ শুনবে না। লোকটি মর্জিনার মুখের কাপড় খুলতে যায়। মর্জিনা এবার প্রাণের ভয় ত্যাগ করে বলে, মুখের কাপড় খুলবি না, মরে গেলেও আমি তোকে মুখ দেখাবো না। লোকটি মুখের কাপড় বাদ দিয়ে শরীরের বাকী সব কাপড় খুলে নেয়। খোলা কাপড় চোপড় সহ মর্জিনাকে টেনে হিঁচড়ে স্টাফ কেবিনে ঢুকায়। এরপর প্রায় ত্রিশ মিনিট ধরে চলে অমানসিক নির্যাতন। মর্জিনাকে রুমের বাইরে বের করে দিয়ে লোকটা মুহূর্তে হারিয়ে যায়। মর্জিনা ফিতে কাটা ব্রাটা নদীতে ছুড়ে দিয়ে ছেড়া বোরকা এবং কামিজ কোনোমতে গায়ে জড়িয়ে নিচে নামে। ব্যাগ থেকে আলাদা বোরকা এবং জামা নিয়ে বাথরুমে গিয়ে পরে আসতে চায়। সমস্ত শরীর জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে শরীরটা পানি দিয়ে ধুতে, কিন্তু লঞ্চের বাথরুম খুব নোংড়া, কাপড় পরিবর্তন করে বেরিয়ে আসে। লঞ্চের পিছনের চরকায় সাদা ফেনা তুলে শো শো করে পানি বেরিয়ে যাচ্ছে, মর্জিনার হঠাৎ লাফিয়ে পড়ে আত্মহুতি দিতে চায়। এগিয়ে গিয়েও সে থেমে যায়। চোখের সামনে মাদ্রাসায় রেখে আসা ছেলেটার কথা মনে পড়ে। ইমরান খুব কান্নাকাটি করে, এত ছোট বয়সে কিছুতেই মাদ্রাসার হোস্টেলে সে থাকতে চায় না। মাত্র ছয় বছর বয়স, এই বয়সে দিন রাত কোরআন শরীফ পড়া নিছক নির্যাতন বৈ কিছু নয়। মর্জিনা ছেলেকে দেখতে গেলে ইমরান সবসময় খুব কান্নাকাটি করে। ছেলের জন্য মর্জিনার বুকটা ফেটে যায়, কিন্তু কিছুই করার নেই। এটাই ইসলামের বিধান, এই বিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছের কথা মর্জিনা ভাবতেও চায় না।

হুলারহাটে লঞ্চ থেকে নেমেই মর্জিনা স্বামীকে দেখতে পেয়ে দৌঁড়ে যায়। স্বামীকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। মর্জিনাকে কাঁদতে দেখলেই রকিবুল সন্দেহ করে। মর্জিনা যতই কাঁদছে রকিবুল ততই ভেতর থেকে তেতে উঠছে। মর্জিনাকে বুকের উপর থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে দুই হাতে দু’টো ব্যাগ নিয়ে হনহন করে হাঁটতে শুরু করে রকিবুল ইসলাম। মর্জিনার সাথে কোনো কথা বলে না। মর্জিনা দুনিয়ার সকল ভয়, লজ্জ্ব, ঘৃণা নিজের মাঝে জড়ো করে রকিবুলকে অনুসরণ করতে থাকে। রকিবুল বাসা পর্যন্ত একটা অটো রিজার্ভ করে।

বাসায় পৌঁছেও রকিবুল মর্জিনার সাথে কোনো কথা বলে না। মর্জিনা স্বামীর পায়ে ধরে বারে বারে মাপ চাইতে থাকে। স্বামীকে ঘটনাটা না বলা পর্যন্ত মর্জিনা মানতে পারছে না। রকিবুল গুম মেরে সোফায় বসে থাকে, কোনো কথা বলে না। মর্জিনা ক্লান্ত বিধ্বস্ত, তবু সে স্বামীকে ঘটনাটা বলতে চায়, ইসলামে কী বিধান আছে জানতে চায়। সে স্বামীকে ঘটনাটা বলতে শুরু করে। রকিবুল পুরো ঘটনা শোনার আগেই তেড়েফুড়ে ওঠে, যেন এখনই মর্জিনাকে সে খুন করে ফেলবে। হঠাৎ করে ফুলের ঝাড়ু হাতে মর্জিনাকে পেটাতে শুরু করে। পেটাতে পেটাতে মর্জিনাকে প্রায় অজ্ঞান করে ফেলে। এরপর দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।

মর্জিনা উঠে দাঁড়াতে গেলেই ঘুরে পড়ে যাচ্ছে। টলতে টলতে রান্নাঘরে গিয়ে সে বটিটা হাতে নেয়। নিজের এ জীবন সে আর রাখতে চায় না। বটিটা হাতে নিয়ে কালির মতো মূর্তি ধারণ করে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। শরীর থেকে টান দিয়ে সব পোশাক খুলে ফেলে। সমস্ত শরীরে দড়া দড়া দাগ। দুধ দু’টোতে বড় বড় কামড়ের দাগ। মর্জিনা এক পলক দেখেই শরীরের দিকে আর তাকাতে পারছে না। নিজের শরীরটাকে তার ঘৃণা হচ্ছে, খুব ঘৃণা হচ্ছে। বটিটা গলায় চালিয়ে দিতে চায়। পারে না, শেষ পর্যন্ত সে নিজেকে খুন করতে পারে না।

রকিবুল ইসলাম অন্যদিনের চেয়ে আজকে কিছুটা আগে বাসায় ফেরে। মর্জিনার সাথে কোনো কথা বলে না। মর্জিনার সমস্ত শরীর জুড়ে ব্যথা, মনে আতঙ্ক। বিছানা ছেড়ে ওঠার শক্তি নেই, তবু তাকে উঠতে হয়। স্বামীকে খাবার গুছিয়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে। রকিবুল একটা গালি দিয়ে খাবারের থালা নিয়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে। এরপর হন্তদন্ত হয়ে মর্জিনার রুমে ঢুকে মর্জিনাকে চুল ধরে টেনে তোলে। মর্জিনা ভয়ে কাঁপতে থাকে। রকিবুল কোনো কথা না বলে স্ত্রীর হাতে তালাকনামা ধরিয়ে দেয়। “কাল সকাল থেকে আর তোর মুখ দেখতে চাই না।” বলে রকিবুল ইসলাম ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। হঠাৎ করে মর্জিনার শরীর ও মনে বিশেষ এক ধরনের শক্তি ভর করে। হয়ত এ শক্তি মুক্তির, শৃঙ্খলমুক্তির। মর্জিনা তার ছোটভাইকে ফোন করে আগামী কাল সকালে নিয়ে যেতে বলে। ব্যাগ গুছিয়ে নিজের অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রগুলো প্রস্তুত করে রাখে। শরীরজুড়ে ব্যথা, রাতে ঘুম হয় না। অপেক্ষা করতে থাকে তার ভাই কখন আসবে। এখানে আর এক মুহূর্তও সে থাকতে চায় না।

ফজরের নামাজটা পড়ে নেয়। অভ্যাশবসত কোরআন শরীফ নিয়ে বসে, কিন্তু আজ আর একটা লাইনও সে উচ্চারণ করতে পারে না। কোরআন শরীফটা সযত্নে রেখে দিয়ে বাথরুমে ঢোকে। সময়টা এপ্রিলের মাঝামাঝি, বেশ গরম। এই ভোরবেলাতেও সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে। বাথরুমে ঢুকে উন্মাদের মতো শরীরের সব কাপড় খুলে ফেলে, আয়নায় বুক দেখতে থাকে। দুধ দুটোতে নরপশুর দাঁতের দাগ এখনো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মর্জিনা নিজের মাঝে কিছু একটা পরিবর্তন টের পাচ্ছে। নিজের জন্য খুব মায়া হয়, মায়া হয় উর্বর শরীরটার জন্য। খুব ইচ্ছে করছে ভালোবেসে কেউ কাছে আসুক, উদ্ধার করুক। কৈফিয়ত নয়, তবু জানতে চাক— কীভাবে এমন ক্ষত হলো বুকে। মর্জিনা কল্পনা করছে এমন কোনো পুরুষ, যার বুকে মাথা রেখে সে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকবে, যে তাকে বুঝবে। শরীরে পানি ঢালতেই থাকে, ঢালতেই থাকে, যেন পানি দিয়ে সে তার অতীত ধুয়ে ফেলতে চাইছে। শরীরে ছোপ ছোপ রক্ত জমে আছে, গামছা দিয়ে মুছতে পারছে না। চেপে চেপে শরীরের পানি মুছে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। বড় আয়নাতে শরীরটা পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। নিজেকে দেখে নিজেই চমকে ওঠে। এ যেন কোনো শিল্পীর আঁকা ভাস্কর্য। চিকন কোমর বেয়ে নেমে গেছে উত্থিত নিতম্ব, উরু তুলনামূলক একটু মোটা, মাঝখান দিয়ে যোনিরেখা একটুখানি উঁকি দিচ্ছে। গোলাপী শরীরে লাল ছোপ ছোপ দাগ স্বামীর বর্বরতার কথা জানান দিচ্ছে। শুধু স্বামী নয়, যে কোনো পুরুষ মানুষের কথা ভাবলেই ঘৃণায় গা গিনগিন করছে। আসলে সে এক ভীষণ বৈপরিত্যের মধ্যে পড়ে গিয়েছে। পুরুষ মাত্রেই তার কাছে এখন ঘৃণার বস্তু, আবার একইসাথে সে একজন পুরুষই খুঁজছে! তার শরীর খুঁজছে, তার মন খুঁজছে। এ বৈপরিত্য বোঝার মতো অতটা শিক্ষা তার নেই, শুধু ভেতরের আচমকা একটা পরিবর্তন সে টের পাচ্ছে।

বাবার বাড়িতে কয়েকদিন থেকে চিকিৎসা এবং বিশ্রাম নিয়ে মর্জিনা সুস্থ হয়। পিতা বেঁচে নেই, সব শুনে ভাইয়েরা তাকে তাদের সাথেই থাকতে বলে। মর্জিনা ছেলের কথা ভাবে। সে ভাইদের তার প্রাপ্য সম্পদ বুঝিয়ে দিতে বলে। রকিবুল ইসলাম দেনমোহরের দুই লক্ষ টাকা এখনো দেয়নি। মর্জিনা এক ঝটকায় শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। স্বামীকে ফোন করে সে কোনো কথা বলে না, শুধু দেনমোহরের টাকাটা চায়। রকিবুল ইসলাম দ্রুতই বিয়ে করতে চায়, এজন্য আর ঝামেলায় জড়াতে চায় না। মর্জিনাকে দেনমোহরের দুই লক্ষ টাকা দিয়ে দেয়। মর্জিনা টাকাটা হাতে পেয়ে পিরোজপুর শহরে একটি সাবলেট বাসা নিয়ে থাকতে শুরু করে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় একলা নারী বাসা করে থাকাটা কঠিন, সবাই উঁকিঝুকি এবং নানান ধরনের পরামর্শ দিতে শুরু করে। অযাচিতভাবে সহযোগিতা করতে চায়। তবু মর্জিনা আপাতত কোনো বিকল্প খুঁজে পায় না। ছেলেটাকে সে কাছে এনে রাখতে চায়। এখনই মাদ্রাসা থেকে নিয়ে আসবে কিনা ভাবছে। মাদ্রাসার হোস্টেলে ছেলেটা মোটেও ভালো থাকছে না। দেখতে গেলেই মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। তাও ভালো— সপ্তাহে একদিন ছেলেটাকে কাছে এনে রাখতে পারছে। দুই লক্ষা টাকার প্রায় এক লক্ষ টাকা নতুন করে বাসা গোছাতে খরচ হয়ে গেছে। বাকী এক লক্ষ টাকায় আর কত দিনই বা চলবে! মর্জিনা ভাইদের কাছে বারে বারে বলতে লজ্জ্বা পাচ্ছে, তবু না বলে উপায় নেই। চার ভাই তাকে একটা প্রস্তাব দেয়— জায়গা জমির ভাগ না দিয়ে মাসে মাসে মর্জিনাকে আট হাজার টাকা করে দিতে চায়। মর্জিনা রাজি হয়ে যায়। জায়গা নিয়ে সে কী করবে? তার চেয়ে এটাই ভালো হয়েছে। 

তিন চার মাস যাওয়ার পরে মর্জিনা নতুন জীবনে অনেকটাই মানিয়ে নিয়েছে। রকিবুল ইসলাম আবার বিয়ে করেছে। কিন্তু এ বিষয়ে মর্জিনার মোটেও কোনো আগ্রহ নেই। সম্প্রতি সে একটা স্কুলে চাকরি নিয়েছে। অফিস সহকারীর চাকরি। স্কুলের মালিক এবং শিক্ষক, সবাই নারী। এ কারণেই সে স্কুলটাতে চাকরি নিয়েছে। বেতন ছয় হাজার টাকা, সঙ্গে দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। মর্জিনা কথা বলে ছেলেটার জন্যেও খাওয়ার ব্যবস্থা করে। ইমরানকে মাদ্রাসা থেকে ছাড়িয়ে এনে নিজের স্কুলে ভর্তি করে। ইমরান খুশিতে আত্মহারা। এখন থেকে প্রতিদিন সে মায়ের সাথে থাকতে পারবে। এতটুকু ছেলেটাও নিজের মতো করে সব বুঝে নিয়েছে। বাবার কথা কিছু জিজ্ঞেস করে না। মর্জিনা একটা পাকা রুটিনের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহীত করছে। শুধু শুক্রবারটায় সে ছুটি পায়, এদিনে সে বাবার বাড়িতে বেড়িয়ে আসে। ভাই বউদের সাথে তার খুব ভালো সম্পর্ক। যেহেতু দুই পয়শা আয় করে, তাই ভাইপো-ভাস্তিদের জন্য ভালো ভালো খাবার দাবার কিনে নিয়ে যায়। ইমরানকেও মামা মামীরা খুব আদর করে। মর্জিনা এতদিনে বুঝতে পেরেছে যে, তার ধর্মচর্চার অনেকটাই ছিলো রকিবুল ইসলামের চাপিয়ে দেওয়া। তাইবলে ধর্মের প্রতি তার কোনো অনাস্থা নেই। ইসলামের বিধান মেনেই সে চলে,  এখনো সে নিয়মিত নামায পড়ে। কোরআন শরীফ বুঝে বুঝে পড়ার চেষ্টা করে। নিজের বেতনের টাকায় একটি স্মার্ট ফোন কিনেছে— এখন জগত সম্পর্কে অনেক কিছু সে জানতে পারে। ধর্মের ভালো মন্দও সে অনলাইন থেকে, বিশেষ করে ফেসবুক থেকে অনেক কিছু পড়ে। ধর্মের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে কোরআন বিরোধী কোনো কথা সে মানতে পারে না। তারপরও সে কথাগুলো মন দিয়ে শোনে। নিজে কোরআন পড়ে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করে। ভাবনা-চিন্তা করে।

শরীরটা মাঝে মাঝে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। খুব, খুব বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তবুও কোনো পুরুষের কথা সে ভাবতে পারে না। পুরুষ মানুষ মাত্রেই তার কাছে আতঙ্ক। ইমরান বড় হচ্ছে, ওর জন্য একটা আলাদা ঘর দরকার। মর্জিনা এক রুমের বাসা ছেড়ে দুই রুমের একটা বাসা নিতে চায়। পিরোজপুর শহরে এমনিতেই বাসা ভাড়া খুব কম, মর্জিনা থাকেও শহর থেকে একটু দূরে, এজন্য বাসা ভাড়া আরো কম। মাত্র তিন হাজার টাকার মধ্যেই দুই রুমের একটা ভালো বাসা সে পেয়ে যায়। ইমরান যেহেতু এক বছর প্রায় মাদ্রাসায় ছিলো, ফলে নিজের মতো করে গুছিয়ে থাকতে সে অভ্যস্ত। মর্জিনাও যেহেতু চাকরি করে, এজন্য খুব নিয়মের মধ্যে ইমরান বড় হচ্ছে। পড়াশুনায়ও সে ভালো। মর্জিনা ছেলেটাকে ঘিরে নতুন স্বপ্নে বুক বাধে। এছাড়া বেঁচে থাকার আর কোনো উছিলা তার আর নেই। 

কিছুদিন ধরে ও খুব অসুস্থ বোধ করে। একটুতেই হাঁপিয়ে ওঠে, বুকে ব্যথা করে। পিরোজপুর একজন মহিলা ডাক্তার দেখিয়েছে, কিন্তু কোনো ফল হয়নি। পুরুষ ডাক্তার সে কিছুতেই দেখাবে না। মরে গেলেও না। অবশেষে পাশের বাসার ভাবী খুলনায় একজন ভালো মহিলা ডাক্তারের সন্ধান দেয়। স্কুল থেকে একদিন ছুটি নিয়ে তাকেই দেখাতে চায়। ইমরানকে সাথে নিয়ে খুলনায় যায়। ডাক্তার দেখিয়ে টেস্টগুলো করতে দেয়। বিকাল পাঁচটায় টেস্ট-এর রিপোর্টগুলো দেবে। এতক্ষণ সে কোথায় কাটাবে? বোরকা খুলে তার পক্ষে কোনো রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়া সম্ভব নয়। ছেলের জন্য এক প্যাকেট বিরানি কিনে নেয়। এক বোতল পানি আর বিরানির প্যাকেটটা নিয়ে রয়েল হোটেলের পাশে জাতিসংঘ পার্কে বসে বিশ্রাম নেয়। ইমরান খেয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে বেঞ্চের উপরেই শুয়ে পড়ে। মর্জিনা উদাস দৃষ্টিতে পার্কের সবকিছু দেখতে থাকে। হঠাৎ বেঞ্চের নিচে একটা বইতে পা লাগে। সাথে সাথে বইটা উঠিয়ে সে মাথায় ঠেকায়। কৌতুহলবশত বইটার মলাটটা পড়ে দেখে— ‘অবরোধ-বাসিনী’। মর্জিনা বিশেষ কিছু বুঝতে পারে না। ইমরান ঘুমিয়ে পড়েছে। মর্জিনা সময় কাটানোর জন্য বইটা উল্টাতে থাকে। উল্টাতে উল্টাতে একটা জায়গায় গিয়ে সে পড়তে থাকে—

প্রায় ২১/২২ বৎসর পূর্বেকার ঘটনা। আমার দূর-সম্পর্কীয় এক মামীশাশুড়ি ভাগলপুল হইতে পাটনা যাইতেছিলেন; সঙ্গে মাত্র একজন পরিচালিকা ছিল। কিউল স্টেশনে ট্রেন বদল করিতে হয়। মামানী সাহেবা অপর ট্রেনে উঠিবার সময় তাঁহার প্রকাণ্ড বোরকায় জড়াইয়া ট্রেন ও প্লাটফরমের মাঝখানে পড়িয়া গেলেন। স্টেশনে সে সময় মামানীর চাকরাণী ছাড়া অপর কোন স্ত্রীলোক ছিল না। কুলিরা তাড়াতাড়ি তাঁহাকে ধরিয়া তুলিতে অগ্রসর হওয়ায় চাকরাণী দোহাই দিয়া নিষেধ করিল— “খবরদার! কেহ বিবি সাহেবার গায়ে হাত দিও না।” সে একা অনেক টানাটানি করিয়া কিছুতেই তাঁহাকে তুলিতে পারিল না। প্রায় আধ ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর ট্রেন ছাড়িয়া দিল। ট্রেনের সংঘর্ষে মামানী সাহেবা পিষিয়া ছিন্নভিন্ন হইয়া গেলেন,— কোথায় তাঁহার “বোরকা” — আর কোথায় তিনি! স্টেশন ভরা লোক সবিস্ময়ে দাঁড়াইয়া এই লোমহর্ষক ব্যাপার দেখিল, — কেহ তাহার সাহায্য করিতে অনুমতি পাইল না। পরে তাহার চূর্ণপ্রায় দেহ একটা গুদামে রাখা হইল; তাহার চাকরাণী প্রাণপণে বিনাইয়া কাঁদিল, আর তাহাকে বাতাস করিতে থাকিল। এই অবস্থায় ১১ (এগার) ঘণ্টা অতিবাহিত হইবার পর তিনি দেহত্যাগ করিলেন! কি ভীষণ মৃত্যু!

এই অংশটুকু পড়ার পরে মর্জিনা একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যায়। বইটি একজন নারীর লেখা, এজন্য সে আরো আকর্ষণ বোধ করে। আরো দু’এক পৃষ্ঠা পড়ে ফেলে। গুগল থেকে সার্চ দিয়ে বেগম রোকেয়ার ছবি দেখতে থাকে। অনেকগুলো একই রকমের ছবি— ঘোমটা দেওয়া বেগম রোকেয়া। মর্জিনার খুব ইচ্ছে করে নিজেকে ওভাবে ঘোমটা দিয়ে দেখতে। লেখার চেয়ে এই মুহূর্তে সে লেখিকাকে নিয়ে বেশি চিন্তা করতে থাকে।

বইটা ব্যাগে রেখে দেয়। টেস্ট-এর রিপোর্টগুলো নিয়ে আবার ডাক্তারের কাছে যায়। বুকে বিশেষ কোনো সমস্যা নেই, সম্ভবত হজমের সমস্যার কারণে গ্যাস থেকে বুকে ব্যথা হয়। ডাক্তার কিছু ওষুধ দিয়ে দেয়। মর্জিনা ওষুধগুলো কিনে নিয়ে সোনাডাঙ্গা থেকে পিরোজপুরের বাসে উঠে পড়ে। কোনোভাবেই বইটা থেকে তার মন সরছে না। ইচ্ছে করছে এখনই সে বইটা পড়ে ফেলে। কৌতুহল চাপা দিয়ে ছেলের সাথে গল্প করতে করতে ও বাসায় পৌঁছায়।

বাসায় ঢুকে আর দেরী করতে পারে না। শেষ চৈত্রের দাবদাহে বোরকার মধ্যে শরীরটা যেন সেদ্ধ হয়ে গিয়েছে। তড়িঘড়ি করে বাথরুমে ঢুকে যায়। এত বিরক্তির মধ্যেও ধীরে ধীরে বোরকাটা খুলে গুছিয়ে রাখে। বোরকা তার কাছে পরিবত্রার প্রতীক, বোরকা মানেও তার কাছে ইসলাম। ইসলামের অবমাননা সে কিছুতেই করবে না। খুব যে সচেতনভাবে করতে হচ্ছে, তা নয়, এটাই অভ্যাস। সেলোয়ার কামিজ খোলার সময় অতটা সতর্কতার প্রয়োজন হয় না। প্যাডের ফাঁক দিয়ে পিরিয়ডের রক্ত ঘেমে বের হয়ে সেলোয়ারে লেগেছে। এখন আর জামা কাপড়ে সাবান দেওয়ার শক্তি নেই। মগের পর মগ পানি ঢেলে সারা শরীর ভেজাতে থাকে। যেন ভিসুভিয়াসের আগুন জ্বলছে তার সমস্ত শরীরে।

ইমরান গোসল সেরে রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ পড়ার চেষ্টা করে, পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়ে। এটা ওটা নানান কিছু খেয়েছে, এজন্য মর্জিনা ইমরানকে আর খাওয়ার জন্য ডাকে না। ঘরে টিভি নেই, মর্জিনা টিভি দেখার আগ্রহও বোধ করে না। অবশ্য এখন আর সবকিছু সে হারাম হালাল দিয়ে বুঝতে চায় না। তবুও ইসলামই তার জীবনবিধান, ইসলামের বাইরে সে এক পাও চলতে চায় না।

কোনো কোনো নারী মাঝে মাঝে নিজের শরীরেরও প্রেমে পড়ে। মর্জিনারও তাই হয়েছে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখেই সে শেষ করতে পারছে না। নিজের দুধ হাতের তালুতে রেখে উচু করে দেখছে, ইচ্ছে করছে নিজেই একটু আদর করে দেবে। তালের মতো বড় বড় দু’টো দুধ, একটু আটোসাটো, বোটা দু’টো কালো আঙ্গুর ফলের মতো বড়। নাভীতে হাত বুলিয়ে পাউডার দিতে দিতে তলদেশের প্লাবন টের পাচ্ছে। স্বপ্নে দেখার মতো ভাবছে ভালো কোনো ডাকাত এসে লুটেপুটে নিয়ে যাক সব! নিয়ে যাক তো …!

—চলবে


লেখকঃ লন্ডন প্রবাসী সাহিত্যিক।

Next Post

খুলনায় প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল কাইয়ুম // রফিকুল ইসলাম রিপন

বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল কাইয়ুম ১৯৬২’র শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের আন্দোলন, ১৯৬৬’র ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন ও ১৯৬৯-এর ১১ দফা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।  শেখ আব্দুল কাইয়ুম ১৯৬৯-৭০ মেয়াদে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি ৯ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি খুলনা জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান ছিলেন। মার্চের […]
শেখ কামরুজ্জামান টুকু