ইমরানের কাছে বন্যা আহমেদ এর প্রশ্ন

রাজনীতির কোলে বসবাস যাদের তারা কেন নাচতে নেমে বারবার ঘোমটা দেবেন সেটা কিছুটা হলেও বুঝি। তাই ইমরান এইচ সরকার যখন দেশের এমন একটা সংকটপূর্ণ সময়ে জঙ্গি আর ‘উগ্র’ নাস্তিকদের একই জুম্মার কাতারে দাঁড় করিয়ে দিলেন তখন সেটাতে যতটা না অবাক হয়েছি তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলাম তার টাইমিংটা দেখে। সবাকের লেখাটা থেকে অনেক প্রশ্নের উত্তর পেলাম – তার সব বিশ্লেষণের সাথে একমত না হলেও বেশ ভাল একটা সারমর্ম পেয়েছি- আপাতত তাতেই সন্তুষ্ট আমি (যদিও যতদূর মনে পড়ে শাহবাগে সেদিন দাঁড়ানোর ডাক শুধু ইমরান দেননি, আরো অনেকেই নিজের জায়গা থেকে দিয়েছিলেন)।

আমেরিকা, রাশিয়া, সৌদি বাদশাহদারী থেকে শুরু করে দেশের ক্ষমতায় থাকা না-থাকা ধর্মবেচা-নেতা, পাতিনেতা, রাজনীতিবিদ, ছোট হুজুর, বড় মুফতি, সবারই অনেক লাভ হয় এই জঙ্গিবাদ বেচে খেয়ে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় স্কেলে ক্ষতি যদি কারো হয়ে থাকে সেটা হয় দেশের সাধারণ জনগণের- আর মুসলিমপ্রধান দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তো হচ্ছে সাধারণ মুসলমান জনগন। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাক- সবখানেই আজ ভুক্তভোগী প্রধানত এই মুসলমানেরাই। হিসেব করে দেখুন, দেশে প্রকাশ্যে নাস্তিক আর ক’জন? দুইচারটা চাপাতির কোপ দিয়েই এদেরকে ফুঁ করে দেওয়া যায়। আর মাইনরটিদের খেদাতে খেদাতে তো ১০% এর নিচে নিয়ে এসেছি আমরা। এই যে জঙ্গি আক্রমণ আর অভিযানে আজকাল কাড়ি কাড়ি মানুষ আহত নিহত গ্রেফতার হচ্ছে, তাদের ১০০ ভাগ না হলেও সিংহভাগই তো মুসলিম, তাই না?

একজন সচেতন নেতা হিসেবে আপনার তো সেটা বোঝানোর কথা ছিল দেশের সাধারণ মুসলমান জনগোষ্ঠীকে, সচেতনতা তৈরি করার কথা ছিল এর বিরুদ্ধে। যে-সময়ে বাংলাদেশ কেঁপে কেঁপে উঠছে জঙ্গিদের দৃঢ় অস্তিত্বের ঘোষণায়, তখন কিছু ‘তুচ্ছ’ ‘উগ্র নাস্তিক’দের হাস্যকরভাবে পাঞ্চিং ব্যাগ বানিয়ে এই বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? হেফাজতিদের সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা? সেটা তো আরও অনেকভাবেই করা যেতো, শফি হুজুর স্টাইলে ‘উগ্র’ নাস্তিকতাকে এজেন্ডা না-বানিয়েও তো সেটা করা যেতো। আপনি যে কারো দৃষ্টিভঙ্গির বা আদর্শের সমালোচনা করতে পারেন, এটার অধিকার পাওয়ার জন্যই তো সংগ্রাম ছিল আমাদের, তাই না? কিন্তু আপনি যখন এরকম একটা হাস্যকর (উদ্দ্যেশ্যপ্রণোদিত?) তুলনা করে বসেন তখন কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটাও বোধ হয় আপনার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ইমরান এর কাছে আমার ছোট্ট দুটি প্রশ্ন বা চাওয়া, আশা করি চিন্তাভাবনা করে উত্তর দেবেন। আমার এই প্রশ্ন শুধুমাত্র অভিজিতের স্ত্রী হিসেবে নয় নিজে একজন সমাজ এবং রাজনীতি সচেতন নাস্তিক হিসেবেও—

১. উগ্র নাস্তিকের সংজ্ঞা দিন প্লিজ। আপনি যাদের জন্য সৌধ বানানোর চেষ্টা করছেন তারা সবাই কিন্তু ধর্মগ্রন্থের তীব্র সমালোচনা করেছেন- আপনি মুক্তবুদ্ধির চর্চা নিয়ে যে বড় বড় বক্তৃতা দেন তারই অংশ এটা। ধর্মগ্রন্থগুলোর ভিতরে যে এই জঙ্গিবাদের বীজ খুঁজে পাওয়া সম্ভব সেটা যুগে যুগে আপনার এবং আমার প্রিয় অনেক বুদ্ধিজীবীই দেখিয়েছেন এবং আমার ধারণা সেটা আপনার অজানা নয়। (কিন্তু ইতিহাস থেকে আমরা এটাও জানি যে সাধারণ মানুষেরা বেশিরভাগ সময়েই এগুলোকে অবজ্ঞা করে, এভাবেই ধর্ম মেনেছে মানুষ যুগে যুগে।) তাহলে ওই প্রাণ দেওয়া নাস্তিকেরা সবাই কি আপনার এবং শফি হুজুরের ভাষায় ‘উগ্র নাস্তিক’ নয়?

২. বাংলাদেশে এই ইসলামি মৌলবাদ সৃষ্টির ইতিহাস দীর্ঘ এবং এর সাথে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বহু সমীকরণ যুক্ত- এটা আপনার না-জানার কথা নয়। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই দুই একজন নাস্তিক (হ্যাঁ, নাস্তিকদের মধ্যে এদের সংখ্যাও কিন্তু খুব বেশি নয়) যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার কথামত ‘ঘৃণা’ ছড়িয়েই থাকে তাদের কীভাবে চাপাতি হাতে, বন্দুক-গ্রেনেড-বোমা হাতে তেড়ে আসা, একের পর এক মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়া জঙ্গিদের সাথে তুলনা করা যেতে পারে? তাদের তথাকথিত ভারচুয়াল ‘ঘৃণা’ কিভাবে এতটা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে এরকম একটা সময়ে? কটা মানুষের জীবন নিয়েছে তারা? তাদের সাথে আপনি দ্বিমত পোষণ করতেই পারেন, (দরকার হয়, আসুন এ নিয়ে আমরা সুস্থ বিতর্ক করি, নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করি, সুস্থ বিতর্কের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করি আবার) কিন্তু কোন হিসেবে এই তুলনাটা দেওয়া যেতে পারে সেটা একটু পরিষ্কার করে বলবেন কি?

আপনার কাছে এই তথাকথিত ‘উগ্র’ নাস্তিকদের যদি জঙ্গিদের সাথে তুলনীয় মনে হয় তাহলে অনুরোধ করবো অভিজিৎদের জন্য সৌধ বানানোর কাজটা বন্ধ করুন। আমার বা অজয় রায়ের আজকে আসলে এসব থেকে আর তেমন কিছু চাওয়ার বা পাওয়ার নেই- নাকই যখন আর রাখার অধিকার নেই, সেখানে নরুন নিয়ে খেলা করার আর কী অর্থ থাকতে পারে বলুন তো!

বন্যা আহমেদ এর ফেসবুক থেকে