নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নারী ক্রেতার অভিযোগের ভিত্তিতে মূলত এই অনুসন্ধানটি শুরু করে ফলোআপ নিউজ। বিষয়টি বুঝতে ফলোআপ নিউজের প্রতিনিধি নিজেকেই ভিকটিম বানিয়ে নেয়। দেখা যায়— আসলেই আড়ং-এর এমন কোনো অঘোষিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে, যার দ্বারা তারা তাদের কোনো পণ্য বিল না করে নিয়ে বের হলে বুঝতে পারে, কিন্তু পকেটে বা ব্যাগে থাকা অন্য কোনো বস্তু এই প্রযুক্তি ডিটেক্ট করে না। তাদের এ নিরাপত্তা ব্যবস্থা কারো ব্যাগে অবৈধ অস্ত্র বা মাদক থাকলেও ধরতে সমর্থ নয়। কিন্তু তাদের পণ্য বিল না করা হলে, সেটি ধরতে সমর্থ। একটি বিশেষ গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় ‘বিপ বিপ’ শব্দ হয়, যেটি দ্বারা তারা বুঝতে পারে যে, তাদের কোনো পণ্য নিয়ে ক্রেতা বের হচ্ছে, যেটির বিল করা হয়নি।
”নিরাপত্তার জন্য প্রযুক্তি, কিন্তু সেই প্রযুক্তির গোপন ব্যবহার আর এক ধরনের অপরাধ।” সাইবার সিকিউরিটি ইনসাইডারের দেওয়া তথ্য মতে— সনাক্ত করা যায় না এমন গুপ্তচরবৃত্তি ডিভাইসগুলো কোনো নাগরিকের ওপর ব্যবহার করা অবৈধ। বাংলাদেশের আইনও একই কথা বলে। তাহলে আড়ং কীভাবে অঘোষিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যবহার করছে, যেটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী কর্মকর্তার স্বার্থে প্রবেশকারীর সাথে থাকা কোনো অবৈধ যন্ত্রপাতি সণাক্ত করে না, কিন্তু শুধুমাত্র তাদের পণ্য সণাক্ত করতে পারে? ভোক্তাদের প্রশ্ন— এটি রাষ্ট্রীয় আইনকে তোয়াক্কা না করা এবং সরাসরি নাগরিকে অধিকারের লঙ্ঘন কিনা?
আন্তর্জাতিক আইন বলছে— কোনো মানুষকে তাদের অজান্তে বা সম্মতি ছাড়াই নিরীক্ষণ করার জন্য গোপন ক্যামেরা, অডিও রেকর্ডার বা কোনো ডিজিটাল চিপের মতো সনাক্ত করা যায় না এমন গুপ্তচর যন্ত্রের ব্যবহার তাদের গোপনীয়তার অধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন। এটি মানসিক ক্ষতি, যন্ত্রণার কারণ হতে পারে এবং এমনকি কাউকে ব্ল্যাকমেইল বা হয়রানি করতেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
কিছু দেশের আইনে এটি ওয়্যারট্যাপিং আইনের লঙ্ঘন এবং এজন্য গুরুতর আইনি জরিমানা হতে পারে। সেসব দেশে ব্যক্তিদের গোপনীয়তার অধিকার রক্ষা করতে এবং ইলেকট্রনিক যোগাযোগের অননুমোদিত বাধা রোধ করতে ওয়্যারট্যাপিং আইন রয়েছে।
কেউ চুরি করলে আইনানুযায়ী তার শাস্তি হতে পারে। কিন্তু একজন চোরকেও মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলা, বা মানসিকভাবে হেনস্থা করার সুযোগ নেই। এটা আরেক ধরনের আইনি অপরাধ। চুরির প্রবণতা অনেক মানুষের মধ্যে রয়েছে, শতাংশ হিসেবে সংখ্যাটা কত, সেটি জানার সুযোগ কম হলেও পৃথিবীর অনেক দেশে এ ধরনের গবেষণা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কিছু গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে— কমপক্ষে ৪০% মানুষের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা রয়েছে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে সেটি আরো বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। আধুনিক রাষ্ট্রগুলো চুরি ঠেকানোর জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার দিকেই জোর দেয়, কাউকে চুরি করিয়ে শাস্তি দেওয়ার প্রবণতার দিকে নয়, অর্থাৎ নিরাময়মূলক ব্যবস্থার দিকে নয়। তুলনীয় না হলেও ব্রাক পরিচালিত আড়ং-এর এই গোপন নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেকটা আখের খেত পাহারা দেওয়ার জন্য তারকাঁটায় বিদ্যুতের লাইন লাগিয়ে দেওয়ার মতো। এক্ষেত্রে চোরের শারিরীক মৃত্যু হয় বা হতে পারে। অপরদিকে আড়ং-এর এই ব্যবস্থাটিও গুরুতরো, কারণ, এর ফলে ‘চোরের’ মানসিক মৃত্য হতে পারে।
সকল দেশেই মানুষের ওপর সনাক্ত করা যায় না এমন গুপ্তচর যন্ত্রের ব্যবহার অবৈধ এবং অনৈতিক। এটি গোপনীয়তার অধিকার, বিশ্বাসের লঙ্ঘন এবং মানসিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। যে ব্যক্তিরা এই ধরনের ক্রিয়াকলাপে জড়িত তারা গুরুতর আইনি জরিমানার সম্মুখীন হয়ে থাকে। ওয়্যারট্যাপিং আইনে বা সাইবার ক্রাইম আইনে যে কোনো সম্পর্কের গোপনীয়তা এবং বিশ্বাসকে সম্মান করা অপরিহার্য এবং না করলে গুরুতর আইনি জরিমানা হতে পারে। ব্যক্তিদের গোপনীয়তার অধিকার রক্ষা করতে এবং ইলেকট্রনিক যোগাযোগের অননুমোদিত বাধা রোধ করতে অনেক দেশে ওয়্যারট্যাপিং আইন রয়েছে, বাংলাদেশেও সাইবার সিকিউরিটি আইন রয়েছে।
চুরি ঠেকানোর জন্য তাদের (আড়ং-এর) ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা রয়েছে, এবং সেটির ঘোষণাও রয়েছে। পাশাপাশি কোনো ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর যে নিরাপত্তা ব্যবস্থাটি তারা ব্যবহার করছে, সেটির কোনো ঘোষণা নেই কেন? এটি তো আইনত অপরাধ।
খুলনার নাগরিক সমাজ বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হয়েছে। মানুষ জানতে চায়— আড়ং এই প্রযুক্তি দ্বারা কতজনকে শিকার করেছে, এবং চোর হিসেবে সাব্যস্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে? কোন আইনে ব্যবস্থা নিয়েছে? নাগরিক সমাজ জানতে চায়— আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারো কাছে এ ধরনের তথ্য আছে কিনা, আড়ং কোনো তথ্য জমা দিয়েছে কিনা? যদি না দিয়ে থাকে তাহলে আড়ং কোন আইনে এবং কাভীবে ‘চোরদের’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, কী ব্যবস্থা নিয়েছে?
আড়ং ছাড়াও কিছু প্রতিষ্ঠান অঘোষিতভাবে এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, তবে আড়ং সবচেয়ে কার্যকরভাবে গোপন এ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, যার দ্বারা মানুষকে মানসিকভাবে নাজেহাল করার মতো গুরুতরো অভিযোগ উঠেছে। অথচ ঘোষণা থাকলেও তাদের পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত হত, কাউকে চোর হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করার প্রয়োজন পড়তো না।