Headlines

ধীরে হলেও উত্তরণ হচ্ছিলো, কোভিড পরবর্তী সময়ে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আবার খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা ও অপুষ্টি সংকটের মাত্রা আবার বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি আশঙ্কা করেছিলো যে ২০২৩ সালে ৩৪৫.২ মিলিয়ন মানুষ খাদ্য অনিরাপত্তায় ভুগতে পারে।  এ সংখ্যা ২০২০ সালে খাদ্য সংকটে থাকা মানুষের সংখ্যার চেয়ে দ্বিগুণ। এটি পাঁচ বছর আগের তুলনায় দশগুণ বেশি, একটি উদ্বেগজনকভাবে দ্রুত বৃদ্ধি। যুদ্ধ, অর্থনৈতিক ধাক্কা, চরম জলবায়ু এবং ঊর্ধ্বমুখী সারের দাম— বিষয়গুলো একত্রিত হয়ে অভূতপূর্ব অনুপাতে খাদ্য সংকট তৈরি করছে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮২৮ মিলিয়ন মানুষ তাদের পরবর্তী খাবার কোথা থেকে আসছে তা নিয়ে অনিশ্চিত। বিশ্ব সম্প্রদায় অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে খাদ্য সংকটই দেশগুলোকে আবার সংকটে ফেলে দিতে পারে। পৃথিবীতে এখনো প্রায় ১২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক লোক দিনে ৭ ডলারের চেয়ে কম উপার্জন করে। পরিসংখ্যানের হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান পাকিস্তান, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কার চেয়ে ভালো হলেও বাংলাদেশে এখনো প্রায় এক চতুর্থতাংশ লোক দরিদ্র সীমার নিচে বাস করে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আয় বেড়েছে, সে হিসেবে মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে, কিন্তু বৈষম্য প্রকট। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি, ফলে খাদ্যেস্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করার পরও বাংলাদেশের অনেক মানুষ ক্ষুধা নিবৃতি করতে পারছে না। বাংলাদেশে একইসাথে আমরা দুই ধরনের চিত্র দেখতে পাই— কেউ বেশি খেয়ে অসুস্থ হচ্ছে, খাদ্যের অপচয় করছে, অপরিদিকে জনগণের একটি অংশ না খেয়েও দিন কাটাচ্ছে। বাংলাদেশে শতকরা হিসাবে দারিদ্রের হার ২৪.৩% হলেও সংখ্যায় তা চার কোটির বেশি। ফলে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। টেকসই উন্নয়নের যে লক্ষ্যমাত্রা ২০১৬ সালে ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে ২০৩১ সালের মধ্যে দারিদ্র্য দূর করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এরই মধ্যে কোভিড মহামারি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী যে সংকট তৈরি করেছে সে সংকটে বাংলাদেশেও পড়েছে। এখন ২০২৩ সাল, আর ১০ বছর সময়ও আমাদের হাতে নেই। ২০৩১ সালের মধ্যে দারিদ্র্য দূর করা কি সম্ভব হবে? আসলে পরিসংখ্যানের হিসেবে বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর যে হিসেবটি দেখানো হয়, সেখানে একটি বিষয় বোঝার রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র নিরুপণের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হচ্ছে ১.৯০ ডলার বা ২০০ টাকার কিছু বেশি। অপরদিকে বাংলাদেশে ৬০% মানুষের আয় ২৭৬ টাকা গড়ে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বেশিরভাগ লোক দারিদ্র সীমায় বসবাস করে। কিছুদিন আগে পোলট্রি মুরগী এবং পোলট্রি ডিম ছিলো গরীবের খাদ্য। এখন সেটিও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে। পোলট্রি মুরগী, পোলট্রি ডিম, পাঙ্গাস এবং তেলাপিয়া মাছ যেভাবে চাষ করা হয়, সেগুলো স্বাস্থ্যসম্মত কিনা সে প্রশ্ন না তুলেও বলা যায় এসব স্বস্তা খাবারগুলোও এখন জনগণের একটি অংশের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছে। ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

গত এক দশকে বাংলাদেশ  খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে— দেশটি চাল (বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম উৎপাদক), সবজি (বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম উৎপাদনকারী) এবং মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ বিশ্বের ৭ম আম উৎপাদনকারী এবং চতুর্থ পেয়ারা উৎপাদনকারী রাষ্ট্র। ভারত ও চীনের পর বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ মাছ উৎপাদনকারী দেশ। এই অর্জনগুলি সত্ত্বেও, ফল, শাকসবজি, ডিম, দুধ এবং অন্যান্য খাদ্য পণ্যের মাথাপিছু চাহিদা এবং প্রাপ্যতার মধ্যে এখনো বৈষম্য রয়েছে। বাংলাদেশ খাদ্যোৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও মানুষের ক্ষুধা নিয়ে ঘুমোতে যাওয়ার অর্থ দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নেই।

বাংলাদেশে গত এক বছর ধরে চাল-ডাল, মাছ-মাংস, ডিম-দুধ, তেল-চিনি সহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় মানুষ নতুন করে সংকটে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছে, বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানী নির্ভর এসব পণ্যের দাম বাড়ছে।  কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে— আমদানী করা হয় না এমন সব পণ্যের মূল্যও বিগত এক বছরে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ডিম, মাছ, মাংসের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর ফলে মানুষ আমিষের সংকটে পড়বে বলে ধারণা করা যায়।

অবশ্য উৎপাদন বাড়লেও খানা জরিপ বলছে মানুষের গড় আমিষ গ্রহণের পরিমাণ এবং ক্যালরি ইনটেক কমেছে। সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুসারে দেশের মানুষের দৈনিক মাথাপিছু প্রোটিন গ্রহণের পরিমাণ ২০১৬ সালে ছিল ৬৩.৮০ গ্রাম, যা ২০১০ সালে ছিল ৬৬.২৬ গ্রাম৷ একইভাবে মাথাপিছু দৈনিক ক্যালোরি গ্রহণের পরিমাণ ২০১০ সালের ২৩১৮ কিলো-ক্যালোরি থেকে ২০১৬ সালে নেমে আসে ২২১০ কিলো-ক্যালোরিতে৷ বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কোনো তথ্য না পাওয়া গেলেও ধারণা করা যায় যে, অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে।  

বিশেষজ্ঞদের ধারণা— শুধু বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির একমাত্র কারণ নয়, বাংলাদেশে দেশের সকল মানুষকে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে গিয়ে গত এক দশক ধরে যে হারে জ্বালানি চাহিদা বাড়িয়েছে, তার একটি প্রভাব পণ্যমূল্যের ওপর পড়ছে। সার্বিক অবকাঠামোগত উন্নয়নের একটা প্রভাবও আছে। এরই মধ্যে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছে যে, জ্বালানি খাতে আর কোনো ভর্তুকি দেবে না সরকার। ফলে আগামীতে দ্রব্য মূল্য কমার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। এ অবস্থায় প্রান্তিক মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে না পারলে দেশের মানুষের একটি অংশ আরো সংকটে পড়বে।

নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মোতাবেক যে গ্রামে বিশটি ঘর আছে সেখানেও বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে সরকার। এদিক থেকে দেশের মানুষ এক ধরনের স্বস্তিতে আছে। গ্রামে গ্রামে রাস্তাঘাট এবং বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে পারা এ সরকারের উল্লেখযোগ্য অর্জন । এখন সুন্দরবনের পাশ্ববর্তী গ্রামেও বিদ্যুৎ আছে। বিদ্যুৎ আছে আদিবাসী পল্লীগুলোতে। দুর্গম ১ হাজার ১৪৬ গ্রামে বিদ্যুৎ–সংযোগ দিতে নদী পারাপারে টানা হয়েছে সাবমেরিন কেবল। কোথাও গেছে সৌরবিদ্যুৎ। ২০ মার্চ ২০২২ তারিখে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এসব উন্নয়নের একটা প্রভাব মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওপর পড়েছে। সরকার কীভাবে বিষয়টি সামাল দেয় সেটিই এখন দেখার বিষয়। খোলা বাজারে পণ্য বিক্রির মাধ্যমে সরকার প্রান্তিক মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে, তবে এক্ষেত্রে বিক্রীত পণ্যের মধ্যে চাল আটা তেল চিনির বাইরে কিছু নেই। অপরদিকে মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে চিকিৎসা ব্যয়েও।

এ বছরের গোড়ার দিকে এক বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলেছিলেন। জরিপ বলছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অব্যাহতভাবে কমছে। ২০১৯ সালেও একজন কৃষি শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি দিয়ে দৈনিক ১৩ দশমিক ৪ কেজি চাল কেনা যেত। বর্তমানে সে সক্ষমতা নেমে এসেছে সাড়ে আট কেজিতে। এ অনুযায়ী গত চার বছরে দৈনিক মজুরিভিত্তিক কৃষি শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে ৩৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ও ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইরি) যৌথ এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ‘অ্যান অ্যাসেসমেন্ট অব রাইস প্রাইস হাইক ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, কৃষি মজুরির বিপরীতে শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা এখন ২০১৫ সালের পর সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। ২০১৫ সালে একজন শ্রমিক তার মজুরি দিয়ে দৈনিক ১০ দশমিক ১ কেজি চাল কিনতে পারতেন। এরপর ২০১৬ সালে কৃষি শ্রমিকের গড় সক্ষমতা ছিল ১০ দশমিক ৬ কেজি। ২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৪ কেজিতে। কিন্তু এর পর থেকেই মজুরিভিত্তিক কৃষি শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। তা ২০২০ সালে ৯ দশমিক ১ কেজি, ২০২১ সালে ৮ দশমিক ৬ ও ২০২২ সালে ৮ দশমিক ৫ কেজিতে নেমে আসে। এ অবস্থায় দ্রুত করণীয় নির্ধারণ না করলে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি অংশ নীরব মহামারির মুখোমুখি হবে।