যে দেশ যেমন: বুলগেরিয়া

images


বুলগেরিয়া, সরকারি নাম বুলগেরিয়া প্রজাতন্ত্র, দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ মহাদেশের একটি রাষ্ট্র। দেশটি বলকান উপদ্বীপের পূর্ব পার্শ্বে ইউরোপ ও এশিয়ার ঐতিহাসিক সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। এর পূর্বে কৃষ্ণ সাগর, দক্ষিণে গ্রিস ও তুরষ্ক, পশ্চিমে সার্বিয়া ও মন্টিনেগ্রো এবং ম্যাসিডোনিয়া, এবং রোমানিয়া অবস্থিত। এখানে প্রায় ৭৭ লক্ষ লোকের বাস। সোফিয়া বুলগেরিয়ার রাজধানী ও বৃহত্তম শহর।

বুলগেরিয়া পর্বত, নদনদী ও সমভূমির দেশ। উত্তর বুলগেরিয়ার পূর্ব-পশ্চিম বরাবর বলকান পর্বতমালা প্রসারিত। বলকান পর্বতমালার নামেই অঞ্চলটির নাম হয়েছে বলকান। তবে বুলগেরীয়রা এগুলিকে Stara Planina বা প্রাচীন পর্বতমালা নামে ডাকে। ইউরোপের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী দানিউব বুলগেরিয়ার উত্তর সীমান্ত গঠন করেছে।

পশ্চিমে সোফিয়া এবং পূর্বে কৃষ্ণ সাগর পর্যন্ত নিম্নভূমিটি গোলাপের উপত্যকা নামে পরিচিত। তিন শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এখানকার কৃষকেরা কাজালনুক গোলাপের চাষ করে আসছেন। এই গোলাপের তৈল নির্যাস অত্যন্ত দুর্লভ এবং বুলগেরিয়ার অন্যতম রপ্তানি পণ্য। বুলগেরিয়ার পূর্বে কৃষ্ণ সাগরের উপকূল উত্তরে খাড়া পার্বত্য ঢাল থেকে দক্ষিণে বালুকাময় সৈকতে নেমে এসেছে। এখানকার পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে সারা বিশ্ব থেকে লোক বেড়াতে আসে। উত্তরের পর্বতমালাতে শীতকালে ভারী বরফ পড়ে; ফলে শীতকালীন ক্রীড়ার জমজমাট আসর বসে এখানে।

ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যস্থলে অবস্থিত হওয়ায় বুলগেরিয়াকে নিয়ে বহু শক্তির প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতা হয়েছে। বহু শতাব্দী ধরে এটি একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। মধ্যযুগে এসে দীর্ঘ সময় ধরে একটি প্রধান শক্তি ছিল। প্রথম বুলগেরীয় সাম্রাজ্যের সময় (৬৩২/৬৮১—১০১৮) এখানকার শাসকেরা বলকান উপদ্বীপের অধিকাংশ এলাকা শাসন করেছেন। এখানকার খ্রিস্টান অর্থডক্স ধর্ম, সংস্কৃতি দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপীয় বহু স্লাভীয় জাতিকে প্রভাবিত করেছে। পূর্ব ইউরোপের ভাষাগুলির লিখন পদ্ধতিতে প্রচলিত সিরিলীয় লিপি বুলগেরিয়াতেই উদ্ভাবিত হয়। দ্বিতীয় বুলগেরীয় সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের শেষে ১৩৯৩ সালে দেশটি উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। প্রায় ৫০০ বছর উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে শাসিত হবার পর ১৮৭৮ সালে সান স্তেফানোর চুক্তির মাধ্যমে বুলগেরিয়া একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯১২-১৯১৩ সালের প্রথম বলকান যুদ্ধে জয়ী হলেও ২য় বলকান যুদ্ধে দেশটি হেরে যায় এবং গ্রিস, সার্বিয়া ও রোমানিয়ার কাছে অনেক এলাকা হারায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনারা দেশটির দখলে ছিল। এসময় সোভিয়েত সরকারের সমর্থনে একটি সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সাম্যবাদী শাসনের সময় বুলগেরীয় নেতারা প্রধানত কৃষিভিত্তিক দেশটির অর্থনীতির আধুনিকায়নের লক্ষ্যে একটি শিল্পায়ন প্রকল্প শুরু করেন। ১৯৮৯ সালে গণতান্ত্রিক সংস্কারের আগ পর্যন্ত বুলগেরিয়া একটি সাম্যবাদী রাষ্ট্র ছিল। ১৯৯০ সালে বুলগেরিয়াতে যুদ্ধের পর প্রথমবারের মত বহুদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং এর নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বুলগেরিয়া থেকে বদলে বুলগেরিয়া প্রজাতন্ত্র রাখা হয়।

গণতন্ত্র ও মুক্ত বাণিজ্যের পথে রূপান্তর বুলগেরিয়ার জন্য সুখপ্রদ হয়নি। সাম্যবাদের পতন এবং বুলগেরীয় পণ্যের সোভিয়েত বাজারের বিলোপ ঘটায় দেশটির অর্থনীতির প্রবল সংকোচন ঘটে। মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের ঊর্ধগতি, অবারিত দুর্নীতি, এবং সমাজকল্যাণ ব্যবস্থার বিপর্যয় ঘটায় জীবনযাত্রার মানের চরম পতন ঘটে। অনেক বুলগেরীয় দেশ ছেড়ে চলে যান। বুলগেরীয় সরকার ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে গৃহীত সংস্কারগুলির ব্যাপারে অটল থাকলে ধীরে ধীরে বৃহত্তর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জিত হয়। দেশটি ২০০৪ সালের মার্চে নেটোর এবং ২০০৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হয়।

জীববৈচিত্র: তিনটি ন্যাশনাল পার্কের মাধ্যমে বুলগেরিয়ার বায়োডাইভারসিটি সংরক্ষণ করা হয়। এছাড়াও ১১টি ন্যাচার পার্কস এবং ১৭টি বায়ো স্পিয়ার্স রিজার্ভ রয়েছে। দেশের মোট আয়তনের ৩৫% বনভূমি রয়েছে, ফলে জীববৈচিত্রের দিক থেকে দেশটির প্রাচুর্য রয়েছে। পাইন এবং ওক গাছের মত পূরাতন গাছগুলো এইসব বনভূমিতে জন্মে। ১৯৯৮ সালে বুলগেরিয়ান সরকার National Biological Diversity Conservation Strategy হাতে নেয়। দেশটির ৩৩% এলাকা কনজারভেশনের আওতায় রয়েছে।

রাজনীতি: বুলগেরিয়ায় সংসদীয় গণতন্ত্র রয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। ২৪০ জন সংসদ সদস্য জনগণের সরাসরি ভোটে চার বছয় মেয়াদে নির্বাচিত হন।

অর্থনীতি: বুলগেরিয়াতে বাজার অর্থনীতি প্রসারমান। জিডিপির আশি শতাংশ আসে প্রাইভেট সেক্টর থেকে। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বুলগেরিয়া একটি কৃষিভিত্তিক দেশ হিসেবেই পরিচিত ছিল, ১৯৮০ সালের পর থেকে শিল্পের প্রসার ঘটে। তবে শিল্পের প্রসার ঘটার সাথে সাথে অর্থনীতি উন্নত হয়নি, বরং ১৯৯৭ সালে অর্থনীতি ভঙ্গর অবস্থানের দিকে চলে গিয়েছিল। এখনও বুলগেরিয়া ইউরোপিয় ইউনিয়নের মধ্যে দরিদ্র একটি দেশ।

শিক্ষা: শিক্ষা এবং জ্ঞান বিজ্ঞানে বুলগেরিয়া ক্রমপ্রসারমান একটি দেশ এবং ইউরোপের মধ্যে পিছিয়ে থাকা একটি দেশ বলা যায়, তারপরেও দেশটির অগ্রগতি ইর্ষণীয়। টেকপণ্য রপ্তানিতে তারা এখন তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। মাথাপিছু আয় বাড়ছে, মানুষের শহরমুখীতা বাড়ছে। দেশের শতকরা পঁচাত্তর ভাগ লোক এখন শহরে বাস করে।

বুলগেরিয়া থেকে এ পর্যন্ত নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন একজন। ১৯৮১ সালে এলিয়াস কানেট্টি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি জন্মসূত্রে বুলগেরিয়ান হলেও পরবর্তীতে তিনি ব্রিটিশ নাগরিক হয়েছিলেন। কানেট্টি তার Crowds and Power উপন্যাসে দেখিয়েছেন মিছিল কীভাবে ক্ষমতার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। গণের উল্লাসের সাথে ধর্মীয় সঙ্ঘবদ্ধতার স্বরূপ এই বইয়ে তিনি দেখিয়েছেন।