দেশের সকল জেলায় জেলা প্রশাসনের আয়োজনে একযোগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা, একইসাথে চলছে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জেলায় তিন দিন ধরে এ বইমেলা চলে। তবে এই বইমেলায় প্রকাশনী, গ্রন্থাগার বা বুকস্টল প্রাধান্য পায়নি। গোপালগঞ্জের বইমেলাটি ঘুরে দেখা গেল বেশিরভাগই সেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টল। অন্য যে স্টলগুলি আছে সেখানেও নেই কোনো মূল ধারার সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা।
বই মেলায় বই কিনতে এসেছে এমন কয়েকজন দর্শনার্থী বলছেন তাদের ক্ষোভের কথা। তারা বলছে,
প্রশাসনের উচিৎ মূলধারার প্রকাশনীগুলোকেও জেলাতে আনা। হয়ত জেলায় বিক্রি খুব বেশি হবে না বলে তারা আসে না। বিক্রি হোক বা না হোক এটা তাদের দায়িত্ব। কারণ, সবার পক্ষে ঢাকায় গিয়ে বই মেলায় অংশ গ্রহণ করা সম্ভব নয়, তাই বই মেলায় গণমানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে প্রশাসনের অবশ্যই মূলধারার সৃজনশীল সকল প্রকাশনীগুলোকে জেলার বই মেলায় আনতে হবে। না হলে এটিকে বই মেলার নামে সার্কাসের মতো মনে হয়। মনে হচ্ছে, জেলা প্রশাসনের ওপর একটি দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, জেলা প্রশাসন সে দায় সারছে। এটি আমাদের আশাহত করেছে।
বই মেলায় বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি রয়েছে কয়েকটি গাইড বইয়ের প্রকাশনীর স্টলও। এমনকি নাম বিকৃত করেও একটি প্রকাশনী স্টল নিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দিকদর্শন-গ্রন্থকুটির নামে কোনো প্রকাশনীর অস্তিত্ব নেই। দিকদর্শন একটি গাইড বইয়ের প্রকাশনী, যারা মূলত অনার্সের শিক্ষার্থীদের জন্য গাইড বই বের করে থাকে। তবে গ্রন্থকুটির নামে বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলায় তাদের স্টল রয়েছে, ফলে ‘গ্রন্থকুটির’ নামে তাদের স্টল হওয়া যুক্তিযুক্ত হতো। জানালেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের এক শিক্ষক।
গোপালগঞ্জে যারা লেখালেখি করেন, যাদের বই রয়েছে তাদের জন্য নামমাত্র একটি ব্যবস্থা করা হয়েছে—যে স্টলটির অবস্থা খুবই নাজুক। সেখানে মাত্র পাঁচ ছয়টি বই রাখা হয়েছে। গোপালগঞ্জে দীর্ঘদিন সাহিত্য সংগঠন এবং সাহিত্য চর্চার সাথে জড়িত রয়েছেন এমন একজন কবি গাজী লতিফ বলেন,
লেখকদের সম্মান করা হয় না। আমাদের ডাকা হয় না। লেখকদের নিয়ে কোনো কর্মসূচী নেই। ‘লেখক কুঞ্জ’ নামে একটি স্টল করা হয়েছে, কিন্তু সেখানে বই রাখার জন্য কোনো আহ্বান লেখকদের কাছে করা হয়নি। গোপালগঞ্জের লেখকদের একটি তালিকা প্রশাসনের কাছে থাকা উচিত এবং সে মোতাবেক ওনারা ডাকতে পারেন, তাহলে বইমেলাটা আরও অর্থবহ হবে।
এ বিষয়ে আমরা কথা বলেছি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শান্তি মনি চাকমা ‘র সাথে।
তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল বইমেলায় মূলধারার প্রকাশনী গুলো নেই কেন। তিনি ফলোআপনিউজকে বলেন,
ডাক দিয়ে আমরা তাদের পাই নাই। তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছিল তারা আসে নাই। এজন্য আমরা একলা চলো নীতি নিয়েছি। ফাঁকা রাখার চেয়ে সরকারি স্টল দিয়ে আমরা মেলা সাজিয়েছি। লেখকদের জন্য ‘লেখক কুঞ্জ’ নামে যে স্টলটা রাখা হয়েছে সেটি খুব অপ্রতুল এবং অসংগঠিত কিনা এরকম প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “হয়ত আপনার চোখে এরকম লাগছে।”
গোপালগঞ্জে দীর্ঘদিন ধরে বইপড়া কর্মসূচী পরিচালনা করে, বই এবং লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করে, দক্ষতার সাথে রক্তদান পরিচালনা করে থাকে -এমন একটি সংগঠন বিল্ড ফর নেশন। তারা অভিযোগ করেছে যে স্টলের জন্য আবেদন করেও তারা স্টল পায়নি।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান সরকার বলেন,
“আমি ছিলাম না, ফলে বিষয়টি আমি অবগত নই। এখনও যদি তারা আসতে চায় আসতে পারে। আমি চাই উন্নত মানের বই নিয়ে প্রকাশনী, সংগঠন এবং গ্রন্থাগারগুলো অংশ গ্রহণ করুক।” অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বলেন, “যেহেতু তারা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) ‘র কাছে আবেদন করেছে, তাই আপনি বিষয়টি নিয়ে তার সাথে কথা বলেন।”
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আবদুল্লাহ আল বাকী -এর কাছে জানতে চাইলে তিনি আবেদনের বিষয়টি স্পষ্টভাবে স্মরণ করতে পারেননি। তিনি বলেন,
“আমরা বই পড়ায় মানুষকে উৎসাহিত করার জন্য এই আয়োজনটি করছি, তাই কোনো সংগঠন বই নিয়ে স্টল দিতে চাইলে অবশ্যই আমরা দিতে চাই। সম্ভবত বিল্ড ফর নেশন ঠিকভাবে যোগাযোগ করতে পারেনি। তারা আসলে তাদের সাথে আমি কথা বলব।”
এ বিষয়ে বিল্ড ফর নেশনের সভাপতি শরিফুল ইসলাম খান বলেন,
আমরা দরখাস্ত করেছিলাম, এছাড়া আর কীভাবে যোগাযোগ করতে পারি। তাছাড়া ‘বিল্ড ফর নেশন’ তো গোপালগঞ্জে অপরিচিত কোনো সংগঠন নয়। আমাদের কর্মসূচী সম্পর্কে প্রশাসনও অবগত বলে আমরা ধারণা করি। ভালো ভালো সংগঠন, গ্রন্থাগার এবং লেখকদের খুঁজে খুঁজে জেলা একুশে বইমেলাতে সম্পৃক্ত করা উচিত বলে আমরা মনে করি। সেদিক থেকে চিন্তা করলে গণমানুষের জন্য সে দায়িত্বটি পালন করতে প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে। আমরা যেতে চাওয়ার চেয়ে প্রশাসনের আমাদের নিতে চাওয়ার তাগিদটা বেশি থাকা উচিৎ ছিল বলে মনে করি।
অনুষ্ঠান স্থলে শ্রোতা দর্শক ছিল চোখে পড়ার মতো। দর্শনার্থীদের অনেকে বলছেন,
প্রতিদিন লেখকদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠান থাকলে তাহলে প্রকৃতপক্ষেই এটি বইমেলা হয়ে উঠত। কবিতা আবৃত্তি থাকতে পারত, বইয়ের ওপর আলোচনা রাখা যেত। তারপরও তারা এ আয়োজনের জন্য জেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ দিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে আরও ভালো আয়োজনের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।