আমার আমি টুকরো গল্প: চাঁদাবাজির রাজনীতি না থাকলে ৭টাকার চা সিঙ্গড়ার ঐতিহ্যের গর্ব করতে পারতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের গর্ব

দিব্যেন্দু দ্বীপ


২০০২ সালে আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম জীবীকার তাগিদে। জীবীকাই শুরু করেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগেই আমার উপার্জন ছিল মাসিক ১২ হাজার টাকা।
২০০২/২০০৩ সালে ১২০০০টাকা, কম না! মনে রাখতে হবে তখন আমি ইন্টারমিডিয়েট পাশ। বছর খানেকে ঢাকায় একটু থিতু হয়ে গেলাম, ইতোমধ্যে পরিবারের দায়িত্ব অনেকখানি নিয়ে ফেলেছি।
কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কীভাবে কী পরীক্ষা দেওয়া যায় সেগুলোও মোটামুটি কানে এসেছে। যেহেতু পিছনের রেজাল্ট দুটো একেবারে খারাপ নয়, ফলে পরিচিত যারা তারাই বলা শুরু করলো, “তুমি ভর্তি পরীক্ষা দিলে না কেন।”
বললাম, আমার তো উপার্জন করা দরকার, পড়াশুনা করার আর সুযোগ নেই। তখন ম্যাচের এক দাদা পরামর্শ দিলো, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা কলেজে তো ভর্তি হবা।
মন সায় দিলো না। কারণ, আমার মাথার মধ্যে তখন অন্যকিছু ঘুরছে। ম্যাথে ভালো ছিলাম, ভাবলাম, আর কিছু টাকা হাতে জমুক বুয়েটের জন্য কোচিং করবানে। তখন ওমেকা নামে একটা কোচিং সেন্টার ছিল।
ভর্তি হলাম, একইসাথে ১০টা থেকে ১২টা টিউশনি, সেগুলোর জন্য পড়া লাগে, কোচিং থেকে পড়ার চাপ বিশাল, ইন্টারের অনেক কিছু ততদিনে ভুলেও গেছি। লেজেগুবুরে হয়ে যাচ্ছে।
বাদ দিলাম কোচিং। গরিবের ৬০০০টাকা গচ্ছা গেলো। তবে লাভ যেটা হয়েছিল, অনেককে দেখে মনে হয়েছিল যে পড়াশুনাটা আবার শুরু করা দরকার।
২০০৩ সালের ইন্টার পরীক্ষাটাও ততদিনে হয়ে গেছে। আমি একটা টার্গেট নিলাম, ইন্টার সায়েন্সের দুটো স্টুডেন্ট পড়ানোর রিক্স নিলাম, যাতে নিজের পড়াটা হয়ে যায়, মিথ্যা পরিচয়ে টিউশনি দুটো নিলাম, এর আগের ১০টা টিউশনিও ‘মিথ্যা’ পরিচয়ের।
অনার্সের পরিচয় দিয়ে টিউশনি করতেছি, পরিবার বাঁচানো ফরজ, কিছু করার নেই। এতদিনে টিউশনি করছি, ইংরেজি বা কোথাও বাংলায় অনার্স পরিচয়ে, এবার শুরু করলাম ম্যাথে অনার্স পরিচয়ে।
এ দুই গ্রুপের শিক্ষার্থীদের একবার ক্রসও হয়ে গেছিল, সে আরেক কাহিনী। দুটো সায়েন্সের টিউশনি নিলাম। সমস্যা দাঁড়াল, তারা আমার কাছে পড়বে শুধু বায়োলজি ও ম্যাথ, ফিজিক্স ক্যামিস্টির আলাদা শিক্ষক আছে। তাইই হলো।
আমি নিজের প্রয়োজনে বেশিক্ষণ পড়াই, সময় বেশি দেওয়ায় অভিভাবক খুশি, কারণ, তারা তো বেশি চায়, ঠিক বেঠিক তো বুঝতে পারে না। রাগঢাকা না করে, আমি শিক্ষার্থীর সামনেই গাইড খুলে নিয়ে বসতাম। অকপটে বলতাম, না দেখে আমি করাতে পারব না, তবে বুঝাতে পারব। স্টুডেন্ট মেনে নিয়েছিল। স্টুডেন্ট অবশ্য সায়েন্সে পড়ার যোগ্য ছিল না, অনুগত ছিল ।
যাইহোক, ভর্তি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত এ তুগলকি আমি চালিয়ে গিয়েছিলাম। যেহেতু ঢাকার বাইরে যাওয়া যাবে না, তাই ফরম কিনলাম জাহাঙ্গীরনগর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। পরীক্ষায় বসলাম, চান্স দুটোতেই পেলাম, কিন্তু কোনোটা মনমতো হলো না, যদিও ওতেই অনেক খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু মানুষ এমনই, পেলে ভুলে যায় তার পরিস্থিতি কী ছিল।
জাহাঙ্গীরনগরে বায়োকেমিস্ট্রি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুয়োলজি। বিষয় হচ্ছে, আমি যদি সিরিয়ালটা অন্তত ঠিক করে দিতাম, তাতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ম্যাথে পড়তে পারতাম। আমিই সবচে বেশি মার্কস ভর্তি পরীক্ষায় পেয়ে জুওলজিতে ভর্তি হয়েছিলাম জুওলজিতে যারা ভর্তি হয়েছিল তাদের মধ্যে, ৯৪ পেয়েছিলাম ১২০ এ, অনেকে ৭২/৭৩ পেয়েও জুওলজিতে ভর্তি হয়েছিল।
জুওলজি দিয়ে ফেলেছিলাম ম্যাথের আগে। কারণ, আমি ফিজিক্সেই পড়তে চাচ্ছিলাম, প্রয়োজনে সেটা কলেজে, তখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব অামার জানা নেই, আমি জানি সাবজেক্ট। মেডিকেল/ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া অন্য কিছুর গুরুত্ব বুঝি না। গ্রাম থেকে গেছি, বোঝার কথাও না।

[অবশ্য পড়া শেষ করে বুঝেছি যে জুওলজি কতটা গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্ট!
একটু ভালো করে বিষয়টা পড়লে বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে কাজ করার কথা ভাবতে পারতাম, অথবা বায়োডাইভার্সিটি বা ইকোলজি নিয়ে কাজ করা যেত।] 

যখন মেসে এসে দেখলাম, চান্স পাওয়াতে সবাই মিস্টি খেতে চাচ্ছে, তখন বুঝলাম যে এরও একটা গুরুত্ব আছে। ভর্তি হলাম, কিন্তু কোনোদিনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম আমি ওন করতে পারিনি। কতটা যে পারিনি তা আমার সহপাঠীরা সবচে ভালো জানে।
বই দেখে দেখে সিলেবাস মুখস্থ করা, আর বেশিরভাগ শিক্ষক সম্পর্কে মন্তব্য না হয় নাই করলাম, মানতে পারলাম না। ক্লাসও করলাম না, কিছুই করলাম না, অবশ্যই এটা ভুল ছিল।
তবে সত্য হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিছু চাকরিজীবী ছাড়া আর কিছুই বানাচ্ছে না, এই সিস্টেম থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু বের হবার কথাও না।
আর ভিসি স্যার যে ১০টাকায় চা সিঙ্গড়ার কথা বললেন, সেখানেও গলদ আছে, সেখান থেকে শিক্ষক রাজনীতি কমিশন পায় ১টাকা, ছাত্র রাজনীতি পায় ২টাকা। তা নাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৭টাকার চা সিঙ্গড়ার ঐতিহ্যের গর্ব করতে পারতো। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতিকে ধোকা দিচ্ছে, আমি গর্ব করি না এখানে পড়ার জন্য, লজ্জা পাই।

[উচ্চারণ ভালো হওয়া জরুরী, তবে না হলে সেটি মহা অপরাধ নয়, খুব বড় কোনো সমস্যাও নয়; সমস্যা অন্যখানে। বাঙালি সবসময় আসল সমস্যা থেকে সরে গিয়ে হাবিজাবি নিয়ে মাতে! উপাচার্যের উচ্চারণে কোনো ভুল থাকতে পারবে না, সেটি আমি মনে করি না, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ক্রমাগতভাবে যারা নষ্ট করে চলেছেন সে দায়তো উপাচার্য মহোদয়দেরই সবচে বেশি নিতে হবে।]


লেখাটি দিব্যেন্দু দ্বীপ -এর ফেসবুক ওয়াল থেকে নেওয়া

বিজ্ঞাপন

ই অর্গানিক এগ্রো লিঃ