মানুষকে মুক্ত রাখতে হবে, দায়িত্ব দিয়ে ছেড়ে দিতে হবে

বাবা মায়ের কোলে পিঠে মানুষ হওয়াদের নিয়ে তেমন কিছু করা যাবে—এটা বিশ্বাস করতে আমি এখনো অভ্যস্ত নই। ভালোবাসা মানুষের মস্তিষ্ক বিকল করে দেয়।

এরা বুকিশ এবং ফ্যামিলিশ হয় বলে আমার ধারণা (সব ক্ষেত্রে অবশ্যই নয়)। আমার এ পক্ষপাতিত্ব এ কারণেও হতে পারে যে দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরিবার ছাড়া বেড়ে ওঠার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।

১৯৯৯ সাল থেকে (এক অর্থে শুরু থেকেই) ঘর ছাড়া। এই দীর্ঘ সময়ে কোনোদিন মনে হয়নি কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে বাড়িতে। ফলে আমি বাড়িতে গিয়েছি শুধু কেউ বিপদে পড়লে। স্বেচ্ছায় যাইনি কখনও।

পরিবারের বাইরে বেড়ে ওঠাই শুধু নয়, ২০০০ সাল থেকে নিজের এবং ২০০২ সাল থেকে কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ জনের ভরণপোষণ আমাকে করতে হয়। অপরিণত বয়সে শুধু পরিশ্রম করে, মাথা খাটিয়ে কাজটি করতে গেলে নিজের অজান্তেই নিজের মধ্যে নানান ধরনের বিবর্তন হয়ে যায়, যেটি অনেক বড় সম্পদ বলে এক সময় বোঝা যায়।

পকেটে টাকা না থাকলে নিজে না খেয়ে থাকার সিদ্ধান্ত আপনি নিয়ে ফেলতে পারবেন, কিন্তু কেউ যদি বাসায় আপনার জন্য অপেক্ষা করে থাকে তাকে না খাইয়ে রাখতে পারবেন না। এটা থেকে আমি বুঝেছি—দায়িত্ব কত বড় জিনিস।

আমি হয়ত মহা সংকটে আছি, নিজের পরীক্ষাই বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম, তখন হয়ত ছোট বোন বায়না করল কিছু একটা শখ পূরণের। ছোট দুই ভাই বোনের কারণে আমি খুব অল্প বয়সেই বুঝে ফেলেছি বাবা মা, বিশেষ করে আমাদের সমাজে বাবা কত বড় দায়িত্ব পালন করেন।

স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক এ কারণেও হয়ত খারাপ হয়। কারণ, এখানে যেহেতু পিতা শুধু উপার্জনক্ষম হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, তাই ছেলে মেয়েরা সব দাবী পিতার কাছেই করে। স্ত্রী যেহেতু ঘরে থাকে, তার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় না বাইরের জগত কতটা কঠিন, একইসাথে পিতা বোঝে না লাগাতারভাবে ঘরের কাজ করে যাওয়া কতটা বিরক্তিকর।

আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা আরো কঠিন ছিল কিছু গোপন কারণে। প্রতি তিন মাসের ব্যবধানে কাউকে না কাউকে নিয়ে আমাকে হাসপাতালে যেতেই হত। কোনো কোনো সময় সেটি ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করত।

এমন হয়েছে, সারারাত ঢাকা শহরে আমি একজনের পিছনে দৌঁড়ে বেড়াচ্ছি, তাকে যে কোনো মূল্যে পাকড়াও করে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। বিষয়টা এরকম– টাকা আয় করতে হবে, পরিবারের সবার সুবিধা অসুবিধা দেখতে হবে, অসুস্থ যারা তাদের চিকিৎসা করাতে হবে, এবং নিজের পড়াশুনাটাও চালিয়ে নিতে হবে।

যেহেতু পিছনে ঋণ আছে তাই সে দায়ও ছিল নিত্য সঙ্গী। এর সাথে সব সময় ছিল একটা আন কম্প্রোমাইজিং ‘আমি’।

তবে একটা সিদ্ধান্ত আমাকে এগিয়ে দিয়েছিল, আমি সবার আগে পরিবারকে স্থান দিয়েছিলাম। সিদ্ধান্ত ছিল, কাউকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। সবাইকে একটা মিনিমাম অবস্থানে রাখতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগেই এই ঢাকা শহরে সপ্তাহে আমি আটটা টিউশনি করেছি। আমি যেভাবে অনার্স পাশ করেছি এর চেয়ে মেপে পাশ করা যায় না। একেবারে কাটায় কাটায় সেকেন্ড ক্লাস। ইনকোর্স বেশিরভাগ বাদ। ফলে হিসেবটাে এসেছে ৮০ মার্কসের মধ্যে।

এত কিছু মাথায় নিয়ে চার ঘণ্টা পরীক্ষা দেওয়ার ধৈর্য থাকত না। প্রস্ততিও থাকত না। ফলে বেরিয়ে পড়তাম সর্বোচ্চ তিন ঘণ্টা পরীক্ষা দিয়ে। ভাগ্য ভালো যে পাশ করেছিলাম যথা সময়ে।

এরপর ভুলেভালে জীবন এগিয়েছে কিন্তু সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম এবং আছি। এক সময় আমি খেই হারিয়ে ফেললাম, টিউশনি করতে, কোচিং-এ ক্লাস নিতে কিছুই আর ভালো লাগে না। ঐ দায়িত্ব এবং ভরণপোষণের দায় থেকেই গেলাম চাকরিতে। বছর খানেক চাকরি করলাম এবং ছাড়লাম।

এর সাথে প্রেম প্রীতি বিয়ে থার বিষয় আছে। এমন একটা বিয়ে যেটিও শিখিয়ে দেয় অনেক কিছু।

সবকিছু মিলিয়ে এখন আমার একটাই উপলব্ধি হয়, জীবন আগলে রাখার বিষয় নয়, ভালোবাসা মানে শুধু খেয়াল রাখা যেন খাদে পড়লে টেনে তোলা যায়, এর বেশি যদি কিছু করার থাকে তা হচ্ছে শুধু ভালোবাসা, সবসময় সবাইকে।

মানুষকে মুক্ত রাখতে হবে, দায়িত্ব দিয়ে ছেড়ে দিতে হবে। সময় পরিবেশ চারপাশ মানুষকে শিখিয়ে নেবে, তৈরি করে নেবে।