শাহিদা সুলতানার কবিতাগুলো বিরহের, বৈরাগ্যের এবং প্রেমের। পঙতিমালার পরতে পরতে রয়েছে দৃশ্যপট— কখনো তা মিলনের, তবে স্বভাবতই বিচ্ছেদ-বিরহের। শাহিদা সুলতানা বারে বারে পিছনে ফিরে যান, যদিও বা আপনি কখনও তার কোনো কবিতায় শুরুতে মিলনের সুর পেয়েও যান পরক্ষণেই আপনার আশা ভঙ্গ হবে, দেখবেন দূর হতে হঠাৎ ভেসে আসছে বিহগের সুর। এখানেই তার কবিতার মূলভাব। কবি স্মৃতিকাতর, মিলনন্মুখ, একইসাথে অভিমানী এবং আপন পথে একাকী এক অক্লান্ত পর্যটক। স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে নিতে চান তিনি যে সুর তা পাঠকেরও, ফলে প্রতিটি কবিতা হয়ে উঠেছে সকলের।
বইটি এসেছে বিশ্বসাহিত্য ভবন প্রকাশনী থেকে। বইমেলায় প্যাভিলিয়ন # ৪।
এক ঝুড়ি প্রেম
তুমি নিয়ে এসেছিলে প্রেম
এক ঝুড়ি কমলার মতো
উজ্জ্বল, উচ্ছল, চকচকে–
হেমন্তের শস্যের মতো,
নবান্নের আশ্বাস নিয়ে।
তুমি নিয়ে এসেছিলে শুভ্র ভালবাসা
দু চোখের কোমলতায় নতুন কোন
লাজুক সংগীত–
আমার বেদনার মাঠে ছিল হলুদ সর্ষে ফুল
মানুষের চোরাবালি ভীড়
মটরের ক্ষেত জুড়ে
শীত আর শিশিরের জল
পথের কিনারে
অবহেলা নিয়ে বেড়ে ওঠা
বুনো মাশরুম।
কতদিন পর আজ
একসাথে হেঁটে হেঁটে
আমি দাঁড়ালাম এসে
আমাদের চিরচেনা সেতুর কিনারে
আর একটু এগিয়ে
ক্লান্তি সরাতে তুমি বসলে গিয়ে
পথিকের কাঠের বেঞ্চিতে।
আমার হলুদ সর্ষে ফুল
অবশেষে সূর্যমুখী হোলো
তোমার অনাবিল কমলার ঝুড়িতে।
জুলাই/২০১৮
আসাদ এভিনিউ
চাঁদের রাত
কোন চাঁদের রাতেই আর তোমার কাছে ফেরা হয় না
সাদা বালিয়াড়ির বুকে সাদা জোছনার ঢল নামে
প্রোথিত বৃক্ষের মতো আমি দাঁড়িয়েই থাকি!
সমূদ্র ডুবে যায় শুকনো জোছনার জলে
ডুবে যায় অলকানন্দার ঝাড়
ডুবে যায় রাত্রির সুর দূরত্বের বালিয়াড়ি হয়ে
পরীর ডানা পেয়ে দোলে উর্বশী ঝাউপাতা!
কত পথ আসে কত কত দিক থেকে
মিশে যায় আনন্দ সৈকতে
মিলনন্মুখ নদীর মত মোহনার প্রেমে
কোন কোন চাঁদের রাত এমনি তুখোড়
কোন কোন চাঁদের রাত এমনই মোহময়!
একা একা ভালবেসে ক্লান্ত হয়ে গেলে
অবসন্ন পায়ে আমিও দাঁড়িয়ে থাকি এইখানে
জলের কোমল ছোঁয়া
বালি কাকড়ার খুনসুঁটি মেখে মেখে
মিশে যাই শান্ত মৃত প্রবালের ভীড়ে–
এমন মাতাল চাঁদের রাতে কোনদিনই
ফেরা হয় না আর আমার তোমার দরজায়
ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়!
শান্তিতে ঘুমাতে চাই
তুমি আর কোন দিন এসো না এখানে–
ঝরা পাতারা উড়ে গেছে,
চৈতালী চাঁদ বসে আছে
ঝড়ের পরের নিস্তব্ধ
জোছনা নিয়ে
তোমার অপেক্ষায়!
তুমিও পেরিয়েছ এক বিরান
উপোষী সমূদ্র,
সবুজ ডাংগা থেকে বহু বহু দূরে–
নক্ষত্রের রাতে রাতে
তোমাকে হয়তোবা শুনিয়েছে গান
কোন কোন অরুন্ধতী
তোমার একলা বেলায়,
বিরান শূন্যতায় সেই সুরে তোমার কল্পনা ছুয়ে গেছে
দূরের সবুজ ক্লাউড ফরেস্ট
অধরা ইচ্ছে ভ্রমর হয়ে।
তুমি ফিরে যাও
ভ্যানগগের অলিভ বনের পথে
মেষ পালকের বেশে
পাহাড় চূড়ায়,
বৃষ্টির রেনু ছুতে,
তুমি ফিরে যাও,
যেখানে হারিয়েছো
সুখের মাদুলি খানি,
সেই সমূদ্র সৈকতে,
ফিরে যাও স্টারবাক কফির
স্মৃতিময় নিরালায়।
আমি ও ঘুমাতে চাই একা
এই বিষন্ন জলের বিছানায়
গভীর নীল সমূদ্রের মতো
প্রগাঢ় শান্তিতে ।
৪-৪-২০১৮/ঢাকা
আলো নিভে গেলে
আলো নিভে গেলে
আমি একলা তখন–
জানালার কাচের শার্সি ফুঁড়ে
বৃক্ষের বিষন্ন শরীর
ডুবে যেতে দেখি
ঘন কুয়াশায়–
আমি নিমগ্ন হই আমার ছায়ার বাহুতে
তার সাথে সারারাত নাচি, গান গাই
সুরের জল তরঙ্গ তুলি
নিঃসঙ্গতার ধমনী জুড়ে
শিরায় শিরায়–
খুব বেশি আনন্দ চাইনি কোনদিন
চাইনি অকারণ নিগূঢ় অন্ধকার
চেয়েছি মৃদুলা গোধূলির গান
চেয়েছি উষ্ণ ভোরের ভীরু চঞ্চলতা
ছুঁয়ে যাক এক নির্জন ঝর্ণার দান।
পুরানো ছবির পাখিগুলো
একদিন উড়ে যায়
ইচ্ছের পাখিরা শুধু
রয়ে যায় বহু বহুকাল
মন জুড়ে পরাণের অতল গহীনে–
আকাশ ভরা অভিমানী নক্ষত্র নিয়ে
তবু কি জেগে থাকে
কোন তৃতীয় নয়ন শীতার্ত রাত জুড়ে?
পৃথিবীর শেষ কুটিরের রং মুছে গেলে
সেও কি মিলিয়ে যায়
বেদনার কালশীটে ধোয়ার আড়ালে?
নভেম্বর/২০১৮
আসাদ এভিনিউ