জমির দলিল, খতিয়ান ও নামজারি

index


মা-বাবা ও নিকটাত্মীয়ের সম্পত্তিতে আপনার রয়েছে উত্তরাধিকার। সে সূত্রেই জমির হয়তো ভোগও করছেন। যখনই জমিটা বিক্রি করতে যাবেন বা কারো কাছে হস্তান্তর করবেন, তখন কিছু শব্দের মুখোমুখি হতে হবে। খতিয়ান ও নামজারি এর মধ্যে অন্যতম। জেনে নিন বিস্তারিত:

খতিয়ান কী
কোনো মৌজার দাগ অনুসারে ভূমির মালিকের নাম, বাবার নাম, ঠিকানা, মালিকানার বিবরণ, জমির বিবরণ, মৌজা নম্বর, মৌজার ক্রমিক নম্বর (জেএল নম্বর), সীমানা, জমি শ্রেণী দখলকারীর নাম, অংশ, অংশ মতে পরিমাণসংবলিত যে তালিকা বা দলিল- তাই হলো খতিয়ান। খতিয়ান মানেই এসব বর্ণিত বিষয়ের একটি সুস্পষ্ট হিসাব। একে ভূমিশুমারিও বলা যায়।
সরকার বিভিন্ন সময় খাজনা আদায়ের উদ্দেশে সারা দেশে জরিপ করে এই খতিয়ান প্রস্তুত করে। সরকারের ভূমি জরিপের মূল উদ্দেশ্য ভূমি দখলকারীর কাছ থেকে খাজনা আদায় করা। সে কারণে ভূমিতে যিনি দখলকার তাঁর নামে ভূমি জরিপ করা হয়। এই দখলকারী ওই সম্পত্তিতে কী মূলে দখলকার, তার স্বত্ব নির্ধারণ জরিপ কর্মকর্তার কাজ নয়। তাই খতিয়ান হচ্ছে দখলের প্রামাণ্য দলিল, স্বত্ব বা মালিকানার দলিল নয়। খতিয়ানে মালিক ছাড়া অন্য কারো নাম অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলে ওই ভূমিতে যেমন সেই ব্যক্তির কোনোরূপ মালিকানা সৃষ্টি হয় না, তেমনি প্রকৃত মালিকের মালিকানাও নষ্ট হয় না। কিন্তু খতিয়ান একটি সরকারি দলিল, ভূমি হস্তান্তর, খাজনা বা রাজস্ব আদায়সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
সর্বপ্রথম সার্ভে আইন ১৮৭৫ এবং বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ১৮৮৫-এর অধীনে সরজমিনে ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে বা জরিপ করে সিএস (Cadastral Survey) খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়। একই আইনের অধীনে আরএস (Revenue Survey) প্রস্তুত করা হয়। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের অধীনে যথাক্রমে এসএ (State Acquisition Survey) এবং বিএস (Bangladesh Survey) খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়। সিএস খতিয়ানকে বাংলাদেশি ভূমি ব্যবস্থাপনার মূল ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়।

নামজারি
ভূমি মালিকানার পরিবর্তনে সর্বশেষ খতিয়ানে নাম ও দাগসহ নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করাকে নামজারি (mutation) বলা হয়। এককথায় মূল মালিকের নাম খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করার আইনানুগ প্রক্রিয়াকে নামজারি বলা হয়। খতিয়ান হালনাগাদ করা, সংরক্ষণ ও সংশোধনের মাধ্যম হলো নামজারি করা। রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০-এর ১৪৩ ধারা অনুযায়ী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বা এডিসিকে (রেভিনিউ) নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে খতিয়ান সংরক্ষণ ও সংশোধনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে-
ক. রেজিস্ট্রিকৃত দলিল মূলে জমি হস্তান্তরিত হলে।
খ. ভূমি মালিকের মৃতু্্য ঘটলে।
গ. সার্টিফিকেট মামলা ও কোর্ট মামলা কর্তৃক কোনো জমি নিলাম বা স্বত্বাধিকার ঘোষিত হলে।
ঘ. সরকার খাস জমি বন্দোবস্ত দিলে।
ঙ. পরিত্যক্ত হওয়া বা অধিগ্রহণ করা বা নদী সিকসি্তর (ভাঙনের) কারণে খাজনা মওকুফ হলে নামজারির আবেদন করতে হয়।

নামজারি করবেন কীভাবে
কোনো ব্যক্তি তাঁর নামে খতিয়ানে নামজারি করাতে চাইলে তাঁকে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সংক্ষেপে এসির (ল্যান্ড) কাছে আবেদন করতে হবে। আবেদনপত্রের সঙ্গে যে দলিলের মাধ্যমে সে মালিকানা পেয়েছেন তাঁর ফটোকপি দিতে হবে। যেমন- কবলা বা আদালতের রায়ের কপি। উত্তরাধিকারসূত্রে জমির মালিক হলে ওয়ারিশ সনদপত্র দিতে হবে। সঙ্গে নির্দষ্টি পরিমাণ কোর্ট ফি, ভূমি উন্নয়ন কর ও নতুন খতিয়ানের জন্য ফি দেওয়া লাগবে। এসি (ল্যান্ড) তহসিলদারের কাছে আবেদনপত্রসহ পাঠাবেন, তহসিলদার দখল আছে কি না জরিপ করে এসির (ল্যান্ড) কাছে রিপোর্ট পাঠাবেন। এসি (ল্যান্ড) তার ওপর ভিত্তি করে নামজারি করবেন।

খতিয়ানে ভুলে অন্যের নাম অন্তর্ভুক্ত হলে
কোনো খতিয়ানে জরিপের সময় মূল মালিকের নামের পরিবর্তে ভুলে অন্য কোনো ব্যক্তির নাম অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলে মূল মালিককে খতিয়ান সংশোধনের জন্য জমির দাম অনুযায়ী উপযুক্ত আদালতে মামলা করতে হবে। আদালত খতিয়ান ভুল এই মর্মে রায় (ডিক্রি) দিলে সেই ডিক্রিমূলে খতিয়ান সংশোধনের জন্য এসির (ল্যান্ড) কাছে আবেদন করতে হবে। এমনকি সরকারি সম্পত্তি ভুলে খতিয়ানে কোনো ব্যক্তির নামে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলে সরকারকেও খতিয়ান সংশোধনের ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি আনয়ন করতে হবে। এ বিষয়ে হাইকোর্টের নজির হলো- ‘খতিয়ানসংক্রান্ত স্বত্বের প্রশ্নে একমাত্র দেওয়ানি আদালতই সিদ্ধান্ত প্রদান করতে পারে’ (১৫ ডিএলআর ৪৮৩)। কারণ রাজস্ব কর্মকর্তা এসির (ল্যান্ড) কোনো বিচারিক ক্ষমতা নেই। তিনি জমির স্বত্ব নির্ধারণ করতে পারেন না। আদালতের রায় বা ডিক্রিমূলে নামজারি করতে গেলে আবেদনকারীর স্বত্বসম্পর্কিত কোনো প্রশ্ন বা আপত্তি রাজস্ব কর্মকর্তা করতে পারেন না।