Headlines

অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছি আমরা

wrong society

* আপনি কি হাতেনাতে ডাকাত/সিনতাইকার ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলা সমর্থন করেন?
উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে আপনি রাজনের মত শিশুকে পিটিয়ে মারারও একজন নীরব সমর্থক। যদিও এই মুহূর্তে আপনার এই প্রতিবাদের অনেক মূল্য আছে।

* আপনি কি ধর্ম অবমাননাকারীকে হত্যা করা সমর্থন করেন?
উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে আপনি রাজনের খুনিরও একজন নীরব সমর্থক। যদিও আপনি এখন প্রতিবাদে সোচ্চার, এবং আপনার এই প্রতিবাদের মূল্য অনেক।

* আপনি কি ক্রসফায়ারে একজন সন্ত্রাসীকে হত্যা করা সমর্থন করেন?
উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে আপনিও রাজনের হত্যার একজন নীরব সমর্থক।

আমরা কি অস্বীকার করতে পারি যে, আমরাই নীরব ঘাতক নই?
কামরুলদের সাজা হতে হবে দৃষ্টান্তমূলক, কিন্তু তাতে কি সমাজটা বদলাবে? বদলাবে না। তাতে কি এরকম ঘটনা ঘটা বন্ধ হবে? হবে না।

ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। কিন্তু কীভাবে হবে সেই আন্দোলন?
যখনই আপনি দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করতে যাবেন, তখন সরকার বাহাদুর বলবে, আমাদেরকে নিয়ে কথা বললে কিন্তু র‌্যাব/পুলিশ আছে। অতএব, সমজে চলো।
ধর্মদ্রোহীরা বলবে, আমাদের নিয়ে কথা বললে কিন্তু চাপাতি রেডি আছে। স্টপ ফোকাসিং।

কীভাবে আপনি পিউরিফিকেশনে যাবেন?

পারিবারিক শিক্ষার গুরুত্ব অনেক, কারণ, প্রথমত মানুষ পরিবারেই বেড়ে ওঠে এবং নৈতিক শিক্ষার হাতেখড়ি পরিবার থেকেই হয়।
কী শিখায় আমাদের পরিবার? তার ওপর কি কোনো গবেষণা আছে?
কয়জনের মাতা-পিতা সন্তানের টাকার উৎস সম্পর্ক খোঁজ নেয়?
কয়জনের মাতা-পিতা সন্তানকে অন্যের প্রতি সহনশীল হতে শেখায়?
এদেশের কয়টা পরিবারে ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক এবং অন্যান্য অনেক হিংসাত্বক আলোচনা হয় না?

এরপর পদে পদে আছে বঞ্চনা। পড়া পারেনি বলে দাও মাইর, অথবা অপমান।
আচ্ছা, পরিণত বয়সে আমরা অপমান হজম করতে পারি না, তাহলে একটা শিশু কীভাবে অপমান সহ্য করবে?
আমরা কি ‘না’ সহ্য করতে পারি? তাহলে একটা শিশু কীভাবে ‘না’ সহ্য করবে?
অর্থাৎ, আমাদের বেড়ে ওঠার পদ্ধতিতে গলদ রয়েছে। সবজায়গায় নিষেধাজ্ঞা। প্রতিটি পৃষ্ঠায় নিষেধাজ্ঞা। ক্ষমার আদর্শ আমাদের সমাজে একেবারেই নেই। ভিড়ের মধ্যে পায়ে পাড়া লাগলে আমরা খেকিয়ে উঠি, কাজের মেয়ের ন্যূনতম ভুল ভ্রান্তিতে শাস্তির ব্যবস্থা করি। স্বামী স্ত্রী সামান্য বিষয় নিয়ে তুলকালাম বাধিয়ে দেয়। প্রেমিক প্রেমিকাকে রাস্তার মাঝে চড় থাপ্পড় দিচ্ছে দেখা যায়।
মুখে বলি— ভালোবাসি, কিন্তু ভালোবাসার মানুষটার কোনো বিচ্যুতি ক্ষমার চোখে বা মানবীয়ভাবে দেখতে পারি না, হত্যা পর্যন্ত করে বসি।

এখানেই তো শেষ নয়। বাড়ি যাবেন? স্বস্তিতে যেতে পারবেন না। কারণ, অব্যবস্থাপনা।
পাসপোর্ট করবেন? স্বাভাবিকভাবে করতে পারবেন না, কারণ, অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি।
ব্যাংক থেকে লোন করবেন? সোজা পথে করতে পারবেন না। কারণ, দুর্নীতি।
পুলিশের কাছে কোনো বিষয় নিয়ে অভিযোগ করতে যাবেন? মাইনকা চিপায় পড়ে যাবেন। কারণ, দুর্নীতি। বাজার থেকে ফল কিনতে যাবেন? নিশ্চিন্তে কিনতে পারবেন না, কারণ, ফরমালিন।
অর্থাৎ, আপদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্থ একটা জাতি আমরা একে অপরের লাইফ হেল করে দিচ্ছি, অবশেষে কেউ ভালো নেই।

এর সাথে চোখের সামনে চলে এসেছে আচমকা সবকিছু। পাড়ার দোকানেও এখন স্পিড/টাইগার (পানীয়), আইসক্রিম ইত্যাদি মোড়কজাত পণ্য পাওয়া যায়, যদিও কেরোসিন তেল সহজে কিনতে পাওয়া যায় না এখন। মোড়কজাত পণ্য বেঁচে যদি দশ টাকায় দশ টাকা লাভ হয়, তাহলে দোকানি কষ্ট করে কেরোসিন তেল বেঁচতে যাবে কেন? কিন্তু কেরোসিন তেলের চাহিদা কিন্তু এখনো ফুরিয়ে যায়নি। চোখের সামনে বিভিন্ন বাহারি পণ্য, টিভি/ফ্রিজের মতো দারকারী পণ্য, সবাই তো চাইছে এসব, কিন্তু সামার্থ সবার নেই —তৈরি হচ্ছে অস্থিরতা। যে যার মতো করে যেভাবে হোক পয়শা করতে চাচ্ছে, তাতে মানব পাচার করেই হোক, অথবা পারলে কাউকে খুন করে। চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে সমাজের সর্বত্র।
ধনীরাও ভালো নেই, নিরাপদে নেই। কীভাবে থাকবে? রবীন্দ্রনাথ তো খুব সহজে বলেছেন—
“যাকে তুমি নীচে ফেল, সে তোমারে বাঁধিবে নীচে,
পশ্চাতে রেখেছ যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে । ”

এভাবে কি ভালো থাকা যায়? ভিক্ষুককে ভিক্ষা না দিলেই কি সমাধান হয়? গাড়িটা আপনি কোথায় রাখবেন? রিক্সার আঁচড় কাটা কীভাবে ঠেকাবেন? এইসব রাস্তা দিয়েই তো আপনাকে চলতে হবে। অভুক্ত মানুষেরা, জীবনের কাছে পরাজিত মানুষেরা হঠাৎ কোনো কারণে হিংস্র হয়ে উঠবে না সে গ্যারান্টি আপনি কেন চাচ্ছেন?

এভাবে হচ্ছে না, এভাবে হবে না। পথ বাতলাতে হবে, নইলে সমূহ বিপদ। পদে পদে বিপদ। ভয়ংকর এক সময়ের মধ্যে আছি আমরা। বালির মধ্যে মুখ গুজে থাকা আর কতক্ষণ? কিন্তু কীভাবে কিছু করা যাবে? কোনো যাদুর কাঠি কি কারো কাছে আছে? থোকলে বের করো, প্লিজ।

[একটি জাতি পরিচালিত হয় কিছু দর্শন দ্বারা, প্রত্যেক জাতির উৎকষের পিছনে দার্শনিক সমাজের ভূমিকা অগ্রগণ্য। আমাদের সমাজেও দার্শনিক আছেন। কিন্তু আমরা তাদের গ্রহণ করতে পারিনি। আমরা রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করতে পারিনি, আমরা লালনকে গ্রহণ করতে পারিনি, আমরা নজরুলকে গ্রহণ করতে পারিন, আমরা আমাদের আলোকিত মানুষদের গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। কেন ব্যর্থ হয়েছি? সেটি আলোচনা করতে গেলে অনেক অপ্রিয় বিষয় চলে আসবে। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে দর্শনহীন একটি জাতি আমরা অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছি হাজার টন ওজনের কয়েক দিস্তা নিষেধাজ্ঞার দলিল কাঁধে নিয়ে। এভাবে আর কতকাল?]