ইসলামের অসমাপ্ত যুদ্ধ // শেকস রাসেল

যুদ্ধ
“ইসলামের অসমাপ্ত যুদ্ধ” নামে একটি বইয়ের কাজ করছি, কাজ করছি মানে লিখছি। না ঝামেলার কিছু নেই। আমি ধর্মগ্রন্থ, বা নবীজী সম্পর্কে কোন আলোচনাতেই যাইনি। ও নিয়ে আলোচনা করার মতো সাহস আমার নেই।
আমি বইটিতে দেখাতে চেয়েছি— যে লক্ষ্য নিয়ে মুসলিম মুরেরা ৭১১ সালে দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের দিকে অগ্রসর হয়েছিলো, এবং স্পেন এবং পর্তুগাল দখল করেছিলো, এবং ঠিক তার কয়েক শতক পরে ভারতবর্ষের নিয়ন্ত্রণ নিতে সফল হয়েছিলো, পরবর্তীতে তাদের সে অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে পারেনি। কেন পারেনি?
মূলত আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়া এবং মরক্কো থেকে গিয়ে মুসলিমরা তৎকালীনে ইবেরিয়ান পেনিনসুলার দখল নিতে চেয়েছিলো। স্পেন এবং পর্তুগালের ক্ষেত্রে তাদের সফলতা এসেছিলো। ইবেরিয়ান পেনিনসুলাকে তারা বলত আল-আনডুলাস। যুদ্ধ ৭১১ থেকেই শুরু হয়, তবে খ্রিস্টানরা প্রথম জয় পায় ৭১৮ সালে। এরপর কয়েক শতাব্দী ধরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলেছে। যেটি ধর্মযুদ্ধ নামে পরিচিত। এই সময়ে উভয় পক্ষে জয়-পরাজয় হয়েছে। অবশেষে ১৪৯২ সালে খ্রিস্টানরা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে।
ভারতবর্ষের ঘটনা অনরূপ না হলেও এখানেও মুসলিমরা তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে পারেনি। সর্বশেষ ১৭৫৭ সালে তারা শাসনভার হারায়। ভারতবর্ষে তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে একথা বলা যায় না; হিন্দু ধর্মের বর্ণপ্রথা, পুরোহিত্য, মহাজনী ব্যবসার কারণে এবং তাদের পলায়নপরতার সুযোগে দীর্ঘদিন আরব থেকে এসে তারা এই অঞ্চলে ধর্ম প্রচার করেছে এবং ১২০৪ সালে হিন্দু রাজাদের অস্ত্রের মুখে হটিয়ে শাসনভারও করায়ত্ব করেছে, ফলে বিগত সাত-আটশো বছরে এখানে তারা প্রচুর সহযোদ্ধা তৈরি করতে সমর্থ হয়, এবং তার ফলাফলই হচ্ছে আজকের আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। তাই ভারতভাগ হওয়ার জন্য যতই ব্রিটিশদের দায়ী করা হোক না কেন এ বিভক্তি ছিলো অবশ্যম্ভাবী এবং এর শেকড়ও অনেক গভীরে।
তবে যে লক্ষ্য নিয়ে তারা এগোচ্ছিল মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার অনেক দেশে তখন তা সম্ভব হলেও, পরবর্তীতে পশ্চিমাদের তথা খ্রিস্টানদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্রুত অগ্রগতির কারণে ব্যর্থ হয়েছ।
এখানে আরেকটা বিষয় মনে রাখা দরকার— মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায় তখন কোনো প্রতিষ্ঠিত মতবাদ ছিলো না। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ছোট ছোট গ্রুপ ঈশ্বর চর্চা করত। প্যাগানদের প্রভাব ছিলো তখন। বিভিন্ন ধরনের মূর্তি পূজাই মূলত হত ঐ অঞ্চলে। গোষ্টীপ্রথা ছিলো।
তাই এখানে স্মরণে রাখতে হবে— মধ্যপ্রাচ্যে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়া আর পশ্চিম ইউরোপ এবং ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচার করা এবং অস্ত্রের মুখে রাজ্য দখল করা এক বিষয় ছিলো না। কারণ, ইউরোপ এবং ভারতবর্ষে তখন প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় মতবাদ ছিলো।
তবে ভারতবর্ষে তারা কিন্তু হিন্দুদের কাছে হারেনি। পলায়নপর, এবং তখন চরমভাবে কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দু ধর্মের সে শক্তি ছিলোও না। তারা হেরেছিলো হিন্দুদের সহায়তাপুষ্ঠ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে। অর্থাৎ পশ্চিমা বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির কাছে তারা পরাজিত হয়েছিলো।
প্রশ্ন হচ্ছে, মুসলামানদের বিশ্বজয়ের সে যুদ্ধ কি শেষ হয়েছে? তারা কি সে যুদ্ধ এখন অপ্রয়োজনীয় মনে করছে? আসলে অপ্রয়োজনীয় মনে করার কিছু নেই। এটা তাদের বিশ্বাস, এবং তারা বিশ্বজয়ের এ যুদ্ধকে তাদের স্রষ্টা কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব মনে করে থাকে। এই বিশ্বাসের প্রধান রসদ হচ্ছে— সংকীর্ণ পথে বিশ্বে মর্যাদাসীন হওয়ার বাসনা। পশ্চিমারা যুদ্ধটা করছে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং অর্থনীতি দ্বারা, এবং অস্ত্রের মোকাবেলা তারা করছে প্রতিষ্ঠিত এবং প্রশিক্ষিত বাহিনী দিয়ে। এক্ষেত্রে তারা কাটা দিয়ে কাটা তোলার নীতিও গ্রহণ করেছে। তাদের সফলতা হচ্ছ— ইসলামের সার্বজনীন যুদ্ধটাকে তারা বিচ্ছিন্নতাবাদের রূপ দিতে পেরেছে।
তবে বৃহদার্থেই যুদ্ধ অব্যাহত আছে। আজকে যেসব মুসলিম যোদ্ধাদের জঙ্গি বলা হচ্ছে, তারা কি আসলে জঙ্গি? ঠিক কি অর্থে তারা জঙ্গি? হা, জঙ্গি শুধু একটা শব্দ মাত্র। আসলে তাদের যোদ্ধ (জিহাদী) বলাটাই শ্রেয়। তারা একটা লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে, সেটি তারা ঘোষণাও করেছে। নিজ দেশের হাজার হাজার মানুষ অনাহারে, অশিক্ষায় মরলেও সেদিকে কর্ণপাত করার সময় তাদের নেই, কারণ, ঐ ‘লক্ষ্য’। জন্ম-মৃত্যুর সহজ সমীকরণও এই লক্ষ্যের সাথে সম্পর্কিত।
প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের চূড়ান্ত সে লক্ষ্যে বাধা কি? এবং তাদের পক্ষে আর সে লক্ষ্যে পৌঁছানো কোনো সম্ভাবনা আছ কিনা? এবং এই লক্ষ্যের কারণে কতটা মাশুল দিচ্ছে মানব জাতি। পশ্চিমারা কি শুধুই প্রতিরোধ করছে, নাকি তাদেরও কোনো লক্ষ্য আছে? মার্কসবাদের ভূমিকাই বা কি এখানে? মার্কসবাদ এখন কি এই দুইয়ের মাঝখানে শুধু একটা বাফার পাওয়ার নয়? হিন্দুদের ভূমিকা এক্ষেত্রে কি? ঠিক এসব উত্তরই খুঁজেছি আমি বইটিতে।

[প্রয়োজনের তাগিদেই আমাকে ‘মুসলিম’ ‘হিন্দু’ ‘খ্রিস্টান’ এই শব্দগুলো ব্যবহার করতে হয়েছে। শেষে এসে খ্রিস্টান না বলে শুধু পশ্চিমা বলা হয়েছে, কারণ, আমেরিকা, বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোতে এখন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রকৃতিবাদী, অজ্ঞেয়বাদী এবং নাস্তিক রয়েছে। ইউরোপের অনেক দেশে সংখ্যাটা অর্ধেকের বেশি।]


লেখক: লন্ডন প্রবাসী সাহিত্যিক