ইসলাম, মার্কসবাদ ও রাজনীতি

গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, বেধে দেওয়া কোনো আদর্শ দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হবে কিনা? উত্তর কঠিন নয়, উত্তর হচ্ছে, অবশ্যই সেটি হওয়া উচিৎ না। এটা ইতিহাসে প্রমাণিত যে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে বেধে দেওয়া নীতি-আদর্শ দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়ার সুযোগ নেই। এটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে বারে বারে। কোনো আদর্শই সময়ের সাথে পাল্লা দিতে পারে না। বাট্রান্ড রাসেল অনেক আগেই এ সমস্যার সমাধান দিয়ে গেছেন তীব্রভাব আদর্শবাদের বিরোধিতা করে।

অনেকের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে ইসলাম কীভাবে মার্কসবাদের সাথে তুলনীয় হয়, যেহেতু দুটি আদর্শ অনেকক্ষেত্রেই বিপরীত ধাচের। ইসলাম বিশ্বাস নির্ভর এবং পুঁজিবাদে বিশ্বাসী। অন্যদিকে মার্কসবাদ বিজ্ঞন নির্ভর এবং সাম্যবাদে বিশ্বাসী। তারপরেও লক্ষ্য অর্জনের উপায় এবং কর্মীদের জেহাদী মনস্তত্ত্ব বিবেচনা করলে এ দুটি মেলে অনেকক্ষেত্রে। তবে মার্কসবাদ বেশিরভাগ দেশে জেহাদের জায়গা থেকে সরে আসলেও ইসলামী রাজনীতি সরে আসেনি। আবার উভয় রাজনীতিই অনেক দেশে মধ্যপন্থার সাথে মিলেমিশে কখনো কখনো ক্ষমতার মধ্যে থাকছে একটু আধটু।

ইসলাম এবং মার্কসাবাদ দুটোই জীবনপ্রণালী এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার বিধান এবং দুটোই রচিত হয়েছে ক্ষমতার অভিপ্রায় থেকে, একইসাথে মানব কল্যানের চিন্তা থেকেও। তবে সম্ভবত এরকম বোধ থেকেও যে এটাই সেরা এবং এটাই শুধু একমাত্র টিকে থাকা উচিৎ। এক্ষেত্রে মার্কসবাদীদের এরকম কথাও বলতে শোনা যায় যে তারাই লেটেস্ট ধর্ম এবং একমাত্র মার্সবাদই কমপ্লিট কোড অব লাইফ। অর্থাৎ, মার্কসবাদী এবং খেলাফতিদের দৃষ্টিভঙ্গিতে এক ধরনের মিল পরিলক্ষিত হয়।

বর্তমানে পৃথিবীর সবচে আলোচিত বিষয় হচ্ছে, ইসলাম ধর্মের রাজনীতিকরণ চলবে না। আসলে ইসলাম ধর্ম থেকে রাজনীতি বাদ দিলে ধর্মটা আর থাকে না। হিন্দু ধর্ম যেমন প্রথা নির্ভর এবং প্রথাগুলো বাদ দিলে হিন্দু ধর্মের আর অস্তিত্ব থাকে না।

ইসলাম ধর্ম তো ইহজাগতিক ধর্মই, তবে সময়ের বিবেচনায় তখন ঈশ্বরকে উপলক্ষ করতে হয়েছিল হয়ত। আর ঊনবিংশ শতকে রচিত হয়েছে বলে মার্কসবাদ হতে পেরেছে পুরোপুরি বিজ্ঞানভিত্তিক। ঈশ্বরকে খারিজ করার সাহস ও সুযোগ ততদিনে কিছুটা হলেও তৈরি হয়েছে। যদিও মার্কসবাদ শুধুমাত্র সমাজ জীবন এবং রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে ঈশ্বর-ধর্ম বাদ দিতে চেয়েছে, ব্যক্তি জীবন থেকে নয়। অন্যদিকে ইসলাম ব্যক্তি জীবনে ধর্ম যেমনই থাক সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মকে রাখতে চেয়েছে সেই আমলে দলবদ্ধতার প্রয়োজনে । এ বিবেচনায় ইসলাম এবং মার্সবাদ বিপরীতই বলা চলে।

ইসলাম প্রচারমূলক এবং পুরোপুরি রাজনৈতিক ধর্ম। তাই রাজনৈতিক ইসলাম বাদ দিতে বলা মধ্যপন্থীদের এক ধরনের কূটকৌশল ছাড়া কিছু নয়। প্রশ্ন হতে পারে- তাহলে সুফিবাদ কী? অকপট হলে উত্তর খুব কঠিন নয়, সুফিবাদ আসলে আরবে সৃষ্ট নবী মোহাম্মদের ইসলাম নয়। তাই সুফিবাদের সমর্থন করে রাজনৈতিক এবং জেহাদী ইসলামকে খারিজ করা যায় না মোটেও।

বড় প্রশ্ন হচ্ছে, সঠিক হোক আর বেঠিক হোক ইসলামিক আদর্শ দ্বারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে চাওয়া কি অপরাধ? যদি অপরাধ না হয় তাহলে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ করতে বলার সুযোগ কোথায়?

অপরাধ হচ্ছে জঙ্গিবাদ, একইভাবে সশস্ত্রভাবে মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়াও অপরাধ। রক্ত না ঝরিয়ে মানুষের মন জয় করে যেটি টিকে থাকবে সেটিই মেনে নিতে হবে, সেটি যদি কেউ কৌশলে করে তাহলে তাকেই জয়ী বলে মেনে নিতে হবে। এই দৃষ্টিকোন থেকে রাজনৈতিক ইসলাম এবং মার্কসবাদ দুটিই এখন অকার্যকর, কারণ, যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার কোনো পথ করতে তারা ব্যর্থ।


দিব্যেন্দু দ্বীপ