২০১৩ সালের কথা, রোহেল (ছদ্মনাম) তখন থাকত রামপুরার বনশ্রীতে বড় বোনের বাসায়। ও তখন ওখানে স্থানীয় একটি কোচিং-এ ক্লাস নিত। ক্লাসে একটি মেয়ের সাথে ওর পরিচয় হয় এবং শিক্ষক হিসেবে মেয়েটি এবং মেয়েটির মা ওকে বাসায় ডাকে। রোহেল সিজফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিল, যেটি মেয়েটির মা এবং মেয়েটি জানত না।
বাসায় গেলে ওনারা ওকে আনারস খেতে দিলে ও আনারস না খেয়ে আনারস সম্পর্কে নানান প্রশ্ন করতে থাকে এবং সেটি পরীক্ষা নীরিক্ষা করতে শুরু করে। বিষয়টি জনৈক মহিলা স্বাভাবিকভাবে নেয় না। ওকে তখন অপমান করে বের করে দেয়, এবং কোচিং-এ নালিশ করে যে রোহেল ওনাদের বাসায় গিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। ফলে কোচিং থেকে মালিক ওকে বাদ দেয়।
এরপর রোহেলের অসুস্থতা আরো বেড়ে যায়। ফলতঃ পথে একদিন মেয়েটির সাথে দেখা হলে ও অপমানের জবাব চায়। মেয়েটি বাসায় গিয়ে বিষয়টি নালিশ করে। তদপ্রেক্ষিতে মেয়েটির ‘মামা’ রোহেলকে একটি রেস্টুরেন্টে ডেকে নেয় এবং মারধর করে, রোহেলও পাল্টা মার দেয়। এরপর রামপুরা থানায় মেয়েটিকে দিয়ে ইভটিজিং মামলা করানো হয় এবং পুলিশ ওকে তখন গ্রেফতার করে কোর্টে চালান করে।
২০১৩ সালে একজন এডভোকেটকে (অনাবিল আনন্দ রায়) দিয়ে কেসটি তখন ডিল করা হয় এবং ৫০,০০০/- খরচ করে জামিন করানো হয়। এরপর কেসটি অনিয়মিতভাবে খোঁজখবর করা হয় যেহেতু রোহেল এরপর মারাত্মকভাবে অসুস্থ থাকে এবং কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘদিন ডা. মোহিত কামালের কাছে চিকিৎসা নেওয়ার পর ২০১৫ সালে ও সুস্থ হয় এবং চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে।
২০১৬ সালে ও সরকারি পলিটেকনিকে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে। হঠাৎ দেখা যায়, পুলিশের কাছে ওর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা গিয়েছে। ও সুস্থ হওয়াতে এবং চাকরি পাওয়াতে রোহেলের পরিবার ভেবেছিল নিস্তার হয়েছে, কিন্তু হঠাৎ স্থায়ী ঠিকানায় পুলিশ ওকে খোঁজ করায় ওর পরিবার বেশ চাপ অনুভব করে। ঢাকা জর্জ কোর্টে খোঁজ খবর করে জামিনের ব্যবস্থা করতে গিয়ে দেখা যায় বেশ কিছু টাকা ছাড়া জামিন করানো কঠিন।
এমতাবস্থায় কয়েকজন সম্মানিত উকিলের কাছ থেকে বিভিন্ন রকম মত-দ্বীমত এবং খরচ খরচার পর রোহেল এবং ওর বড় ভাই হতাশ হয়ে পড়ে। আমি ভাবতে থাকি মানুষ কতটা বিপদে থাকে এসব বিষয় নিয়ে তাহলে!
যাইহোক, ইতিমধ্যে ওদের সাথে পরিচয় হয় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সদ্য সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক (বর্তমান কমিটিতে সহকারি সাধারণ সম্পাদক) বায়েজিদ আক্কাসের সাথে। তিনি নিজেকে এডভোকেট হিসেবে পরিচয় দিয়ে জামিন করানোর কথা বলেন। তার কথার উপর ভর করে রোহেল ২১/০১/২০১৭ তারিখ থেকে ছুটি নিয়ে এসে ঢাকায় অবস্থান করে। এবং জনাব বায়েজিদ আক্কাসকে জামিন করানোর জন্য নিম্নোক্ত বর্ণনায় টাকা প্রদান করা হয়।
২০/০১/২০১৭ তারিখে বিকাশ মারফত ২,০০০/-
২২/০১/২০১৭ তারিখে বিকাশ মারফত ৫,০০০/-
২২/০১/২০১৭ তারিখে সরাসরি ১,০০০/-
২৩/০১/২০১৭ তারিখে বিকাশ মারফত ৮,০০০/-
২৫/০১/২০১৭ তারিখে বিকাশ মারফত ৩,০০০/-
২৯/০১/২০১৭ তারিখে সরাসরি জর্জ কোর্টের সামনে আল ইসলাম হোটেলে বসে ৫০,০০০/-
মোট ৬৯,০০০/- তাকে দেওয়া হয়েছে।
ওরা প্রত্যেকটি টাকা যোগাড় করেছে পরিবারের কারো না কারো মৌলিক প্রয়োজন না মিটিয়ে। দিন চলে যায়, ওর ছুটি শেষ হয়ে যায়, কিন্তু জামিনের কোনো খবর নেই। জনাব বায়েজিদের সাথে টাকা দেওয়ার পাশাপাশিও বিভিন্নভাবে সাক্ষাৎ করা হয়েছে।
রোহেল এবং ওর বড় ভাই তাকেসহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে হোটেলে খাওয়ানো ইত্যাদি করেছে। তার (বায়েজিদ) বাসা শ্যামলীতে হওয়ায় জর্জ কোর্টে কাজ করার জন্য তিনি পুরনো ঢাকার জর্জ কোর্টের কাছাকাছি বনশালে অবস্থিত আল রাজ্জাক হোটেলে এসে থেকেছেন।
সবই করেছেন কিন্তু মামলার কোনো কাজ এগোয়নি। অবশেষে মি. বায়েজিদের সূত্র ধরে রোহেল এবং ওর বড় ভাই স্মরণাপন্ন হয় ঢাকা জর্জ কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি (২০০৭-২০০৮) বর্তমানে পাবলিক প্রসিকিউটর খন্দকার আব্দুল মান্নান সাহেবের কাছে। একই সাথে তিনি ব্লাস্ট, ঢাকা ইউনিটেরও সভাপতি। তিনি এখন মামলাটি পরিচালনা করাচ্ছেন এবং সমগ্র বিষয় অবগত হয়েছেন।
তবে মি. বায়েজিদের আর নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি তেমন কোনো টাকা মামলায় খরচ করেননি বলেও নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এমতাবস্থায় আমি প্রশ্ন করতে চাই, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মত এত বড় একটি আদর্শিক সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক (সদ্য সাবেক) এরকম করলে মানুষ দাঁড়াবে কোথায় গিয়ে? তবে আশার কথা যে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বর্তমান সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন।
রোহেলের বড় ভাই খুব দুঃখের সাথে বলছে, আমরা যারা এতদিন বিভিন্নভাবে সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করলাম, করছি তারাই যদি এভাবে অবিচারের শিকার হই তাহলে দেশের গণমানুষের মুক্তি মিলবে কীভাবে? বিষয়টি শুধু দুঃখের নয়, বরং গভীর ভাবনারও।
দুঃখের, বিষয়টি চরম বেদনার, রোহেল এই পনেরো দিনে এখন আবার অসুস্থ হয়ে গেছে, কিন্তু ওর জামিন হয় নাই। আজকে ওকে কোর্টে আগাম দাঁড় করিয়েছিল উকিল। ওর আগামী হাজিরার তারিখ ছিল ১১/০৪/২০১৭ তারিখে। আজকে জজ ওর জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠায়। অথচ উকিল নিশ্চয়তা দিয়েছিল জামিন হবে। হল না!
কত চোর ডাকাত জামিন নিয়ে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, নতুন করে অপরাধ করছে, অথচ একজন দীর্ঘদিনের অসুস্থ মানুষ, মেধাবী শিক্ষার্থী, যে সুস্থ হয়ে চাকরি পেয়ে চাকরি করছে, কিন্তু একটা মিথ্যা এবং ত্রুটিপূর্ণ মামলায় ভুগছে, কিন্তু কিছু করা যাচ্ছে না, শুধু জিম্মি হতে হচ্ছে এর ওর কাছে গিয়ে।
সত্যিই অদ্ভূত আমাদের দেশ, আরো বেশি অদ্ভূত ঠেকে আমাদের নিজেদেরকে, কারণ, কেন জানি দেশটাকে সুন্দর করার দায় এখনো আমরা অনুভব করি, এবং এজন্যই বিনা পারিশ্রমিকে রাত জেগে জেগে লিখি। মাঝে মাঝে ভাবি, লিখে কিছু কি আসলে করতে পারছি, নাকি সবই পণ্ডশ্রম হচ্ছে?