কবিপ্রণাম: পথের শেষ কোথায় … কী আছে শেষে

Dilip Kumar Nath

বঙ্গীয় রেনেসাঁর অন্যতম দিকপাল, বাংলা গদ্য রীতিতে চলিত ভাষার প্রবর্তক, প্রাবন্ধিক-কবি, সবুজপত্রের প্রকাশক, বীরবলী ধারার জনক প্রমথ চৌধুরী তাঁর বর্ষা প্রবন্ধের মধ্যে বলেন, “আজকের দিনে রবীন্দ্রনাথের একটি পুরনো গানের প্রথম ছত্রটি ঘুরে ফিরে ক্রমান্বয়ে আমার কানে আসছে”—

এমন দিনে তারে বলা যায় …

এমন দিনে যা বলা যায় তা হয়তো রবীন্দ্রনাথও আজ পর্যন্ত বলেননি, শেক্সপিয়রও বলেননি। বলেন যে নি, তা ভালোই করেছেন। কবি যা ব্যক্ত করেন তার ভিতর যদি এই অব্যক্তের ইঙ্গিত না থাকে, তাহলে তাঁর কবিতার ভিতর কোনো mystery থাকে না, আর যে কথার ভিতর mystery নেই, তা কবিতা নয়, পদ্য হতে পারে।

প্রমথ চৌধুরীর পবিত্র স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর এই বিখ্যাত কথাটিকে একটু অন্যভাবে প্রকাশের দুঃসাহস করছি। পথের শেষ কোথায়, কি আছে শেষে? কি শেষে আছে তা রবীন্দ্রনাথও বলেননি, শেক্সপিয়রও বলেননি। জীবনের পথের শেষ জানা থাকলে mystery বিহীন জীবন নেহাত গতানুগতিক ও অনাকর্ষণীয় হয়ে পড়ত। রবীন্দ্রনাথ সভ্য মানুষের চিরন্তন প্রশ্নই রেখেই গেলেন, “পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে।”

শেক্সপীয়রও তাঁর Measure for Measure এ বলেন, “Ay, but to die, and go we know not where/To lie in cold obstruction and to rot.” গন্তব্য কোথায় কেউ তা বলেন না, অজানা এ গন্তব্য -এটুকুতেই থেমে যান।

সভ্যতার ইতিহাসে একটি পর্যায়ে এসে ভাবুক মানুষের বোধে এ প্রশ্নের উদয় হয়েছে। মানব (HOMO) মহাজাতির আদি প্রজাতি হাতিয়ার প্রস্তুতকারী মানব (Homo habilis) ও পরবর্তী প্রজাতি ঋজু মানব (Homo erectus) সময়কালে মানুষের মনে সে প্রশ্নের উদয় হওয়ার মতো মস্তিষ্ক ব্যবহারের অবসর সময় সৃষ্টি হয়নি এবং বৈষয়িক শর্তও পূরণ হয়নি।

বুদ্ধিমান মানুষ (Homo sapiens) পৃথিবীতে অবস্থান করছে প্রায় ৩ লক্ষ বছর। কিন্তু মাত্র হাজার বারো-পনেরো বছর পূর্বে কৃষিভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত মৃত্যু পরবর্তী জীবন, পরকাল (Afterlife বা Hereafter) নিয়ে সম্ভবত বর্তমান প্রজাতি বুদ্ধিমান মানব ভাবেওনি। এর একটি যুক্তি যে বিশ্লেষকগণ দেন তার দৃঢ় বৈষয়িক ভিত্তি আছে। বিশ-পনের লক্ষ বছর থেকে মানুষের আদি প্রজাতি ও পরবর্তী প্রজাতি ফলমূল সংগ্রহ ও শিকারের ওপর জীবন নির্বাহ করেছে। প্রধানত তাৎক্ষণিকতাই তার জীবিকার ধরণ। ভবিষ্যৎ চিন্তা মাথায় আসে না। লোকজ তন্ত্র মন্ত্র, ওঝা, ঝাড় ফুঁক সবই ছিল। অশরীরী বিভিন্ন মৃত ও অন্যান্য আত্মার ধারণাও ছিল। সেসব আত্মাকে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহারের প্রথাও ছিল। কিন্তু সেসব তাৎক্ষণিক জাগতিক প্রয়োজনে। টিকে থাকার সংগ্রামে সমতাভিত্তিক সমাজ ছিল অপরিহার্য।

কৃষি সমাজের উদ্ভবে বহু কিছু ওলটপালট হয়ে যায়। জীবনধারণের ন্যুনতম প্রয়োজনাতিরিক্ত উদ্বৃত্ত সৃষ্টিই প্রধানত এর পেছনে দায়ী। উদ্বৃত্ত সৃষ্টি একদিক থেকে কিছু লোককে মনোজগতে অবসর সময়ে চিন্তার অবকাশ দেয়। কৃষিতে প্রয়োজন সময়, পরিকল্পনা, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা। এভাবে হয়ত মৃত্যু পরবর্তী জীবনে দেহ থেকে আলাদা আত্মার উপস্থিতির চিন্তা এসেছে। এবং দারুণ ফলপ্রসূ হয় এ ধারণা কৃষিসমাজে সৃষ্ট বৈষম্যকে ধর্মীয় আবরণে মানুষের চিন্তাজগতে বৈধতা দিতে।

পরকাল বা মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে সভ্য মানুষের যে ভাবনা তা বহুমাত্রিক। ধর্মীয়-সাহিত্যিক, নিছক ধর্মীয়, ধর্মীয়-দার্শনিক, নিছক দার্শনিক ইত্যাদি। পরকাল সম্পর্কে সুতীব্র আকুতিপূর্ণ অভিলাষ আমরা দেখি পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা প্রাচীনতম টিকে থাকা মহাকাব্যের নিদর্শন মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয়- আক্কাদীয় ‘গিলগামেশ’ এ। প্রায় ৪৭০০ বছর আগে রচিত এ মহাকাব্য নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। দুই তৃতীয়াংশ দেবতা ও এক তৃতীয়াংশ মানুষ গিলগামেশ, মতান্তরে উরুকের রাজা গিলগামেশ তার বন্ধু এনকিদুর মৃত্যুতে এতটাই ভেঙ্গে পড়ে যে সবার উপদেশ অগ্রাহ্য করে সে দেবলোকে অমরত্বের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে।

শেষ পর্যন্ত বহু বাধা অতিক্রম করে সে স্বর্গের উদ্যান দিয়ে পৌঁছায় অমর মনুষ্য যুগল উটনাপিশটিম ও তার স্ত্রীর নিকট। এবং উটনাপিশটিমের নিকট থেকে জানতে পারে অমোঘ সত্য মানুষের সাধারণ ভাগ্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম নিরর্থক। জীবনের আনন্দ তাহলে আর থাকে না। গিলগামেশ মহাকাব্য নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। একেশ্বরবাদী ইহুদি-খ্রীস্টধর্মে যে ‘নোয়ার মহাপ্লাবন’ ও নোয়ার নৌকো সম্পর্কে বলা আছে, হেসিওডের গ্রীকপুরাণ ‘থিওগোনি’ তে টাইটান প্রমেথিউসের মনুষ্য পুত্র ডিউকেলিয়নের প্লাবন সম্পর্কে যা আছে তার মূল এই বহুত্ববাদী ধর্ম মেসোপটেমীয় গিলগামেশের উটনাপিশটিমের প্লাবন ও নৌকোর কাহিনী।।গ্রীক পুরাণের হেডিসের নদী স্টিখের মাঝি ক্যারন গিলগামেশের স্বর্গে যাবার উটনাপিশটিম সাগরের মাঝি উরশানাবির আদলে চিত্রিত। বাইবেলের স্বর্গীয় ইডেন গার্ডেনও গিলগামেশের দেখা গার্ডেন অব প্যারাডাইস আদলে।

আত্মা-দেহ (soul- body) বা দেহ-মন ( mind-body) দুয়ের দ্বৈততা (Dualism) সম্পর্কে শ্বেত ইওরোপীয় আত্মমদগর্বী, উন্নাসিকরা শ্বেতজাতিগোষ্ঠী বহির্ভূত ধ্যান-ধারণার কাছে ঋণ স্বীকারে প্রচণ্ডভাবে অস্বীকৃত বলে অধিকাংশই এ বিষয়ে প্লেটোর পূর্বে যেতে অনিচ্ছুক। কিন্তু আমরা খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ-পঞ্চম সহস্রাব্দে মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয়, আক্কাদীয়, আসিরিয় ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় এর ধারণা পাই। মৃত্যু জীবনের শেষ নয়, মৃত্যু এক রূপের আত্মা, সুমেরীয় ‘গিদিম’, আক্কাদীয়’ এটেমা বা প্রেতাত্মা। এদের স্থান মৃত্যুর পর পৃথিবীর মাটির অনতিদূরে পাতালে (Netherworld)। চির অন্ধকার, না ফেরার দেশ এটি । এ নরক নয়। জীবনে সুকৃতি বা পাপ করার সাথে সম্পর্ক নেই। সব মানুষকেই মৃত্যুর পর এখানে আসতে হবে। খাদ্য ধূলা, পুষ্টি মাটি। প্রেতাত্মারা ক্ষুধা, তৃষ্ণা অনুভব করে। মৃত্যুরও পর শূন্য মৃতদেহ গভীর ঘুমের মধ্যে থাকে এবং মাটিতে সমাহিত করার পর যে দেহ মাটি থেকে তৈরী তা ‘আবার মাটিতে ফিরে যায়’।

মানুষ সৃষ্টি হয়েছিল পৃথিবীর মাটি ও এক অমর দেবতার রক্ত দিয়ে। পরবর্তীকালে বাইবেলেও এক যায়গায় মৃত্যুকে ঘুম বলা হয়েছে এবং জেনেসিসের এক যায়গায় বলা আছে ‘তোমরা হচ্ছো ধূলা, এবং ধূলায় তোমরা ফিরে যাবে’।

সমসাময়িক নীল নদ বিধৌত মিসর সভ্যতায় চিত্রটি অতটা হতাশাব্যঞ্জক নয়। সেখানে মৃত্যুর পর আত্মার তিন পরিশীলিত রূপঃ বা (Ba), কা (Ka) ও আখ (Akh)। বা (Ba) ব্যক্তিগত আত্মা বা চরিত্র, দেহ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়, আত্মার এই অংশ জীবিত ও মৃত উভয় বিশ্বে ভ্রমণ করে। কা (Ka) জীবন শক্তি ( Life force) যা দেহ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং মৃত্যুর পর দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আখ (Akh) বিচারের পর পুনরুত্থানের মাধ্যমে দেবতাদের সাথে অমর হয়ে পরমানন্দে বাস করে। আমরা পরবর্তী সময়ের খ্রীস্টীয় শেষ বিচার ও পুনরুত্থান, স্বর্গের ধারণা এখানে পাই। যারা পাতালের রাজা দেবতা আসুর বা ওসিরিসের বিচারে উত্তরণে ব্যর্থ হয়, তাদের পুনরুত্থান নেই, তারা পুনঃ মৃত। অনেক পরের বাইবেলের নরকের ন্যায়।

ঐতিহাসিকদের মতে সমসাময়িক বা একটু পরে ভারতে আর্য জাতির আগমন পরবর্তী যে ধর্মবিশ্বাস ও দর্শনের আমরা সাক্ষাৎ পাই, সম্ভবত প্রাচীন বিশ্বে দেহ-আত্মা সম্পর্কিত পক্ষে বিপক্ষে গুরুগম্ভীর ও সূক্ষ্ম দার্শনিক আলোচনা সেইই প্রথম। বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, গীতা সর্বত্র আত্মাকে অমর, জন্মরহিত, নিত্য বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে গীতার এ শ্লোকটি বহুল ব্যবহৃতঃ

ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ
নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ
অজো নিত্য শ্বাশ্বতোহয়োং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমান শরীরে।

এ আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। আত্মা ছিল না, বর্তমানে নেই, ভবিষ্যতেও হবে না। এ জন্মরহিত, নিত্য, শ্বাশ্বত ও পুরাণো। শরীরকে হত্যা করা যায়, কিন্তু আত্মাকে নয়। দেহ ও আত্মার স্পষ্ট দ্বৈততা এখানে দৃশ্যমান। বেদ যুগের প্রথমদিকেও এ ধরণের দ্বৈততার কথা আছে। বিপরীতে বেদ, কোন কোন উপনিষদে ‘সোহহম’ আমিই সে, অর্থাৎ আমি সেই পরম সত্বা, জীবাত্মা ও পরমাত্মার অভিন্নতা এমন অদ্বৈত দর্শনের কথা ও আছে।
এ ভিন্নতা সত্বেও পুনর্জন্মবাদ বৈদিক ও হিন্দু আস্তিক্য দর্শনের অন্যতম স্তম্ভ। অমর এ আত্মা মোক্ষ, মুক্তি, নির্বাণ বা কৈবল্য লাভ না হওয়া পর্যন্ত পুনঃ পুনঃ অন্য দেহে জন্মগ্রহণ করতেই থাকে।এ শ্লোকটিও এ সম্পর্কে বহুল প্রচলিতঃ

বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যন্যানি
সংযাতি নবানি দেহী।

মানুষ যেমন জীর্ণ শীর্ণ বস্ত্র ত্যাগ করে নতুন বস্ত্র গ্রহণ করে, সেইরূপ আত্মা জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নতুন শরীর গ্রহণ করে।
কর্মফল অনুযায়ী জীবাত্মা স্বর্গসুখ বা নরকযন্ত্রণা ভোগ করে। কিন্তু তা চিরস্থায়ী নয়। নির্দিষ্ট সময় পর সে আবার পুনরায় জন্মগ্রহণ করে এবং এ সংসার চক্র মোক্ষ বা নির্বাণ প্রাপ্তি অবধি চলতেই থাকে। সুতরাং মোক্ষলাভই তার মুক্তির উপায়। এই মোক্ষলাভের পথ নিয়ে প্রাচীন ভারতীয় ষড়দর্শনেও মতদ্বৈধতা আছে। সাংখ্য, যোগ ও অদ্বৈত দর্শন অনুযায়ী এই ইহজগতে মোক্ষলাভ সম্ভব। ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা, দ্বৈত দর্শনে একমাত্র মৃত্যু পরবর্তী জীবনে মোক্ষলাভ সম্ভব বলে মত প্রকাশিত হয়েছে।

হিন্দুধর্ম থেকে উদ্ভূত বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ ধর্মেও জন্মান্তরবাদ উপস্থিত। বৌদ্ধধর্মেও কর্মের দ্বারা বারবার জন্ম ও মৃত্যুচক্র মধ্য দিয়ে নির্বাণ লাভ পূর্ব পর্যন্ত চলতে থাকে। কিন্তু কোনো চিরস্থায়ী আত্মা নেই। বুদ্ধ অনাত্মার ধারণা দেন। পুনঃ পুনঃ জন্ম দুঃখ ডেকে আনে, কিন্তু পুনর্জন্মের দুঃখ নির্বাণলাভে নিবৃতি হয়।

আর্য সভ্যতায় ধর্ম ও দর্শনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে আত্মার অমরত্ব ও আস্তিক্যবাদী দর্শনের পাশাপাশি হয়ত প্রায় একই সময়কালে আত্মার অনস্তিত্ব ও নাস্তিক্যবাদী দর্শনও বিকশিত হয়। সম্ভবত তখন পর্যন্ত অন্য কোন সভ্যতায় নাস্তিক্যবাদ ধারণা বিকশিত হয় নি।রামায়ণ রচিত হবার অনেক আগে থেকেই তা মুখে মুখে ছিল। রামায়ণে দেখা যায় বিখ্যাত জাবালা-রাম কথোপকথন। রামকে পিতৃসত্য পালনে নিরুৎসাহিত করতে ঋষি জাবালা রামকে এভাবে বোঝাতে চাইছেন যে আত্মা, পরকাল ও ইশ্বর বলে কিছু নেই। এ জীবনের বাইরে আর কিছু নেই সুতরাং রাম অযোধ্যায় গিয়ে রাজত্ব করুন ও জীবন উপভোগ করুন। যদিও রাম উল্টো জাবালাকে আস্তিক্যবাদের পাঠ দিলেন কিন্তু সেই প্রাচীনকালে যে ভারতে কিছু মুনি ঋষিরা প্রবল আস্তিক্যবাদ, অবিনশ্বর আত্মার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ মতবাদও চিন্তাজগতে এনেছিলেন তার প্রমাণ মেলে। রামের পিতা দশরথও জাবালীর নাস্তিক্যদর্শন জেনেও তার প্রাসাদে বিজ্ঞমণ্ডলীতে স্থান দিয়েছিলেন।

ভারতীয় দর্শনে নাস্তিক্যবাদের সবচেয়ে সুস্পষ্ট ধারা চার্বাক মতবাদ। বৌদ্ধ ও জৈনধর্মও নাস্তিক্যবাদী, কিন্তু সেখানে পুনর্জন্ম আছে। চার্বাকদর্শনে কোনো পুনর্জন্ম নেই, আত্মার অস্তিত্ব নেই, পরকাল-স্বর্গ-নরক-ইশ্বর নেই। ইহজগতেই সব লীলাখেলার সমাপ্তি। কৌতুহলোদ্দীপক, শ্লেষপূর্ণ, ৬০ টি শ্লোকে ক্ষেত্রবিশেষে স্থূল ইন্দ্রিয়সুখবাদী উদাহরণ দিয়ে এ দর্শন এ সব আস্তিক্য ধারণার অসারতা দেখিয়েছে। ঋণ করে ঘি খাওয়া -প্রবাদবাক্যটি চার্বাকদর্শন থেকে আগত। পুরো শ্লোকটি নিম্নরূপঃ

যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ
ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ।

যতদিন বাঁচবে সুখে বাঁচবে, প্রয়োজনে ঋণ করে ঘি খাও; মৃত্যুর পর ভস্মীভূত দেহের আর পুনরাগমন নেই।
গৌতম বুদ্ধ নিরীশ্বরবাদী হলেও তিনি চার্বাক দর্শনকে সমর্থন করেননি নৈতিকতার যুক্তিতে, কারণ চার্বাক দর্শন ঘোর ইন্দ্রিয়সুখপরায়ণ দর্শন। তা সত্বেও পূর্ণ নিরীশ্বরবাদী দর্শন রূপে এর গুরুত্ব প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে সর্বাপেক্ষা বেশি।

আর্যদের অপর শাখা যেটি ইরানে অবস্থান করে তাদের প্রাচীন ধর্ম জরথুস্ত্রবাদেও আত্মার প্রবল উপস্থিতি। পৃথিবী অমঙ্গল, মৃত্যুর অধিপতি আহিরমানের এলাকা। কিন্তু ইশ্বরের ধাতুতে গড়া আত্মাকে সে ছুঁতেও পারে না। মৃত্যুর পর যখন আত্মা দেহ ছেড়ে চলে যায়, তখন সে দলবল সহ দেহ অপবিত্র করে। তারপর বিভিন্ন পর্যায়ের পর আত্মার চূড়ান্ত বিচার ইশ্বর আহুর মাজদা করবেন। ভালদের পুনর্জীবনের মাধ্যমে চিরস্থায়ী স্বর্গের জীবন ও মন্দদের চিরস্থায়ী নরকের জীবন প্রদান করবেন।

চীনা সভ্যতায় আমরা প্রথম থেকেই বস্তুতপক্ষে প্রয়োগবাদ ( Pragmatism) ধর্মী দর্শনের সাক্ষাৎ পাই। বহিরাগত বৌদ্ধ ধর্ম ব্যতিরেকে আজও চীনে যে দুটি দর্শন তথা ধর্মরূপে স্বীকৃত মতবাদ পাই তা কনফুসিয়াস ও তাও (Tao) মতবাদ। কনফুসিয়াস যদিও অনেকবার প্রসঙ্গক্রমে স্বর্গের উল্লেখ করেছেন, তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে পরকাল, স্বর্গ বা নরক নেই। স্বর্গ এবং নরক মানুষের বুদ্ধিতে হৃদয়ঙ্গম করা অসম্ভব এবং প্রত্যেকের উচিৎ পৃথিবীতে সৎ ও সঠিক কাজ করা। বিপরীতে তাওবাদ যদিও পরকালে বিশ্বাস করে কিন্তু পরকালের ওপর জোর না দিয়ে বর্তমান জগতকে প্রাধান্য দেয়। তাওবাদে বলা হয় যে মানবদেহ ভূত, প্রেত, দানব কর্তৃক পূর্ণ। বিভিন্ন ক্রিয়াকর্মের মাধ্যমে এদের তাড়াতে হয়। মৃত্যুর পর আত্মার মৃত্যু নেই। সে পুনরায় জন্মগ্রহণ করে না, অন্য জীবনে অভিগমন করে। এই জন্মান্তর ‘তাও’ অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে। (তুলনীয় ভারতীয় দর্শনের মোক্ষ বা নির্বাণ)। কিন্তু জোরটি ইহজাগতিকতার পর তাওবাদেও।

রেনেসাঁ যে ইওরোপকে বদলে দিল তথা ফলশ্রুতিতে পৃথিবীকে বদলে দিল, বলা হয়  গ্রিক

সাহিত্য ও সভ্যতা সবচেয়ে বড় প্রভাব সে রেনেসাঁয় রেখেছে। তার মধ্যে হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসি বিশিষ্ঠ স্থান অধিকার করে আছে। যদিও হোমারের আবির্ভাব ও এ দুটি মহাকাব্যের সময় নিয়ে বিতর্ক আছে, মোটামুটিভাবে খ্রীস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দীতে লিখিত বলে জানা যায়। ইলিয়াড ও ওডিসিতে হোমার যে পরকালের ধারণা দিয়েছেন তা মেসোপটেমিয় অত্যন্ত নিরানন্দ পরিবেশের মতই। হোমারের কথিত জন্মস্থানও তুরস্কের আনাতোলিয়ার সন্নিকট আইয়োনিয়ায়। Psyche- আত্মার গ্রিক প্রতিশব্দ মৃত্যুর পর হেডিসে চলে গিয়ে ছায়া হিসেবে অবস্থান করে, তাদের কোন ব্যক্তিত্বও নেই, কথা বলতে পারে না। জীবিতরা তাদের ভুলে গেলে ছায়ারাও অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। প্রত্যেক মানুষেরই এটি সাধারণ ভাগ্য। এক শতক পর হেসিওডের ‘ Works and days’ এ চিত্রটি একটু আশাবাদী। মুষ্টিমেয় ভাগ্যবান কিছু যেমন থিবী ও ট্রয়ের যুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছে তারা মৃত্যুর পর স্বর্গীয় ভূমি Isle of Blest এ যাবে, যেখানে মৃত্যু নেই, যন্ত্রণা নেই দুঃখ নেই। ৬ষ্ঠ খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দীতে পিথাগোরাস আত্মা ও ভৌত বস্তুর মধ্যে পার্থক্য করেন। আত্মা নিজে চলাচল করতে পারে, দুটো স্থান একই সময় অবস্থান করতে পারে, ভৌত বস্তু পারে না। আত্মা এক দেহ থেকে অন্য দেহ বা প্রাণীতে অভিগমন করতে পারে। ভারতীয় ধারণা গ্রীসে এই প্রথম দেখা গেল।
প্লেটোর ( খ্রীস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দী) রচনায় সুস্পষ্ট ভাবে ভারতীয় দেহ- আত্মা ধারণার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। গ্রীসের অজস্র উপনিবেশ এশিয়া মাইনরের আধুনিক তুরস্কের আনাতোলিয়া উপকূল তথা তার সন্নিহিত অঞ্চলে ছিল। স্বাভাবিকভাবে ভাবের আদান প্রদান সহজে এ কারণে হয়েছে।প্লেটোর মতে আত্মা স্বর্গীয় সৃষ্টি।আত্মা অমর, চিরন্তন, সমস্ত আত্মা পূর্বে অন্যান্য দেহে ছিল। দেহের মৃত্যু আছে, সে আসে যায়। কিন্তু আত্মা অমর, মৃত্যুর পর সে অন্য দেহে প্রবেশ করে। দেহ- আত্মার দ্বৈততা প্লেটোর রচনায় গুরুত্বপূর্ণ।প্লেটো তাঁর ‘ Phaedo’ তে সক্রেটিসের মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে শিষ্যদের কাছে সক্রেটিসের শেষ কথোপকথনের বরাত দিয়ে যুক্তির সাহায্যে আত্মার অমরত্বের কথা তুলে ধরেন।পরবর্তীতে তাঁর ‘Republic’ এ প্লেটো আত্মার ধারণা কিছুটা পরিবর্তন করেন।সেখানে তিনি আত্মাকে দুটি উপাদানে ভাগ করেন, যৌক্তিক উপাদান যা উচ্চতর বিচার(Higher reason) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং অযৌক্তিক উপাদান যা জান্তব বাসনা (Animalistic appetites)দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।আত্মা বিশুদ্ধ বিচার(Pure reason) স্তরে অবস্থান করে পুনর্জন্ম চক্র থেকে মুক্তি পেতে পারে। এ যেন ভারতীয় মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ।
প্লেটোর শিষ্য এরিস্টটল তাঁর অন্যতম প্রধান রচনা (‘Peri Psyches’ – On the soul) য় আত্মা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে সব জীবন্ত সত্বা, যেমন গাছপালা, প্রাণীকূল সবার আত্মা আছে। আত্মা সমস্ত জীবন্ত সত্বার রূপ( form) বা মূল(Essence)। আত্মা দেহ থেকে পৃথক কোন বস্তু নয়। জীবন্ত বস্তু জীবন্ত হয় আত্মা থাকার কারণে। আত্মা মরণশীল।দেহাতিরিক্ত আত্মার অস্তিত্ব নেই। পরবর্তীতে এপিকিউরীয় ও স্টয়েক দর্শনও আত্মার মরণশীলতার কথা বলেছে।
গ্রীক চিন্তাধারায় পরকালে পাতাল- হেডিসে যাত্রা বা হেসিওডের মতে নির্বাচিত ভাগ্যবানদের গন্তব্য স্বর্গরাজ্য ‘Isle of Blest’ ধারণা মোটামুটি এপিকিউরাস (খ্রীঃপূঃ ৩৪১-২৭০) পর্যন্ত বহাল ছিল। যদিও তার পূর্বেই ডেমোক্রিটাস ও এটোমবাদীদের বস্তুবাদী ধারণা এসেছে। এপিকিউরীয় দর্শন যেন ভারতের চার্বাক দর্শনের প্রতিধ্বনি। মানুষের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত সুখানুসন্ধান। পার্থক্য এই যে চার্বাক দর্শন যেখানে ইন্দ্রিয়সুখকে প্রাধান্য দেয়, এপিকিউরীয় দর্শন সেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক সুখকে প্রাধান্য দেয়। এপিকিউরাস পরকালকে অস্বীকার করেন।তাঁর মতে আত্মা ভৌত বস্তু দিয়ে তৈরী এবং দৈহিক মৃত্যুর সাথে আত্মারও মৃত্যু ঘটে।পরকাল নেই, যদিও দেবতাদের
অস্তিত্ব তিনি স্বীকার করেন, তিনি বলেন যে দেবতারা পার্থিব জীবনে হস্তক্ষেপ করে না।এপিকিউরীয় দর্শন উজ্জ্বলভাবে খ্রীঃ পূঃ ১ম শতাব্দীতে লুক্রেসিয়াস( Lucretius) এর ‘ On the nature of things’ এ প্রতিফলিত। লুক্রেসিয়াসের মতে পৃথিবী এটম দিয়ে তৈরী।আত্মাও এটম ও পার্থিব বস্তু দিয়ে তৈরী। তিনি তার বইয়ের একটি অধ্যায় মৃত্যুভয় ও পরকালের অসারতা নিয়ে আলোচনা করেছেন।মানবাত্মা মানুষের ন্যায় মরণশীল। মৃত্যুর পর পাতালে(Underworld-Hades, দেবরাজ জিয়াসের ভ্রাতা হেডিসের রাজ্য) যাওয়ার বিশ্বাস মানুষের দুর্বলতা ও ভঙ্গুরতার মধ্যে প্রোথিত।

দুটি আব্রাহামীয় একেশ্বরবাদী ধর্ম- ইহুদিধর্ম ও খ্রীস্টধর্মে পরকাল সম্পর্কে ধারণায় মেসোপটেমিয় প্রভাব সুস্পষ্ট। প্রথম দিকে হিব্রুধর্মে বলা আছে যে আত্মা( Nepheth) হচ্ছে নিঃশ্বাস। এ জীবন নিঃশ্বাস মানব ও প্রাণীদেহে ইশ্বরের দান। দৈহিক মৃত্যুর পর আত্মাও মৃত্যুবরণ করে। ‘ মৃতরা ধূলির ন্যায় এবং ধূলিতে প্রত্যাবর্তন করে।‘ আত্মা ‘ Rephaim’ ছায়া আকারে চিরঅন্ধকার ভূমি ‘ শিওল’ এ ইশ্বর থেকে পৃথক হয়ে অবস্থান করে। জীবিতরা প্রয়োজনে এ সব ছায়াকে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য আহ্বান করতে পারে। পরবর্তীতে বিশেষতঃ ব্যাবিলনীয় নির্বাসনের পর নতুন করে তারা ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করে অনন্ত জীবন, পরকালের স্বীকৃতি, পুনরুত্থান,স্বর্গ- নরক ধারণা সংযোজন করে। যদিও স্যাডুসি সম্প্রদায় পরকাল, পুনরুত্থান অস্বীকার করে, তাদের প্রভাব হ্রাস পেলে প্রতিদ্বন্দ্বী ফারিজীদের পরকাল, পুনরুত্থান, শেষ বিচার, স্বর্গ নরক ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়।পুণ্যবানেরা পুনরুত্থান ও শেষ বিচারের পর স্বর্গ Gan Eden-ইডেন গার্ডেনে যায় এবং অভিশপ্তরা Gehenna- নরকে যায়।সেখানে যাদের পাপ ও পুণ্য মাত্রা সমান সমান তারা বিশুদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত ওপর নীচ ভাসতে থাকে।যাদের পাপের মাত্রা অপরিমার্জনীয় তারা চিরকাল গেহেনায় নরকযন্ত্রনা ভোগ করে।গেহেনাকে বলা যায় ‘ Purgatory’ – সংশোধনাগার।

প্রত্যক্ষভাবে ইহুদীধর্ম থেকে উদ্ভূত খ্রীস্টধর্ম আত্মা, পুনরুত্থান, পরকাল বিষয়ে সঙ্গতভাবে ইহুদীধর্ম দ্বারা প্রভাবিত।খ্রীস্টধর্মে পরকাল স্বীকৃত।মৃত্যুর পর দেহ সমাহিত বা দাহ যা করা হোক না কেন আত্মা বেঁচে থাকে। পরবর্তীতে ইশ্বর আত্মাকে পুনর্জীবিত করেন। যীশু বলেন’ আমিই পুনরুত্থান ও জীবন।যে আমাকে বিশ্বাস করবে সে বেঁচে থাকবে যদিও সে মৃত্যুবরণ করে।‘ মৃত্যুর পর ‘Breath of life’ জীবন নিঃশ্বাস যা ইশ্বর জীবের নাসিকায় প্রদান করেছিলেন, তা দেহত্যাগ করে এবং আত্মা ইশ্বরের নিকট প্রত্যাবর্তন করে।পুনরুত্থানে ইশ্বর দেহ ও আত্মাকে আবার একত্র করেন।মানুষ আবার জীবন্ত হয়।বাইবেলে স্বর্গ ও নরকের উল্লেখ থাকলেও বর্ণনা নেই। তবে চতুর্দশ শতাব্দীতে দান্তে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি তাঁর Divine comedy তে মনে হয় সব পুষিয়ে দিয়েছেন। অনেকের মতে স্বর্গ ও নরক নির্দিষ্ট স্থান নয়, প্রথমটি ইশ্বরের সাথে যুক্ত থাকা অবস্থা, দ্বিতীয়টি ইশ্বর থেকে নির্বাসিত হওয়া। মাত্র কিছুদিন আগে ক্যাথলিকধর্মের প্রধান পোপ ফ্রান্সিস নরকের অনস্তিত্বসূচক বক্তব্য দিয়ে বিশ্বাসীদের মধ্যে নিদারুণ সঙ্কট সৃষ্টি করেছেন।রোমান ক্যাথলিকরা সংশোধনাগার ‘Purgatory’ তে বিশ্বাস করে। এখানেই মৃত্যুর পর অধিকাংশ মানুষের অবস্থান, যা পাপ স্খালন ও স্বর্গে যাবার প্রস্তুতিকালের স্থান রূপে কাজ করে।
অবশ্য আব্রাহামীয় এ ধর্ম দুটিতে পুনরুত্থান থাকলেও আত্মার পুনর্জন্ম ও জন্মান্তর নেই। যদিও এদের কোন কোন গোষ্ঠীর মধ্যে জন্মান্তর স্বীকৃত। যেমন ইহুদিদের কাবালা সম্প্রদায় , খ্রীস্টানদের Unity Church জন্মান্তর স্বীকার করে।

খ্রীস্টান ধর্ম প্রসারের পর থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত দুজন খুব উল্লেখযোগ্য খ্রীস্টান ধর্মযাজক তথা ধর্মবেত্তা তথা দার্শনিক, যারা তাদের সময় থেকে পরবর্তী পশ্চিমা দর্শন তথা দার্শনিকদের গভীরভাবে প্রভাবান্বিত করেছেন, আধুনিক আলজেরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী সেণ্ট অগাস্টিন( ৩৫৪-৪৩০ খ্রীঃ) ও ইটালীয় সেণ্ট একুইনাস(১২২৫-১২৭৪ খ্রীঃ) , তারাও আত্মার অমরত্ব ও দেহের সাথে তার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেছেন। সেণ্ট অগাস্টিন প্লেটো ও নব্য প্লেটিয় দেহ আত্মা ধারণা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তবে প্লেটো যেখানে আত্মাকে অমর বলেছেন সেখানে অগাস্টিন তাঁর City of God এ আত্মাকে সৃষ্ট বলেছেন। তাঁর মতে দেহ ও আত্মা একটি ঐক্য(unity)।আত্মা সৃষ্ট কিন্তু অপার্থিব এবং তা ইশ্বরের প্রতিকৃতি (image)বহন করে। পাণ্ডিত্যবাদের প্রধান প্রবক্তা সেণ্ট একুইনাসের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনের একটি পদ্ধতি ছিল এরিস্টটলের বিভিন্ন মতবাদের সাথে খ্রীষ্টীয় শিক্ষা ও চার্চের কানুনের সাযুজ্য প্রদর্শন। আত্মা বিষয়ে এরিস্টটলের ধারণার সাথে তিনি খ্রীষ্টীয় ধারণা মেলাতে গিয়ে অসুবিধায় পড়েন, কারণ এরিস্টটলের মতে আত্মা মরণশীল, কিন্তু খ্রীষ্টীয় শিক্ষায় আত্মা অমর। তিনি তাঁর Summa Theologicaয় দার্শনিকের( এরিস্টটলকে তিনি সর্বত্র দার্শনিক বলে উল্লেখ করেছেন) যুক্তি আংশিক গ্রহণ করেন এটি স্বীকার করে যে আত্মা দেহের রূপ(Form)। তিনি চারটি যুক্তি দিয়ে পুনরুত্থানের মাধ্যমে দেহ আত্মার পুনর্মিলনের সাহায্যে আত্মার অবিনশ্বরতার খ্রীষ্টীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করেন।

ইওরোপীয় রেনেসাঁ ও তৎপরবর্তী প্রোটেস্ট্যাণ্ট ধর্মীয় সংস্কারের ফলশ্রুতিতে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে যে আলোকায়ন বা যুক্তির যুগ(Enlightenment or Age of reason) এল, সেখানে দেহ- আত্মা সম্পর্ক দেহ- মন নামে শুরু হয়। দেহ – মন দ্বৈততা নিয়ে গুরুগম্ভীর ও বিশদ দার্শনিক আলোচনা সূত্রপাত করেন আধুনিক পশ্চিমা দর্শনের জনক বলে স্বীকৃত ফরাসী দার্শনিক- গণিতবিদ রেনে দেকার্ত(১৫৫৬-১৬৫০)। কেন তিনি দেহ মন সম্পর্ক নিয়ে লিখতে বসলেন তা খুবই কৌতুহলোদ্দীপক। তা্ঁর Meditations on First Philosophy তে বলেন যে দেহ থেকে যে মন স্বতন্ত্র সত্তা তা দেখানোর কারণ ধর্মহীন লোকদের বোঝানো। এরা গাণিতিক প্রদর্শন ব্যতীত আত্মার অবিনশ্বরতা বিশ্বাস করতে চায় না। পরকালে ইশ্বর কর্তৃক ভাল কাজের পুরস্কারের ব্যবস্থা ও মন্দ কাজের শাস্তির ভয় ব্যতিরেকে এ সব লোক নৈতিক গুণের পথ অনুসরণ করবে না। দেকার্তের বিশ্বাস দেহ ও মন( আত্মা) সম্পর্কিত তাঁর যুক্তিগুলি এরা গ্রহণ করবে। তখন ধর্মহীন লোকেরা পরকালে আস্থা স্থাপন করবে।তাঁর বিখ্যাত তথা প্রচণ্ড সমালোচিত উক্তি’ Cogito ergo sum’- আমি চিন্তা করি, এজন্যই আমার অস্তিত্ব। দেহ – মনের এই দ্বৈততায় দেহ ব্যতিরেকে মনের/ আত্মার অস্তিত্ব আছে। প্রায় তাঁর সমসাময়িক হল্যাণ্ডের স্পিনোজা(১৬৩২-১৬৭৭) হাজির করেন তাঁর অদ্বৈতবাদ( Monism)। একটু পর দার্শনিক তথা পৃথকভাবে কিন্তু একই সময়ে নিউটনের সাথে ইণ্টিগ্রাল ও ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাসের জনক লিবনিজও ( ১৬৪৬-১৭১৬) অদ্বৈতবাদ দর্শন প্রচার করেন। অনেক আগে ভারতে বৈদিক যুগ থেকে উদ্ভূত হয়ে এ তত্ব আদি শঙ্করের (৮ম- ৯ম শতাব্দী)বেদান্ত অদ্বৈতবাদে পূর্ণতা পায়। ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত সত্তা এক মূলসত্তার (ইশ্বর) প্রকাশ মাত্র। অন্যদিকে একই আলোকায়ন ও ভৌত বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে ইওরোপে ষোড়শ শতাব্দী থেকে জড়বাদের ধারণাও বিকশিত হতে থাকে। জড়বাদ ব্স্তু অতিরিক্ত কোন চেতনা, মন বা আত্মাকে স্বীকার করে না। মানুষের চেতনা বা মানসিক কার্যাবলী দৈহিক ভৌত প্রক্রিয়ার উপজাত। দেহাতিরিক্ত কোন চেতনা বা মনের অস্তিত্ব নেই। বহু পুরাতন ভারতীয় চার্বাক দর্শনও এ বক্তব্য দিয়েছিল।

দেহ -মনের দ্বৈততা বা অদ্বৈত তত্বের আধুনিক ইওরোপীয় প্রবক্তারা আত্মার অবিনশ্বরতা, পরকাল সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা পোষণ করলেও মোটামুটি সবাই মনের (আত্মার) একধরণের অতীন্দ্রিয় ধারণার সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু ভৌত বিজ্ঞানের ক্রমাগত উন্নতি, ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ব, স্নায়ুবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি ও সর্বশেষ পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের আবিস্কার সিঙ্গুলারিটি ও বিগ ব্যাঙ তত্ব অতীন্দ্রিয় মনের ধারণাকে ধূসর ও বিবর্ণ করে দিয়েছে। তা সত্বেও পৃথিবীতে পরকাল ও আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসী মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ। যদিও যে কোন পূর্ববর্তী সময়ের চাইতে পৃথিবীতে এখন পরকাল ও আত্মার/ মনের স্বাধীন অস্তিত্বে আস্থাহীন ও সন্দেহবাদী মানুষের অনুপাত বেশি। যত মানুষ সত্যিকার বিজ্ঞানমনস্ক হবে ততই এ অনুপাত বাড়তে থাকবে।

কিন্তু বিশাল এ বিশ্বে অকিঞ্চিৎকর, ক্ষণস্থায়ী, অনিশ্চিত, সঙ্কটসঙ্কুল পার্থিব জীবন একধরণের আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানে তাকে ব্যাপৃত রাখে। একজন স্নায়ু বিজ্ঞানী বা একজন স্নায়ুশল্যচিকিৎসক যিনি এইমাত্র চেতনানাশক দিয়ে মস্তিস্কের কার্যাবলী পরিবর্তন করে রোগীর মানসিক ক্ষমতাকে সাময়িক স্তব্ধ করে দিয়ে অস্ত্রোপচার করলেন, অথবা তিনি নিশ্চিত জানেন যে মস্তিস্কের বিভিন্ন অংশ মানুষের চেতনার বিশেষ বিশেষ অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে, অর্থাৎ মানুষের মনন বা চিন্তাশক্তি মস্তিস্ক কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত, যা মনের/ আত্মার স্বাধীন সত্তাকে ভুল প্রমাণিত করে তিনিও হয়ত সন্ধ্যায় বা সকালে পিতৃপুরুষের আত্মার মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করছেন। ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে/ আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে’।

তবে এ প্রশ্নে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে সেইসব বিজ্ঞানী ও নিরীশ্বরবাদীরা যারা মনে করেন দেহাতিরিক্ত কোন আত্মা/মন নেই, পরকাল নেই এবং কোন অতীন্দ্রিয় সত্বাও নেই। তারা নির্ভার।কিন্তু জাগতিক সঙ্কটে তাদের নিজেদের বস্তুগত ও মানসিক চাপ সহ্য করতে হয়। দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন তারা যাদের নির্দিষ্ট সৃ্ষ্টিকর্তা বা দেবতা আছেন। পরকালে তারা কর্মফল অনুযায়ী কোথায় থাকবেন, এ অনিশ্চয়তায় ভোগেন।তবে জাগতিক সঙ্কটে বহুক্ষেত্রে তারা তাদের আরাধ্য সৃষ্টিকর্তা বা দেবতাদের ওপর অন্ততঃ মানসিক ভারার্পণ করতে পারেন। সর্বাপেক্ষা মানসিক চাপে থাকেন যারা সন্দেহবাদী ও অজ্ঞেয়বাদী। তাদের কোথাও ভারার্পণের স্থান নেই, সব দায় দায়িত্ব নিজকে বহন করতে হয়।

আধ্যাত্মিকতার প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে গড়েছেন, ভেঙ্গেছেন, গড়েছেন। শুধু একটি কথা বলে শেষ করি। মৃত্যুর আড়াই মাস আগে ‘শেষ লেখা’র একটি কবিতায় বলেন ‘রূপনারানের কূলে জেগে উঠিলাম, জানিলাম এ জগৎ স্বপ্ন নয়’। অদ্বৈতবাদের মায়াবাদকে প্রত্যাখ্যান করছেন স্পষ্টভাবে। বাস্তব এ জগত, মায়া নয়, স্বপ্ন নয়।
একই কবিতার শেষে বলেন—

‘আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন, সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে, মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে’।

স্পষ্ট করে বলছেন সমস্ত দেনাই মৃত্যুতে সমাপ্ত। আর কারও কাছে কোনো দায় থাকে না। পরকালের গুরুত্ব আর থাকে না। কিন্তু মৃত্যুর দশ দিন আগে বস্তুত যখন তিনি দিন গুনছেন—

‘এখন জীবন মরণ দুদিক থেকে নেবে আমায় টানি’ –সে সন্ধিক্ষণে বাস্তব এ জগতে সত্তার স্বরূপ সম্পর্কে তাঁর অনন্ত জিজ্ঞাসা রেখে গেলেন নীচে উদ্ধৃত কবিতায়। মুখচ্ছবির তরুণ বন্ধুদের জন্য পুরো কবিতাটি তুলে দিলুম:

প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে–
কে তুমি,
মেলেনি উত্তর।
বৎসর বৎসর চলে গেল,
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম সাগর তীরে,
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়–
কে তুমি,
পেল না উত্তর।

সুতরাং, অজ্ঞেয়বাদী ‘পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে’ এ জিজ্ঞাসা মানুষকে তাড়িত করতেই থাকবে।
রবীন্দ্রনাথের পুণ্য জন্মতিথি তথা বিশ্বদরবারে বাঙ্গালী পরিচয়ের স্বীকৃতির জন্মতিথি সমাগত। তাঁর পুণ্যস্মৃতির প্রতি জানাই আমার সশ্রদ্ধ আভূমি প্রণতি। রবীন্দ্রভাবনা আমাদের ঋদ্ধ করুক, ‘সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে’ পথ দেখাক, বাঙ্গালী রবীন্দ্রচেতনায় উজ্জীবিত হয়ে উঠুক।

পুনশ্চঃ মুখচ্ছবি বন্ধুরা আমার এ পণ্ডশ্রম পড়বেন, ভরসা কম, যদিও কি যেন বলে, ‘ লাইক’ সাথে সাথে চলে আসে। তবু এটি চক্ষুর ওপর নিপীড়ন মাত্র। কর্ণকুহরে আমার বেসুরো কর্কশ কণ্ঠ শোনার আগেভাগে সাবধান করে দিই। ব্রিটিশ কমন ল তে একটি ধারা আছে, নাম Caveat Emptor–ক্রেতা সাবধান। অর্থাৎ বেচাকেনায় ক্রয় সম্পাদনের পর দায় ক্রেতার। কেনার আগে বাপু বুঝে শুনে কেনো। আমিও এর প্রতিধ্বনি করে এখন শ্রোতৃমণ্ডলীকে বলি Cave Audientibus! শ্রোতা সাবধান! শুনলে দায়দায়িত্ব এই বদকণ্ঠ মালিকের নয়।


দিলীপ কুমার নাথ

ভূতপূর্ব অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

https://www.facebook.com/dilip.kumarnath.399/videos/206307146764842/