Headlines

প্রত্যেকটা রোগী মৃত্যুর তদন্ত করবে বিএমএ ও বিএমডিসি – ডা. বাহারুল আলম

ডা. বাহারুল আলম বিএমএ

কেবল ০.১% বাজেট বৃদ্ধি রোগী ও চিকিৎসকদের প্রতি চরম অবজ্ঞা। এ অবহেলা অনেক রোগীর মৃত্যুকে তরান্বিত করবে। দায় কার? রাষ্ট্রের নাকি চিকিৎসকের ? আগামীতে রাষ্ট্রের অবহেলা-জনিত কারণে রোগীর মৃত্যুতে বিএমএ ও বিএমডিসি তদন্ত করে সত্য উদ্ঘাটন করবে।


বিগত অর্থ বছরের তুলনায় ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ঘোষিত বাজেটের কলেবর বৃদ্ধিসহ উন্নয়ন ও প্রযুক্তি খাতে বিপুল অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। উন্নয়নের রোডম্যাপে এ বাজেট নাগরিকদের স্বাপ্নিক করে তুলবে।

কেবল বরাদ্দ বাড়েনি স্বাস্থ্য খাতে । বিগত বছরের তুলনায় এ খাতে ০.১ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে । চলমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এতটাই ভঙ্গুর ও অক্ষম যে রোগীরা নিজ ব্যয়ে প্রায় শতভাগ ঔষধপত্র ও উপকরণ সরবরাহ করেই চিকিৎসা নেয়। বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা কোন স্তরে একজন রোগীরও পুর্ণাঙ্গ চিকিৎসা করার ক্ষমতা রাখে না। যে কোন দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার এ অক্ষমতার চিত্র স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে রোগীরা বিপুল অর্থ ব্যয়ে বাইরে থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিয়ে আসে। যন্ত্র, টেকনোলজিস্ট ও বিশেষজ্ঞে চিকিৎসকের পদ প্রয়োজনের তুলনায় কম। অবকাঠামো বা স্থান সংকুলানের অভাবে ৮০% রোগীদের অস্বাস্থ্যকর, নোংরা মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। হাসপাতালের শয্যার স্বপ্ন দেখতে দেখতে এক পর্যায়ে সেখানেই মৃত্যু বরণ করে।

হাসপাতালের বহির্বিভাগের রোগীদের জন্য কোন ঔষধ বরাদ্দ নাই, তারা রোগ নির্ণয়ের সুযোগও পায় না। জেলা হাসপাতাল ও কোন কোন মেডিকেল কলেজে মুমূর্ষু রোগীদের জীবন রক্ষার জন্য আইসিইউ, সিসিইউ ও দুর্ঘটনা কবলিত রোগীদের জন্য ক্যাজুয়ালটি ইউনিট গড়ে না ওঠার ফলে চিকিৎসায় চরম নৈরাজ্য ও ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। একইভাবে ব্রেইন (নিউরো) , কিডনি (নেফ্রো) , লিভার (হেপাটো) , হৃৎপিণ্ড (কার্ডিয়াক) ও হাড় জোড় (অর্থো)- মানব শরীরের এ সকল মৌলিক অর্গান সমূহের চিকিৎসা ব্যবস্থা জেলা হাসপাতাল থেকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পর্যন্ত কোথাও পুর্ণাঙ্গভাবে গড়ে ওঠেনি।

হাসপাতালে খাবার সরবরাহ, পয় ও বর্জ্য নিষ্কাশন, পানি সরবরাহ, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অনিয়মিত ও নিম্নমানের। এ্যাম্বুলেন্স সহ হাসপাতালে জরুরি প্রয়োজনে চিকিৎসকদের আসা যাওয়ার জন্য কোথাও কোন গাড়ি বরাদ্দ নাই। ইউনিয়ন সাব-সেন্টার থেকে উপজেলা পর্যন্ত ভবন, যন্ত্রপাতি, ঔষধপত্রের বিপুল ঘাটতি, জরুরি বিভাগে জরুরি চিকিৎসার জন্য কিছুই নাই। এ হল রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অতি সংক্ষিপ্ত চালচিত্র। ঔষধপত্র সহ চিকিৎসার উপকরণের অভাব, জনবল ও যন্ত্রপাতির অনুপস্থিতি ছাড়া ব্যবস্থাপনার আর কোন বৈচিত্র্য নাই।

রাষ্ট্রে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তার জনগণ। চিকিৎসা পাওয়া তাদের মৌলিক অধিকার এবং চিকিৎসা দিতে রাষ্ট্র দায়বদ্ধ। চরম অবহেলা, অবজ্ঞায় এ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা দিয়ে রাষ্ট্র কীভাবে তার নাগরিকদের চিকিৎসার দায় পালন করবে? খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আমলারাও এ বিবেকের দংশন অনুভব করবে না তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। অথচ উন্নয়নের রোডম্যাপ প্রণেতারা (অর্থমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী) নাগরিকদের চিকিৎসার দায় ভুলে গেছে। চিকিৎসক-সহ স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর এ দায় চাপিয়ে ৪৬ বছর পার করেছে।

রাষ্ট্র এ ভঙ্গুর ও দুর্বল ব্যবস্থাপনা হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের। যেখানে রোগীর নিজ অর্থ ব্যয় ছাড়া পুর্ণাঙ্গ রূপে কোন চিকিৎসা দেওয়াই সম্ভব নয়। এ ব্যবস্থাপনায় রোগীরা নিরাপদ নয় এবং চিকিৎসার অভাবে ও অবহেলায় মৃত্যুবরণ করে, দায়ী করা হয় চিকিৎসকদের । রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ/স্বাস্থ্য বিষয়ক মন্ত্রণালয় আড়ালে থেকে যায় । আমলাতন্ত্রের সেই স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তের ফসল, চলমান অর্থ বছরের অপ্রতুল স্বাস্থ্য বাজেট।

বর্ণিত এ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিগত বাজেটই অপ্রতুল ছিল । এর মধ্যে রোগী বেড়েছে, চিকিৎসার চাহিদা বেড়েছে কয়েক গুণ । বিশ্বময় চিকিৎসা আধুনিক হওয়াতে রোগীদের মনস্তাত্ত্বিক জগতে তার চাহিদা বেড়েছে যা ব্যয়বহুল। মাত্র ০.১% বৃদ্ধি দিয়ে আমলারা জনগণের প্রতি যে অবজ্ঞা ও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করল তা করুণ ও লোমহর্ষক ।

জনগণের জীবন ও মৃত্যু নিয়ে রাষ্ট্রের আমলাদের এই ছেলেখেলা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। অপ্রতুল বাজেটের কারণে সক্ষমতাহীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় যে রোগীদের মৃত্যু ঘটবে তার দায় বাজেট প্রণেতাদের উপর বর্তাবে। আমলাতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রের কুচক্রী মহল এ দায় চিকিৎসকদের ঘাড়ে চাপিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে।

প্রতিবারের ন্যায় এ অর্থবছরে ষড়যন্ত্রের বিষদাঁত উপড়ে ফেলা হবে বিএমএ-র নেতৃত্বে । প্রত্যেকটা রোগী মৃত্যুর তদন্ত করবে বিএমএ ও বিএমডিসি। অপ্রতুল বাজেটের কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অভিযুক্ত করবে জনগণের আদালতে/ উচ্চ আদালতে । বিএমএ সত্য উদ্ঘাটনে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করবে হাসপাতালে রোগী মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা না চিকিৎসক!

রাষ্ট্রের এ অব্যবস্থার কারণে চিকিৎসা শিক্ষা, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার উপর ভিত্তি করে বেসরকারি পর্যায়ে বিশাল স্বাস্থ্যখাত গড়ে উঠেছে। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা রোগীদের কাছে আস্থাশীল না হওয়ায় নাগরিকদের বড় অংশ এ খাত থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করে। নাগরিকদের প্রয়োজনে বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের আধুনিকায়ন ও উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত রাষ্ট্রীয় বাজেটের প্রয়োজন।

বহু চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী বেসরকারি পর্যায়ে কর্মরত আছে। অথচ এর উন্নয়নের জন্য কোন বাজেট বরাদ্দ নাই। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনা যেখানে ঘাটতি বাজেটে ভুগছে সেখানে বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে বাজেটের কথা ভাবা মরীচিকা মাত্র।

ফলে ব্যাঙের ছাতার মত অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলায় মানহীন ব্যবস্থাপনা নিয়ে গড়ে উঠেছে। বাজেটে এদের মান উন্নয়নে যেমন অর্থ বরাদ্দ নাই, নিয়ন্ত্রণেও সুষ্ঠু সঠিক কোন ব্যবস্থা না করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা এ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। অথচ নিম্নমানের ব্যবস্থাপনার কারণে রোগীর মৃত্যু হলে সকল দায় বর্তায় চিকিৎসকদের উপর।

বাজেটহীন বেসরকারি খাত দখল করার জন্য কর্পোরেট পূঁজি থাবা বসিয়েছে। সে থাবায় রোগীরা ক্ষত বিক্ষত, চিকিৎসকরা অসহায়। বেসরকারি স্বাস্থ্যখাত উন্নয়নে রাষ্ট্রের কোন বাজেট না থাকায় কর্পোরেট পুঁজি-ওয়ালাদের স্বর্গ রাজ্যে পরিণত হয়েছে। এদের কাছে চিকিৎসকরা অসহায় ও ক্রীতদাস । এরাই রোগীদের রক্ত চুষে খাচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও আমলাদের চোখের সামনে। এর জন্য দায়ী রাষ্ট্র।


ডা. বাহারুল আলম