দেশের সামগ্রিক উন্নতিতে এখন প্রয়োজন বিকাশমান গ্রামীণ অর্থনীতি

গ্রামীণ অর্থনীতি

স্বাধীনতার পর পর অজপাড়াগাঁ বলতে যা বোঝাত সে বাংলাদেশ এখন আর নেই। গ্রামীণ রাস্তা বলতেই এক সময় বোঝাতো কাঁচা রাস্তা, তবে সে বাস্তবতা এখন অতীত। দুর্গম, এমনকী উপকূলীয় অঞ্চলের গ্রামও এখন পাকা সড়ক দিয়ে সংযুক্ত হয়েছে শহরের সঙ্গে। মাত্র এক দশক আগেও অধিকাংশ গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না, এখন সেসব গ্রামে বিদ্যুতের আলো ঝলমল করে। কোনো কোনো গ্রামে চিঠি, টেলিগ্রাম বা মানি অর্ডার পৌঁছাতে লেগে যেত এক সপ্তাহ থেকে এক মাস, সেসব গ্রাম এখন মোবাইল ফোনের আওতায়, কোনো না কোনোভাবে ব্যাংকিং ব্যবস্থাও পৌঁছে গেছে দোড়গোড়ায়। গ্রামের মানুষ এখন প্রয়োজনীয় কথা সারছে মোবাইলে, টাকা লেনদেন করছে মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে। পরিবর্তন আসছে গ্রামীণ অবকাঠামোতেও— মানুষের ঘর এখন আধা পাকা বা পাকা হচ্ছে। পরিবর্তন আসছে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যে। গ্রামেও এখন প্রায় প্রতি বাড়িতেই রয়েছে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের ব্যবস্থা। কলেরা বসন্তের মতো মহামারী বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিয়েছে। আগে যেখানে গ্রামাঞ্চলে হাঁটা পথে কিংবা নৌকা ছাড়া বর্ষাকালে কোথাও যাওয়ার ব্যবস্থা ছিলো না। সেসব পথে এখন সারাক্ষণ চলছে অটোবাইক, ইজিবাইক ইত্যাদি। গ্রামে কমেছে বাল্যবিবাহ, বাড়ছে শিক্ষার হার। গ্রামের মানুষ এখন কৃষিকাজ থেকে কৃষিভিত্তিক শিল্পের দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করেছে। তবে এর একটা উল্টোপিঠও আছে। বিশ্বায়ন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সুযোগে গ্রামেও এখন পৌঁছে যাচ্ছে নানান ধরনের বাহারী পণ্য— তা যেমন খাদ্যসামগ্রী, প্রসাধন সামগ্রী এবং ইলেকট্রনিক পণ্য। যা গ্রামের মানুষের বুঝে না বুঝে ক্রয় করছে, ফলে এদিক থেকে গ্রামীণ অর্থনীতি দুর্বল হচ্ছে। গ্রামে রয়েছে তুলনামূলকভাবে স্বস্তা শ্রম, যে সুযোগে গ্রামেই গড়ে উঠতে পারে রপ্তানীমুখী কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা এবং নানান ধরনের কুটিরশিল্প। এজন্য দেশের গ্রামগুলোকে কেন্দ্র করে একটি মহাপরিকল্পনা সাজানোর প্রয়োজন রয়েছে।
গ্রাম প্রধান বাংলাদেশের অর্থনীতির রূপান্তর গ্রামকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের সময় নব্বই শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করত। নব্বই সাল পর্যন্তও আশি শতাংশের অধিক মানুষ গ্রামে বাস করত। মূলত এরপর থেকেই শহওে জনস্রোত কিছুটা বাড়তে থাকে। বর্তমানে ষাট শতাংশের বেশি মানুষ গ্রামে বাস করে। একসময় বাংলাদেশের গ্রামগুলো ছিলো খুবই অনুন্নত— পাকা রাস্তাঘাট ছিলো না, ছিলো না বৈদ্যুতিক সংযোগ। সেই তুলনায় গ্রাম এখন অনেক উন্নত। ২১ মার্চ (২০২২) প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় এসেছে। এটা বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল অর্জন। পাকা রাস্তা, শহরের সাথে সংযোগ সড়ক, বৈদ্যুতিক সংযোগ এবং ইন্টারনেট সুবিধা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের গ্রামগুলো এখন হয়ে উঠতে পারে এক একটি আদর্শ গ্রাম। গ্রামের তরুণ সমাজকে সুপরিকল্পিতভাবে গ্রামে রেখেই অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারলে মানুষ তার নিজ শেকড়ে থেকেই উৎপাদনমুখী এবং উপার্জনমুখী হয়ে উঠতে পারবে।
সত্তরের দশকের শেষ ভাগে বিভিন্ন গবেষণাপত্র থেকে বাংলাদেশের গ্রামগুলোর এক করুণ চিত্র উঠে আসে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, ওই সময়টায় দেশের ৮০ শতাংশ মানুষই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছিলো। দারিদ্র্যের কশাঘাতে সবচেয়ে বেশি জর্জরিত ছিল গ্রামবাসী। একদিকে তাদের ঘরে খাবার ছিল না, পরিবারের আকার ছিল বড়, শিশুমৃত্যু হার ছিল উচ্চ, সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল ছিলো খুবই কম। সুপেয় পানি ও নির্ভরযোগ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ ছিল না বললেই চলে। অন্যদিকে আয়ের জন্য তারা প্রায় এককভাবে প্রাচীন পদ্ধতির কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল ছিলো। দুর্বল কৃষি খাতের কারণে তাদের অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির সম্ভাবনাও ছিল ক্ষীণ। গত দু-তিন দশকে এদেশের গ্রামগুলোতে নাটকীয় ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। এ পরিবর্তনে সরকারের পাশাপাশি অবদান রয়েছে দাতাগোষ্ঠীর। এখন পরিস্থিতির যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে। দারিদ্র্যের হার আগের তুলনায় চার ভাগের এক ভাগে নামিয়ে আনা গিয়েছে (২০ শতাংশের আশেপাশে), কৃষি উৎপাদন বহুগুণে বেড়েছে, কৃষি শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে পাঁচ থেকে দশ গুণ, বিদ্যুৎ সংযোগ, সেলফোনের সহজলভ্যতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ বৃদ্ধির ফলে গ্রামীণ জীবনমান বেড়েছে।
গ্রামে এখন কৃষিখাতের বাইরেও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। গড়ে উঠছে ছোট ছোট মিল কলকারখানা। গ্রামীণ আয়ের একটি অংশ এখন আসছে অকৃষি খাত থেকে। অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতরে গ্রামীণ অর্থনীতির স্বনির্ভরতা রয়েছে বলেই করোনা মহামারীকালেও বাংলাদেশের অর্থনীতি অন্য অনেক উন্নয়নশীল এমনকি উন্নত দেশের চেয়েও ভালো করছে। করোনায় গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষই নাকাল হয়েছে বেশি। কেননা শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বড় অংশই জীবিকার জন্য অনানুষ্ঠানিক খাতের ওপর নির্ভরশীল। আর মহামারীর আঘাতটা শহরের শ্রমনির্ভর খাতগুলোতেই বেশি করে পড়েছে। আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত গ্রামগুলোই হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির তুড়ুপের তাস।

রেমিটেন্সের অবদান

গ্রামগুলোর উন্নতিতে প্রভূত অবদান রাখছে রেমিটেন্স। এছাড়া বিদেশ ফেরত মানুষেরা দেশে এসে গ্রামগুলোতে নতুন নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে, এর ফলেও গ্রামের অর্থনীতিতে নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। বিদেশ থেকে গ্রামের মানুষের হাতে রেমিট্যান্স আসায় বাড়ছে গ্রামের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। এককালের খড় এবং বাঁশের নড়বড়ে ঘরগুলো হয়ে উঠছে পাকা ভবন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় লক্ষীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার কেরোয়া ইউনিয়নের মোল্লার হাট গ্রামের কথা। এ গ্রামের বাসিন্দা হাফিজউদ্দিন ১৯৯৮ সালে কুয়েত যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তার ভাই আবদুল হামিদ ভূইয়ার মাধ্যমে। ভিসা পেয়েছিলেন বিনামূল্যে। বিদেশে পাড়ি জমাতে শুধু বিমান ভাড়া দিতে হয়েছিলো তার। ২০০৭ সাল অবধি কুয়েতে ব্যবসা করেছেন হাফিজ। এরপর দেশে ফিরে আবার ব্যবসা শুরু করেন। মোল্লারহাটে নিজে পাকা বাড়ি গড়েছেন। একে একে তার সাত ভাই বিদেশে গেছেন। সবাই পাকা বাড়ি করেছেন। ভূইয়া বাড়িতে এখন সাতটি পাকা ঘর। গ্রামের আরেকজন সেলিম মিয়াজী সৌদি আরবে ব্যবসা করেন ১২ বছর ধরে। স্ত্রী খালেদা আক্তার সুমা আর তিন সন্তান দেশেই থাকেন। মোল্লারহাট বাজারের কাছে নিজে একটি সুন্দর ডিজাইনের বাড়ি করেছেন। বাবা-মায়ের জন্য করে দিয়েছেন আরেকটি বাড়ি। পাশের বাড়ির এক ব্যক্তির মাধ্যমে প্রথমে মালয়েশিয়া যান সেলিম। এরপর যান সৌদি আরব। সেই সময় তার যেতে খরচ হয়েছিল মাত্র ৩০ হাজার টাকা। বহু কষ্টে ওই টাকা যোগাড় করলেও এখন তিনি বিপুল অর্থের মালিক। গ্রামে অধিকাংশ বাড়ি এখন পাকা। গ্রামের মোল্লা বাড়িতে ১১টি, মিয়াজী বাড়িতে ১৩টি, পন্ডিত বাড়িতে ৯টি, ভূইয়া বাড়িতে ৭টি, সুকানি বাড়িতে ১০টি, দেওয়ান বাড়িতে ১২টি পাকা ঘর উঠেছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসেছে নলকূপ। ঘরে ঘরে রঙিন টেলিভিশন। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে গ্রামে। এ গ্রামের সহস্রাধিক মানুষ বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। এর মধ্যে আছে সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান, দুবাই, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর। এ উপজেলার ইউনিয়নগুলোর মধ্যে কেরোয়ায় বিদেশে থাকা মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। রায়পুর এবং আশেপাশের গ্রামের প্রবাসীদের টাকা দেশে আসে ব্যাংকের মাধ্যমে। সবচেয়ে বেশি টাকা আসে ইসলামী ব্যাংক রায়পুর শাখায়। ওই শাখার ম্যানেজার অপারেশন্স মো. হাফিজুর রহমান জানান, গত এক বছরে রায়পুরে রেমিটেন্স এসেছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। রায়পুরের মতো গ্রাম খুব বেশি না হলেও প্রবাসীদের রেমিট্যান্সই গ্রাম উন্নয়নে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে একথা নি:সন্দেহে বলা যায়।
গত এক দশকে সরকারের গ্রামবান্ধব নীতি ও সেগুলোর বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের প্রায় সব গ্রাম এখন নগরের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছে। একই সঙ্গে মানুষের নিজেদের উদ্যোগ, সামাজিক পুঁজির প্রয়োগ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্রিয়তার কথা উল্লেখযোগ্য। গ্রামের উন্নয়নে ব্যক্তিখাতেরও অবদান রয়েছে— চায়ের দোকান, কফিশপ, রেস্তোরাঁ, সেলুন, বিউটি পার্লার, কিন্ডারগার্টেন স্কুল, কোচিং সেন্টার, হেলথ ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সাইবার ক্যাফের উপস্থিতি এখন গ্রামাঞ্চলেও দৃশ্যমান। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মাথাপিছু কৃষিজমির পরিমাণ কমেছে ঠিকই, কিন্তু সেবা খাতের ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে অকৃষি কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে তা পুষিয়ে যাচ্ছে। তবে একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, কৃষি এবং কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিই বাংলাদেশের গ্রামগুলোর প্রাণ। কৃষিভিত্তিক শিল্প এবং কলকারখানা গড়ে তোলার দিকেই সরকারি এবং বেসরকারি খাতকে মনোযোগী হতে হবে। পুঁজিবাদী এবং কোম্পানি অর্থনীতির ধাক্কায় গ্রামেও এখন অপ্রয়োজনীয় পণ্যের প্রসার ঘটছে বেসামালভাবে, বেরিয়ে যাচ্ছে গ্রামের মানুষের কষ্টে উপার্জিত টাকা। সে তুলনায় প্রয়োজনীয় আইটি খাতের প্রসার ঘটছে না গ্রামে। পরিসংখ্যান বলছে, এখন গ্রামীণ আয়ের ৬০ শতাংশ আসে অকৃষি খাত থেকে। যার মধ্যে রেমিট্যান্সই আসলে বেশি। অকৃষি খাতের প্রসারের চেয়ে গ্রামে এখন প্রয়োজন কৃষিবান্ধব অকৃষি খাতে প্রণোদনা, পাশাপাশি গ্রামের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন, বিশেষ করে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর আধুনিকীয়ান এখন সময়ের দাবী।

মাইক্রো ফিন্যান্স

মাইক্রো ফিন্যান্স বা মাইক্রো ইন্স্যুরেন্স নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে, অনেক প্রতিষ্ঠান এটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সরকারিভাবেও মাইক্রো ফিন্যান্সের ব্যবস্থা রয়েছে। পাশাপাশি প্রতি বছর গ্রামাঞ্চলের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, সুপেয় পানি ও পয়োনিষ্কাশন, পরিবার পরিকল্পনা ও আইনি সেবা পাচ্ছে মাইক্রো ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে, যেসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা এনজিও হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি। গ্রামীণ অর্থনীতিতে মাইক্রো ফাইন্যান্সের ইতিবাচক প্রভাব সাম্প্রতিক কিছু পরিসংখ্যান থেকেই পাওয়া সম্ভব। সমুন্নয় পরিচালিত ২০১৮ সালের জরিপ থেকে দেখা যায়, মাইক্রো ফাইন্যান্স সেবা গ্রহণ করেছে এমন পরিবারগুলোর আয় ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল সময়কালে বেড়েছে ৬১ শতাংশ, অথচ এ সেবা গ্রহণ করেনি এমন সমতুল্য পরিবারগুলোর আয় বেড়েছে ৪২ শতাংশ। ভোগের ক্ষেত্রেও যারা মাইক্রো ফাইন্যান্স সেবা পেয়েছে, তারা এগিয়ে আছে ৯ শতাংশ। আর ভোগব্যয় বৃদ্ধির ইতিবাচক প্রভাব কেবল গ্রামীণ অর্থনীতিতে পড়েছে এমন নয়, বরং অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির ফলে পুরো দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভিত্তিই আরো মজবুত হয়েছে। তবে গ্রামাঞ্চলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এখন আর শুধু মাইক্রো ফাইন্যান্সেই আটকে নেই। মূলধারার ব্যাংকিং সেবাও গত এক দশকে গ্রামীণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে সাম্প্রতিক দশকে পরিচালিত ব্যাপকভিত্তিক আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অভিযানে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী এবং সচরাচর আনুষ্ঠানিক আর্থিক সেবার বাইরে থাকা নাগরিকদের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়াকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সামাজিক পিরামিডের পাটাতনে থাকারাও যেন সহজে ব্যাংকিং সেবা পান, সেজন্য এ সময়ে প্রায় ২ কোটি ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে, কৃষিঋণের সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে ১৩০ শতাংশ, বর্গাচাষীদের জন্য বিশেষ ঋণ প্রকল্পের আওতায় ১৬ লাখ কৃষিজীবীকে ঋণ দেয়া হয়েছে (যাদের মধ্যে বড় অংশটিই নারী)। অকৃষি খাতকে সহায়তার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে স্বতন্ত্র এসএমই বিভাগ খোলা হয়েছে, দেওয়া হয়েছে সুবিবেচনাভিত্তিক এসএমই অর্থায়নের গাইডলাইন। এসএমই অর্থায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর নির্দেশনা ও তদারকির ফলে ২০১০ থেকে ২০১৭ সময়কালে ৪৫ লাখ এসএমইকে প্রায় ৯৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গ্রামের খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কাছে গেছে, ফলে সেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, কমেছে কৃষির ওপর নির্ভরতা। এছাড়া সিএমএসএমই ঋণের ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাকে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় এ সময়ে চার লাখের বেশি নারী উদ্যোক্তা পেয়েছেন ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ। এসবের পাশাপাশি জামানতবিহীন হিসাবধারীদের জন্য ২৪ মিলিয়ন ডলারের পুনঃঅর্থায়ন কর্মসূচি, ১৫ লাখ স্কুল ব্যাংকিং হিসাবের মতো উদ্যোগগুলোর সুফলেরও বড় অংশ গিয়েছে গ্রামাঞ্চলে।

গ্রামে ব্যাংকিং সুবিধা

এজেন্ট ব্যাংকিংও প্রত্যন্ত অঞ্চলে পূর্ণাঙ্গ আর্থিক সেবার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ২০১৮-এ উন্নয়ন সমন্বয় পরিচালিত মাঠ জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ৫২ শতাংশ এজেন্ট ব্যাংকিং গ্রাহক জানিয়েছেন, এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটগুলো তাদের বসবাসের স্থানের খুব কাছাকাছি হওয়ায় তারা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সময় বাঁচাতে পারছেন। আবার ৬৭ শতাংশ গ্রাহক জানিয়েছেন, এজেন্ট ব্যাংকি সেবা আসার আগে ব্যাংকে যাতায়াত বাবদ অর্থ ব্যয় করতে হলেও এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট কাছাকাছি হওয়ায় তাদের আর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে না। কেবল সময় ও অর্থ সাশ্রয়ই নয়, এজেন্ট ব্যাংকিং সঞ্চয়ের প্রবণতাও বাড়াচ্ছে। যেমন উল্লিখিত জরিপে ২০ শতাংশ গ্রাহক জানিয়েছেন, তাদের এলাকায় এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালু হওয়ায় তাদের পক্ষে সঞ্চয় করা সম্ভব হচ্ছে, অন্যথায় হতো না। এসব সুবিধার কথা বিবেচনা করেই গ্রাহকরা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের দিকে ঝুঁকছেন। বাংলাদেশে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী গ্রাহকদের কাছে সুলভে বিভিন্ন রকম আর্থিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধানতম ভূমিকাটি পালন করেছে ডিজিটাল প্রযুুক্তির কার্যকর প্রয়োগ। এক্ষেত্রে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এক দশক আগে এমএফএসের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনায় নিয়ে ‘ব্যাংক লেড মডেল’ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তিন-চার বছরের মধ্যেই সর্বস্তরের নাগরিকদের এমএফএস সেবার আওতায় নিয়ে এসে সারা বিশ্বের ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডারদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে সময়ের সাহসী ও সুবিবেচনাপ্রসূত উদ্যোগের সুফল পাওয়া গেছে করোনা পরিস্থিতিতে। করোনার মাসগুলোয় প্রতি মাসেই এমএফএস লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে। কারণ আংশিক লকডাউনের সময় প্রায় সর্বস্তরের মানুষই নির্ভর করেছে মোবাইলভিত্তিক আর্থিক লেনদেনের ওপর। জুলাই ২০২০-এর হিসাবমতে, ওই এক মাসে এমএফএস লেনদেনের পরিমাণ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৮ শতাংশ বেশি। মানুষ বেশি মাত্রায় এমএফএসের ওপর নির্ভর করার ফলস্বরূপ এ সেবার ওপর তাদের আস্থাও বেড়েছে। ফলে বেড়েছে এমএফএস হিসাবের সংখ্যাও। ফেব্রুয়ারি ২০২০-এ এমএফএস হিসাবের সংখ্যা ছিল ২ দশমিক ৭ কোটি, আর জুলাই নাগাদ এ সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে ৪ দশমিক ৩ কোটি। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে সামাজিক নিরাপত্তা ভাতাগুলো দ্রæত ও তুলনামূলক ত্রুটিহীনভাবে পৌঁছে দেওয়া গেছে এমএফএসের মাধ্যমে। করোনাজনিত স্থবিরতার মধ্যেই জুলাই ২০২০-এ এমএফএসের মাধ্যমে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা দেওয়া হয়েছে বিপন্ন মানুষকে। মানুষ দ্রæতই এমএফএস ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে ‘নিউ নরমাল’-এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য। নতুন সেবাও আসছে। সিটি ব্যাংক ও বিকাশ এমএফএসের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে।

গ্রামগুলো থেকে এখন রপ্তানিও হয়

সৌদিপ্রবাসী যুবক মো. রায়হান আলী বগুড়ার সদর উপজেলার বানদীঘি হাপুনিয়াপাড়ায় নিজ বাড়িতে কয়েকজন কারিগর নিয়ে পোশাক কারখানাÑ বিস্ত ও আভায়া কারখানা শুরু করেন। বিস্ত এবং আভায়া হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের অভিজাত ব্যক্তিদেও এক বিশেষ ধরনের পোশাক। সৌদি আরব থেকে ফিরে তিনি এ কারখানা শুরু করেন। তার এ পোশাক মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া এলাকায় নারীরা টুপি তৈরি করে। এই টুপি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। নব্বইয়ে দশকে এলাকার রকমতউল্লাহ নামের এক ব্যক্তি গ্রামের নারীদের দিয়ে নকশাকাটা টুপি তৈরির এ উদ্যোগ নেন, যা একটি রপ্তানিমুখী ব্যবসা হিসেবে সফলতা পায়। রহমতউল্লাহর হাত ধরে শুরু হলেও কায়েতপাড়া গ্রামে টুপি তৈরির ব্যবসায় এখন অনেকেই নেমেছেন। রকমতউল্লাহ জানান, তার অধীনে দু’শ নারী টুপি তৈরির কাজ করছে। এলাকার সবচেয়ে বড় মহাজন বা প্রতিনিধি হচ্ছেন কায়েতপাড়ার মাঝিনা নদীর পাড় গ্রামের আলী হোসেন। আলী হোসেনের অধীনে প্রায় ১ হাজার নারী টুপি তৈরির কাজ করছেন। এছাড়া আরো বিশ থেকে পঁচিশ জন মহাজনের অধীনে প্রায় দুই আড়াই হাজার নারী টুপি তৈরির কাজ করছেন। এছাড়াও নওগাঁ এবং রংপুরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে টুপি রপ্তানি হয়।
দেশ ছাড়িয়েও নীলফামারীর মাদুর যাচ্ছে বিদেশে। রফতানি হচ্ছে কানাডা, ডেনমার্ক, সুইডেন এবং প্রতিবেশি দেশ ভারতেও। দেশ-বিদেশে চাহিদা বাড়ায় মাদুর তৈরিতে এখানকার নারীদের সম্পৃক্ততাও দিন দিন বাড়ছে। নীলফামারী সদরের কচুকাটা ইউনিয়নের একটি গ্রাম পশ্চিমপাড়া। এটি এখন মাদুর তৈরির এলাকা হিসেবে পরিচিত। এ এলাকার আটশো থেকে এক হাজার নারী মাদুর তৈরির পেশায় নিয়োজিত রয়েছে।
ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবং জীবিকার তাগিদে শরীয়তপুরের পাল বংশের নতুন প্রজন্ম মৃৎশিল্পে এনেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। নকশা ও পণ্যে আনা হয়েছে নান্দনিকতা। এতেই মিলেছে সাফল্য। দেশের গÐি পেরিয়ে বিশ্বের ২৫টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে এখানকার বিভিন্ন পণ্য। দেশের নামিদামি প্রতিষ্ঠানে বিক্রির পাশাপাশি নিত্যনতুন নকশায় তৈরি এসব পণ্য দেশের গÐি পেরিয়ে যাচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে। এ অঞ্চলের মৃৎশিল্পীদের সংগ্রহে রয়েছে হাজারও ধরনের দৃষ্টিনন্দন শিল্পকর্ম। ফুলদানি, মোমদানি, কলমদানি, হারিকেন, পুতুল, সাইকেল, প্যাঁচা, ঘোড়া, হাতি, পাখির বাসা, বজ্রনৌকা, খরগোশ, কচ্ছপ, ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি, ফলের ট্রে, চায়ের ট্রে, ওয়াল ম্যাট, আর্কষণীয় টালিসহ বৈচিত্রময় পণ্য। সমস্যা হচ্ছে এ মৃৎপণ্যগুলো কারিগরেরা নিজেরা রপ্তানি করতে পারে না, তারা বিক্রি করে দেয় ঢাকার বিভিন্ন মধ্যস্বত্তভোগী প্রতিষ্ঠানের কাছে। এজন্য কারিগরের খুব বেশি লাভবান হতে পারছে না।
নাটোরের খোলাবাড়ীয়া সহ আরো কয়েকটি গ্রামে বিঘার পর বিঘা জমিতে চাষ হয় এলোভেরা। এই এলোভেরা কৃষকরা সরাসরি রপ্তানি করে না। তারা এই এলোভেরা বিক্রি করে ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত তাইওয়ান ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি ফুড প্রসেসিং কারখানায়। তারা এটি প্রসেস করে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। কারখানাটি এলোভেরা ছাড়াও আনারস প্রসেস করে রপ্তানি করে থাকে।
এরকম ব্যতিক্রধর্মী পণ্যেও পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সবজি, মৎস্য ছাড়াও নানান ধরনের কৃষি পণ্য। বিদেশের সাথে যোগাযোগ বাড়িয়ে উদ্যোগ নিতে পারলে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রাম থেকেই বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব।

শেষ কথা

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে জীবনমানের যে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে, তার পেছনে কাজ করেছে কৃষির আধুনিকায়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, অ-কৃষি খাতের বিস্তার, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসার এবং সর্বোপরি প্রবাসী আয় বৃদ্ধি। তবে এ সবগুলো বিষয়কে সুসমন্বয় করেছে সরকারের গ্রামবান্ধব পরিকল্পনা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থনৈতিক অভিযান। এক দশক আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অভিযান শুরু করা হয়েছিলো, তার পেছনে মূল ভাবনাটি ছিলো সামাজিক পিরামিডের নিচে থাকা প্রান্তিক ও গ্রামীণ জনগণের কাছে সহজে উপযোগী আর্থিক সেবা পৌঁছে দেওয়া। উন্নয়নমুখী এবং গ্রাম বান্ধব ব্যাংকিং সেবায় গত এক দশকে নানান সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত¡াবধানে গত এক দশকে কয়েকটি কাজ বিশেষভাবে হয়েছেÑ (১) কৃষি অর্থায়নে আনুষ্ঠানিক আর্থিক সেবাদাতাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা, (২) ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অগ্রগতির জন্য সহায়ক নীতি প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন তদারকি করা, (৩) নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে কৃষি ও অকৃষি খাতে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আর্থিক সেবা নিশ্চিত করা এবং (৪) প্রবৃদ্ধি যেন সবুজ তথা পরিবেশবান্ধব হয়, সেদিকে বিশেষ নজর রাখা। যদিও কাগুজে এসব পদক্ষেপের সুফল সরকারি গবেষণায় যতটা উঠে আসে বাস্তবে তার প্রয়োগ অনেক ধরনের ত্রæটিযুক্ত। তারপরেও একথা বলতে হবে যে, গত এক দশকে অর্থনৈতিক সেবায় গ্রামাঞ্চলে পরিবর্তন এসেছে। এবং এ পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে মাইক্রো ফাইন্যান্স এবং ব্যাংকিং খাত। আর একথা অনস্বীকার্য যে, রেমিট্যান্সই এখন বাংলাদেশের গ্রামগুলোর অর্থনীতির প্রাণ এখন। মাত্র অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের আর্থিক খাতে, বিশেষ করে গ্রামে ঘটে গেছে এক নীরব বিপ্লব। জুলাই-সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে শুধু এজেন্ট ব্যাংকের এজেন্টরা ৩০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকার রেমিট্যান্স উপকারভোগীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। আগের বছরের ওই সময় থেকে তা ২২১ শতাংশ বেশি। গ্রামে এখন প্রয়োজন যথাযথ উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং গ্রামের যুব সমাজকে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলা। একইসাথে রাস্তায়ঘাটের উন্নয়ন তদারকি, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বহাল রাখা এবং ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট যদি পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম হয়ে উঠবে এক একটি অর্থনৈতিক করিডোর।


অনলাইন অবলম্বনে দিব্যেন্দু দ্বীপ