নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীই হতে পারে অর্থনীতি এবং পরিবহন ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু

নদীমাতৃক বাংলাদেশ


বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ৭০০টি নদী প্রবাহিত এবং এসব নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪,১৪০ কিলোমিটার। এদেশে ৫৮টি আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে। এই ছোট্ট দেশে এত বেশি নদী প্রবাহিত বলেই একে নদীর দেশমাতৃক দেশ বলা হয়। দেশের দীর্ঘতম ও বৃহত্তম নদী মেঘনা। বাংলাদেশের শীর্ষ নদীগুলো হলো পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী, তিস্তা ইত্যাদি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কৃষি ও শিল্পে ব্যবহারের জন্য নদীর পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা (গবেষণার তথ্যের ভিত্তিতে) দীর্ঘকাল ধরে সংকটজনক অবস্থায় রয়েছে। গত ৪০ বছরে ঢাকা শহরের পার্শ্ববর্তী নদী এবং চট্টগ্রাম শহরের কর্ণফুলী নদীতে চরম দূষণের ঘটনা ঘটেছে। বর্তমান তথ্যে দেখা গেছে যে, বুড়িগঙ্গা এবং কর্ণফুলি ছাড়াও অন্যান্য শহুরে নদী বিশেষ করে করতোয়া, তিস্তা, রূপসা, পশুর ও পদ্মা নদীর অবস্থাও নাজুক। পানির সাথে প্রবাহিত দূষণকারী বস্তুগুলো নদীগুলোর ভাটির অঞ্চলে মারাত্মক দূষণ সৃষ্টি করেছে। শুষ্ক মৌসুমে গবেষণায় নদীর পানিতে ধাতুর ঘনত্ব বেশি পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম ঝিনুক বা আর্টিফিশিয়াল মাসেল ব্যবহার করে ঢাকার বুড়িগঙ্গা, খুলনার ভৈরব ও চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূলের পানিতে ভারী ধাতুর (হেভি মেটাল) উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন। তারা বলছেন, এসব ধাতু জীব বৈচিত্র্য ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বৈশ্বিক গবেষণার অংশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ ও হংকংয়ের বিজ্ঞানীরা ২০১৩ ও ২০১৪ সালে নদী, মোহনা ও সমুদ্র উপকূলের পানিদূষণ ও ভারী ধাতুর উপস্থিতি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এই গবেষক দলের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ও অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের আরএমটিআই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেসের পরিবেশ গবেষক ড. গোলাম কিবরিয়া। বুড়িগঙ্গা নদীতে দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও) প্রায় শূন্য এবং তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও কর্ণফুলী নদীর বেশ কয়েকটি পয়েন্টেও একই অবস্থা বিরাজমান।

বাংলাদেশে নদী দূষণের অনেক কারণ রয়েছে। এরমধ্যে প্রধান কারণ নির্বিচারে নদীতে কারখানার বর্জ্য অপসারণ। বাংলাদেশে অধিকাংশ শিল্প-কারখানা শহরকেন্দ্রীক এবং সেগুলো গড়ে উঠেছে নদীর তীরে। প্রতিদিন হাজার হাজার টন বর্জ্য পদার্থ নদীর পানিতে ছাড়া হচ্ছে এসব কারখানা থেকে। নিয়ম-কানুন আছে, কিন্তু তারা তা সঠিকভাবে মানছে না। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইনের খসড়ায় (২০২০) কিছু কঠোর বিধান রাখা হয়েছে। এ আইনে নদীর দখল ও দূষণের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। নদীভিত্তিক অর্থনীতি পুনর্জাগরিত করতে হলে আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বব্যাপী নগরায়ন এবং শিল্পায়ন পরিচালতি হয়েছে নদীকে কেন্দ্র করে। আমাদের দেশেও এক সময় ছিলো বিস্তৃত নৌপথ এবং দেশের বেশিরভাগ মানুষ নৌপথে চলাচল করত। নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য সুযোগ রয়েছে নদীকেন্দ্রীক মহা অর্থনৈতিক পরিকল্পনার। কিন্তু দূষণ, দখল এবং সদিচ্ছার অভাবে এ সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। বিপরীতে এখনো দেশে নদীর ভাঙনে জমি বিলীন হচ্ছে, গৃহহীন হচ্ছে মানুষ। একইসাথে জেগে উঠছে চরাঞ্চল। কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে না বিশেষ অর্থনৈতিক করিডোর।
পৃথিবীতে জীবিত প্রজাতির জন্য পানি একটি অপরিহার্য সম্পদ। পানি ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব। এখন পর্যন্ত যেসব অনুসন্ধান হয়েছে তাতে দেখা গেছে যে, অন্যান্য গ্রহে পৃথিবীর মতো পানি নেই যাতে জীবিত প্রজাতি সেখানে টিকে থাকতে পারে। পৃথিবীর ১০০% পানির মধ্যে ৯৭% সমুদ্র এবং মহাসাগরে সংরক্ষিত যা লবণাক্ত এবং সাধারণত তা পানের অযোগ্য। মাত্র ৩% পানিকে মিষ্টি পানি হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং এর মধ্যে ২% বরফ এবং হিমবাহ হিসাবে সংরক্ষিত। অবশিষ্ট ১% পানি হ্রদ, খাল এবং ভূগর্ভস্থ, যা পানীয় জল হিসেবে ব্যবহারের একমাত্র সহজলভ্য উৎস। পৃথিবীতে জীবন টিকিয়ে রাখার জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং টেকসই পরিকল্পনা খুবই প্রয়োজন। শিল্প বিপ্লবের আগে পানির অভাব ও পানি দূষণের কথা ভাবা হয়নি। কিন্তু পানি দূষণের কারণে অনেক স্বাস্থ্যঝুঁকি ভোগ করার পর এবং রোগের প্রাদুর্ভাব প্রমাণ হওয়ার পর এটি প্রধান উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো অনেক উন্নত দেশ তাদের নাগরিকদের নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে দক্ষ প্রযুক্তি এবং জাতীয় পরিকল্পনা তৈরি করেছে। যাইহোক, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলিতে সঠিক পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার অভাবে গুরুতরভাবে পানিসম্পদের সমস্যা রয়েছে এবং বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম একটি দেশ। আবার বাংলাদেশ একইসাথে একটি নদীমাতৃক দেশ!
বাংলাদেশে ২৩৮টি প্রধান নদী রয়েছে। অধিকাংশ নদী গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনার মতো প্রধান আন্তঃসীমান্ত নদীগুলির ছোট উপনদী। পদ্মা, যমুনা, সুরমা, কর্ণফুলী, কুশিয়ারা, তিস্তা, দুধকুমার, ধরলা, আত্রাই, মহানন্দা, ধলেশ্বরী, করতোয়া, শীতলক্ষ্যা, রূপসা এবং পশুর ইত্যাদি দেশের সুপরিচিত নদী। এসব নদীর কারণে বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়। আগেকার দিনে সেচ সম্পূর্ণভাবে এই নদীর পানির ওপর নির্ভর করত। তবে পলি ও দূষণের কারণে বর্তমানে নদীর পানি সেচের জন্য ব্যবহার করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই কৃষকরা এখন বেশিরভাগক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। ভূগর্ভস্থ পানির নিবিড় শোষণের ফলে এবং ভূগর্ভস্থ পানি হ্রাসের দ্বারা যে ভ্যাকুয়াম তৈরি হচ্ছে সেখানে বিভিন্ন বিষাক্ত উপাদান জমা হয়ে জীববৈচিত্রের জন্য হুমকি তৈরি করছে। বাংলাদেশে এখন লাখ লাখ মানুষ আর্সেনিক দূষণে ভুগছে।


অধিকাংশ শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছিলো নদীর তীরে, নদীকে কেন্দ্র করে। এসব শিল্পকারখানা থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার টন বর্জ্য পদার্থ নদীর পানিতে ছাড়া হয়। নিয়ম-কানুন-আইন আছে, কিন্তু তারা তা সঠিকভাবে মানে না। কিছু শিল্পের বর্জ্য শোধনাগার (ঊঞচ) আছে কিন্তু উচ্চ লাভের লক্ষ্যের কারণে তারা (মালিকেরা) এটি চালাতে পছন্দ করে না। ফলে নদীর পানি জীব বৈচিত্রের জন্য বিষাক্ত হয়ে পড়ে। দূষিত নদীর কাছাকাছি কৃষি এলাকাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষকরা সেচের জন্য এই দূষিত পানি ব্যবহার করলে বিষাক্ত পদার্থগুলো খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করে এবং শেষ পর্যন্ত খাদ্যের মাধ্যমে তা মানুষের দেহে আসে। দরিদ্ররা সাধারণত এই দূষিত পানি ধোয়াপাল্লা, গোসল এবং এমনকি রান্নার জন্য ব্যবহার করে, যা খুবই ক্ষতিকর।
শিল্পায়নের কারণে বিশেষ করে শহরের চারপাশের নদীগুলি ভয়াবহভাবে দূষিত হয়ে উঠছে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু এবং শীতলক্ষ্যা হলো রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী নদী, যেগুলো বর্তমানে গুরুতর অবস্থায় রয়েছে। পানির গুণাগুণের সর্বনিম্ন মানের কারণে বুড়িগঙ্গাকে মৃত নদী বলা হয়। গ্রীষ্মকালে এ নদীর পানি শারীরিক চেহারা পোড়া মবিলের মতো গাঢ় কালো হয়। চট্টগ্রাম নগরীর বর্জ্য পদার্থে কর্ণফুলী নদী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে উঠেছে শত শত জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প। নদীর পানিতে ভেসে যাচ্ছে বিষাক্ত তরল, তেল, মবিল ও লোহার সামগ্রী। এই বিষাক্ত পানি নিম্ন অববাহিকা এলাকার অনেক অংশে সেচের পানি হিসেবে এবং বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ সালের প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশে জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। এই বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য সরবরাহের জন্য মোট কৃষি জমির (১৪.৩ মিলিয়ন হেক্টর) মাত্র ৫৯.৮% কৃষিকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। কৃষকরা প্রতি বছর অজৈব সার, কীটনাশক, ভেষজনাশক এবং বুঝে না বুঝে কীটনাশকের উচ্চ মাত্রা প্রয়োগ করে। এসব অজৈব উপাদানের একটি অংশ ফসল দ্বারা ব্যবহৃত হয় কিন্তু বড় অংশ পানিতে মিশে নিম্ন অববাহিকায় গমন করে অবশেষে নদীতে চলে যায়। শুধু বৈধ পথে নয়, প্রতি বছর লাখ লাখ টন কৃষি রাসায়নিক অবৈধ উপায়ে দেশে প্রবেশ করে। এছাড়া নামে বেনামে বিভিন্ন কোম্পানি দ্বারা তৈরি হচ্ছে সার এবং ওষুধ। কৃষকরা এই রাসায়নিকগুলির বিষাক্ততা সম্পর্কে জানে না। আগেকার দিনে কৃষিক্ষেত্র ও আশেপাশের জলাশয়ে প্রচুর মাছ ছিল। বর্তমানে কৃষি রাসায়নিকের কারণে পানির গুণমান এতটাই বিষাক্ত হয়ে উঠেছে যে, সশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে কোনো মাছ নেই।

নদীর অর্থনৈতিক গুরুত্ব
পরিবহন এবং যোগাযোগ: বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় নদী পথে সুগম পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে আন্তঃজেলা পরিবহন সহজতর করা সম্ভব। দেশের বেশিরভাগ জেলা একটি অপরটির সাথে নদীপথে সংযুক্ত। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে নৌপথে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব ছিলো। আইইউসিএন ও বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সালে দেশের মোট যাত্রীর মাত্র ৮ শতাংশ নৌপথে যাতায়াত করেছে, ৮৮ শতাংশই সড়কপথে। ২০২২ সালে এসে এ হার আরো কমেছে বলে ধারণা করা যায়। নৌপথে যাতায়াতের বর্তমান হার অনূর্ধ্ব ৫ শতাংশ মাত্র। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে নদ-নদীর মোট দৈর্ঘ্য ২৪ হাজার কিলোমিটার হলেও এখন বর্ষায় মাত্র ৬ হাজার কিলোমিটারে নৌযান চলাচল করতে পারে। শুষ্ক মৌসুমে হয়ে যায় ৪ হাজার ৩৪৭ কিলোমিটার। গত ছয় দশকে (১৯৬০-২০২০ সাল) দেশের নৌপথ অর্ধেক কমে গেছে। তবে বেসরকারি হিসেবে ব্যবহারযোগ্য নৌপথ আড়াই হাজার কিলোমিটারের বেশি নয়। বিদ্যমান বাস্তবতায় নৌপথ পুনুরুদ্ধার করতে হলে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে সুস্পষ্ট চুক্তি এবং ড্রেজিং-এর মাধ্যমে নৌপথ সুগম রাখার কোনো বিকল্প নেই। সবার আগে প্রয়োজন— নৌপথকে গুরুত্ব দিয়ে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন।
মৎস্যসম্পদ: বাংলাদেশের মৎস্য উৎপাদন ক্ষেত্রকে প্রধানত অভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক এ দুই ভাগে ভাগ করা যায়। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে রয়েছে মুক্ত জলাশয় ও বদ্ধ জলাশয়। মুক্ত জলাশয়ের মধ্যে আছে প্লাবন ভূমি, নদী, বিল, হ্রদ ও সুন্দরবন। এর আয়তন ৪০.৪৭ লাখ হেক্টর, যা মোট অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের শতকরা ৮৮.৪৬ ভাগ। বদ্ধ জলাশয়ের মধ্যে আছে পুকুর, মরা নদীর অংশ বা বাঁওড় ও উপকূলীয় চিংড়ি খামার। এর আয়তন ৫.২৮ লাখ হেক্টর, যা মোট অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের ১১.৫৪ শতাংশ। আমাদের সমুদ্র তটরেখা ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ। অর্থনৈতিক এলাকা ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। মোট সামুদ্রিক জলসম্পদের আয়তন ১৬৬ লাখ হেক্টর, যা দেশের মোট জলসম্পদের ৭৮.৩৯ শতাংশ। এ দেশে মাছের বার্ষিক উৎপাদন ২৫.৬৩ লাখ মেট্রিক টন (২০০৭-২০০৮ সালের তথ্য অনুসারে)। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আহরিত মাছের পরিমাণ ৮০.৫৯ শতাংশ এবং সামুদ্রিক জলসম্পদ থেকে প্রাপ্ত মাছের হিস্যা ১৯.৪১ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগৃহীত মাছের শতকরা ৪১.৩৬ ভাগ সরবরাহ আসে মুক্ত জলাশয় থেকে এবং ৩৯.২৩ ভাগ আসে বদ্ধ জলাশয় থেকে। আমাদের নদীগুলো একসময় ছিলো মাছে ভরপুর। ইলিশের মৌসুমে ইলিশের যোগান ছিলো চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য মাছ ও ভাত। এজন্য একটি প্রবাদ বাক্যই হয়ে গেছে— “মাছে-ভাতে বাঙালি।” বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে পারলে, দূষণমুক্ত করে সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারলে নদীগুলো শুধু আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদাই পূরণ করবে না, এমনকি মাছ রপ্তানি করাও সম্ভব হবে।
পলল পরিবাহী: নদী স্রোতের সাথে পলল বয়ে নিয়ে আসে। পলর জমিকে উর্বর করে তোলে। বন্যার সময় একদিকে যেমন মানুষের যানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়, পাশাপাশি নদীগুলো কৃষিজমিতে পলল প্রবাহীত করে উর্বর করে তোলে। পলল জমির প্রাণশক্তি বাড়িয়ে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করে।
সেচ: সেচ প্রকল্পের আওতায় কৃষকরা নদীর পানি কৃষি কাজে ব্যবহার করে থাকে। শীতকালে আমাদের দেশে খুব কম বৃষ্টিপাত হয়। সেচই এ সময়ে চাষের একমাত্র উপায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেচ প্রকল্পগুলি হলো রংপুরের তিস্তা প্রকল্প, চট্টগ্রামের কর্ণফুলি প্রকল্প, গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্প ইত্যাদি। বাংলাদেশ পরিসংখান ব্যুরোর ২০১৫ সালের একটি হিসাব অনুযায়ী দেশের মোট ধানের ১০ শতাংশেরও বেশি উৎপাদন হয় কেবল ময়মনসিংহে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রংপুর। কেবল রংপুরই নয়, উত্তরবঙ্গের সবুজ বিপ্লবের পিছনে রয়েছে তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্প।
জলবিদ্যুৎ: জলবিদ্যুৎ হলো নবায়নযোগ্য শক্তির অন্যতম প্রধান উৎস্য। বাংলাদেশে এ শক্তির প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও বাংলাদেশ মাত্র ১.৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জলবিদ্যুৎ থেকে। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রথম অবস্থানে থাকা চীনের মোট ব্যবহৃত বিদ্যুতের ১৭ শতাংশ জলবিদ্যুৎ থেকে আসে। তবে মোট উৎপাদনে প্রথম না হলেও দেশে ব্যবহৃত বিদ্যুতের শতকরা হিসেবে সবচেয়ে বেশি জলবিদ্যুৎ ব্যবহার করে ব্রাজিল। ব্রাজিলের ব্যবহৃদ বিদ্যুতের ৬৬ শতাংশ আসে জলবিদ্যুৎ থেকে। এদিক থেকে বাংলাদেশ খুবই সম্ভাবনাময় হওয়া সত্তে¡ও বাংলাদেশের কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী নদীর উপর একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে। এবং এটিই একমাত্র আমাদের জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে অবদান রাখে।

বর্তমান অবস্থা এবং পরিকল্পনা
নদ-নদী বাঁচিয়ে রাখতে, সংস্কার ও পরিচর্যার প্রয়োজন বিবেচনা করে গত নভেম্বর ২০২০ তারিখে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় বছরব্যাপী নদী খননের নির্দেশনা দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও একনেক সভাপতি শেখ হাসিনা। একনেকের ৫ এপ্রিল (২০২২) তারিখের সভা থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, নদী খনন ও বাঁধ নির্মাণের মতো প্রকল্পে পানিসম্পদ বিভাগকে আরও দ্রুত কাজ করতে হবে। ধীরে কাজ করলে চলমান কাজ শেষ করার আগেই পুরনো স্থাপনা নষ্ট হয়ে যায়। নদীর পানিপ্রবাহ ঠিক রাখা এবং ভাঙন প্রতিরোধে বড় নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পুরো বছরের পরিকল্পনা থাকতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার ভাঙন রোধে বিচ্ছিন্নভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে প্রতি বছর। কিন্তু ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় করা অর্থ পানিতেই ভেসে যাচ্ছে। এ কারণে নদীপ্রবাহ ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। নদীর পানি যখন কমে যায় তখন চর পড়ে, পানি বেড়ে গেলে ভাঙন শুরু হয়। তাই নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে বড় নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের বছরব্যাপী পরিকল্পনার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বর্তমানে প্রকল্পভিত্তিক নদী ড্রেজিং কার্যক্রম চলছে। এখান থেকে বের হয়ে এসে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ে যেতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। ক্যাপিটাল ড্রেজিং এবং মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং-এর মূল পার্থক্য হলে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রয়োজনমতো নদীর পূরনো গতিপথ ধরে খনন করা বোঝায়, আর মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং মূলত একটি সাময়ীক ব্যবস্থা যেখানে নদীর তলদেশ থেকে কিছু বাল বা পলি তুলে ফেলা হয়, যাতে নদীর নাব্যতা বজায় থাকে। যে হারে বাংলাদেশে নদী দখল হয়েছে তাতে প্রশ্ন হচ্ছে আদৌ বাংলাদেশে ক্যাপিটাল ড্রেজিং বাস্তবায়ন করা এখন সম্ভব কিনা।
পলি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে তীর ধরে ভাঙন শুরু হয়। এতে বিলীন হতে থাকে গ্রামের পর গ্রাম, শহর ও জনপদ। ভাঙনের ফলে যুমনা নদীর গড় প্রশস্ততা এখন ১২ কিলোমিটার হয়েছে। এ ছাড়া পদ্মা ১০ কিলোমিটার, গঙ্গা পাঁচ কিলোমিটার এবং মেঘনা নদীর গড় প্রশস্ততা বেড়ে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত হয়েছে। বছরব্যাপী ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা হলে বড় নদীগুলোর স্বাভাবিক গভীরতা বজায় থাকবে এবং প্রশস্ততা কমে আসবে।
ডেল্টা প্ল্যান অনুসারে সমন্বিত ও টেকসই উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। দুটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে: ১. নদীকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক বিষয়গুলো ফলপ্রসূ করা; ২. প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে জনজীবন ও সম্পদ রক্ষা করা। ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ হলো ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রণীত একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং বর্ধিত জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রণীত।
প্রতি বছর বাংলাদেশের গঙ্গা, যমুনা ও মেঘনা নদী ভারত, চীন, নেপাল ও ভুটান থেকে এই ব-দ্বীপ অঞ্চলে এক বিলিয়ন টনেরও বেশি পলি পরিবহন করে। ফলে বাংলাদেশের নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে পাড়ঘেষে স্রোতের বেগ বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী ভাঙন বাড়ছে। ফলে প্রতিবছর গ্রামের পর গ্রাম বিলিন হচ্ছে এবং বিপুল পরিমাণ সম্পদ হুমকির মুখে পড়ছে। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা নাসা এক গবেষণায় জানিয়েছিলো— ১৯৬৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে ৬৬ হাজার হেক্টরের (প্রায় ২৫৬ বর্গমাইল বা ৬৬০ বর্গকিলোমিটার) বেশি এলাকা পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে, যা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় আড়াই গুণের সমান। প্রতিবেদনে পদ্মাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ নদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ডিসেম্বর ২০২১, গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান সাময়িকী স্প্রিংগার নেচার ১০৫ বছরে পদ্মার ভাঙন নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে ১৯১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে পদ্মার ভাঙনের শিকার হয়েছে এর দুই পাড়ের ১ হাজার ৭৪৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা। আর পলি পড়ে গড়ে উঠেছে ১ হাজার ৩১৬ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ এই সময়ে পদ্মাপারের মানুষ ৪৩৩ বর্গকিলোমিটার ভূমি হারিয়েছে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। যে রকম অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, তাতে কয়েক দশকের মধ্যে বাংলাদেশের একটি বড় অংশই তলিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে বর্ষায় বন্যা এবং শীতকালে নদীগুলোতে পানি না থাকায় চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া ক্রমেই বাড়ছে। তাই অস্তিত্বের প্রয়োজনেই নদীগুলোকে সংস্কার করতে হবে।
গত ২৬ বছরে নদীভাঙনের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৯৫ সালে দেশের প্রধান তিনটি নদীতে নদীভাঙনের মোট পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৫০০ হেক্টর। বর্তমানে কমে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার হেক্টর অর্থাৎ নদীভাঙন উল্লেখযোগ্য হারে (তিনগুণ) কমে গেছে। ক্যাপিটাল ও মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং অব্যাহত থাকলে নদীভাঙন হ্রাস পাবে। ভাঙনকবলিত এলাকায় মানুষের দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় এবং জনবান্ধব প্রকল্প হাতে নিয়ে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে নৌপথ হবে জনগণের নিরাপদ চলাচলের প্রথম পছন্দ। অর্থনীতি হবে গতিময়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, দূষণ প্রতিরোধ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ছাড়াও বিনোদনসহ বিনিয়োগের নতুন হটস্পট হতে পারে নদী। এজন্য ড্রেজিং শিল্পের আধুনিকায়ন এবং এর পৃষ্ঠপোষকতা খুবই জরুরি। উন্মুক্ত নদীপথই হবে আগামীর বাংলাদেশের অর্থনীতি অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি।


নদীগুলো আমাদের অর্থনীতির লাইফলাইন। বাংলাদেশের অর্থনীতি, উন্নয়ন এবং প্রবৃদ্ধি প্রত্যক্ষভাবে প্রধান প্রধান নদী দ্বারা প্রভাবিত। পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, কর্ণফুলী এবং হালদা এবং তিস্তার মতো নদীগুলো বিভিন্নভাবে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। কিন্তু আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়ায় নদীগুলো আগ্রাসী দখলদার ও দূষণকারীদের খপ্পরে পড়ে গেছে। যা ভয়ঙ্করভাবে জীববৈচিত্র ও পরিবেশগত দিক থেকে বাংলাদেশ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ঢাকা শহরের প্রধান নদী— বুড়িগঙ্গা নদী দূষিত হতে হতে এখন আলকাতরার রং ধারণ করেছে। প্রতিদিন বুড়িগঙ্গায় দেড় লাখ ঘনমিটার তরল বর্জ্য পতিত হচ্ছে। পদ্মা নদীর তলদেশে বালু জমে জমে মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। গভীরতা কমে যাওয়ায় পদ্মা নদী বর্ষা মৌসুমে তার দুকূল ভাসাচ্ছে। ৩২০ কিলোমিটার দীর্ঘ নদী কর্ণফুলি– আমাদের অর্থনৈতিক রাজধানী চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশের পর শহুরে কাঠামোর উন্নয়ন এবং জাহাজা ভাঙা শিল্পসহ অন্যান্য শিল্প বর্জ্যরে দূষণের কবলে পড়েছে। একসময় দূষণমুক্ত ধলেশ্বরী নদী হাজারীবাগের ট্যানারি স্থানান্তরের জন্য দূষণের নতুন হুমকির মুখে। শিল্প-কারখানার সিইটিপি না মেনে যথাযথ শোধন ছাড়াই কারখানাগুলো বর্জ্য পানি নিষ্কাশন করছে। এতে নদীর মৎস্যসম্পদসহ অন্যান্য জীববৈচিত্র মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। এমনকি ৩০ বছর আগেও পদ্মা ও এর মোহনা থেকে বার্ষিক মাছ আহরণ ছিল ১০ হাজার মেট্রিক টন, যা কমে দাঁড়িয়েছে ১০০০ মেট্রিক টনে। পদ্মায় ১৪১ প্রজাতির মাছ ছিলো, এখন তা নেমে এসেছে ৩৮ প্রজাতিতে। তিস্তাও একই পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে। নদী তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় এবং অনেক নদী শুকিয়ে যাওয়ায় প্রায় ৯০ শতাংশ মাছের উৎপাদন কমে গেছে। মিষ্টি পানির অভাব ও লবণাক্ত পানির প্রভাব সহ অবৈধ হস্তক্ষেপে সুন্দরবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের নদীমাতৃক অঞ্চলে সোনালী ইলিশ তার অবাধ প্রজনন ক্ষেত্র হারাচ্ছে। নদ-নদীর এ ধরনের পরিবেশগত বিপর্যয় সেচ, মৎস্য, নৌ-চলাচল, বনায়ন, বাস্তুসংস্থানের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে, দেশের জন্য এ ক্ষতি অপরিমেয়।