বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ৪৫ বছর এবং বাংলাদেশের চীন নীতি

Taposh Das

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বর্তমান দুই শক্তিধর রাষ্ট্র চীন এবং আমেরিকার নতুন স্নায়ুযুদ্ধ নিয়ে সকলে কম বেশী অবগত। বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান অবক্ষয় চীনকে বর্তমানে একটু এগিয়ে রেখেছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও সবদিক থেকে মহাশক্তিধর দেশ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বেশ কিছুটা বিচ্যুতি বর্তমান শতককে ‘এশিয়ান শতক’ বলে পরিগনিত করেছে। স্বাভাবিকভাবে বলা যায় এশিয়ার রাজনীতিতে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো নীতি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু ভারত-চীন সম্পর্ক প্রতিযোগিতামূলক সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবং চীনের সম্পর্ক পরবর্তী দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে অন্যতম বিষয় হয়ে উঠতে পারে।

চীন-বাংলাদেশ মৈত্রীর ইতিহাসও দীর্ঘ, যদিও ’৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ সম্পর্কে চীনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ শুধু নয়, চীন সরাসরি বাংলাদেশের বিরোধিতাই করেছিল। তবে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তৎকালীন চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই দু’বার ঢাকা সফর করেন। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সেসময় (১৯৫৩ এবং ১৯৫৭) দু’বার চীন সফর করেন। চীন-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই দু’দেশের প্রবীণ নেতৃবৃন্দ চীন-বাংলাদেশ মৈত্রীবৃক্ষের চারাটি রোপণ করেছিলেন। ’৭১ এবং ’৭৫ ভুলে আজ সেই বৃক্ষটি অনেক বড় হয়েছে, যার শীকড় যথেষ্ট গভীরে প্রথিত। এই বৃক্ষের ফলও দু’দেশের জনগণ পাচ্ছে, প্রথম বাংলাদেশ।

বর্তমানে চীন-বাংলাদেশ কৌশলগত অংশীদারিত্বকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে এবং দুই দেশের কৌশলকে আরও সুসংহত করতে এবং যৌথভাবে বেল্ট অ্যান্ড রোডের নির্মাণ এগিয়ে নিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে সাথে নিয়ে যৌথভাবে কাজ করার জন্য প্রস্তুত থাকার কথা জানিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। একথা তাই নির্দিধায় বলা যায়— কখনো সরবে, কখনো নীরবে চীন বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালোই এগোচ্ছে।

বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের পূর্বে এবং পরবর্তীতে চীন কিন্তু বারবার পাকিস্তানকে সহযোগিতা করেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে চীন অস্ত্র সরবরাহ করেছে। এগুলো আজ হয়ত বাংলাদেশের জন্য শুধুই ইতিহাস। চীন যে সত্তরের দশকে বাংলাদেশের সাথে কোনো সম্পর্কই রাখেনি তা অবশ্য নয়— ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিলে চীন বন্যাদুর্গতদের সহায়তার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে ১০ লক্ষ মার্কিন ডলার সমমূল্যের ত্রাণসামগ্রী প্রদান করে। একই বছর চীন জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রবেশের ক্ষেত্রে তার আপত্তি অপসারণ করে নেয়, ফলশ্রুতিতে ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে (১৭) বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। এভাবেই চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়, যদিও তখন পর্যন্তও চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।

পরবর্তী সময়ে চীনা সরকার চীনের ক্যান্টন শহরে চলমান বসন্তকালীন বাণিজ্য মেলায় বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়, যদিও তখনো বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিল না। ১৯৭৫ সালের মে পর্যন্ত এই মেলা চলে এবং এসময় চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে ৪টি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আগে থেকেই বাংলাদেশি কূটনীতিবিদরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য চীনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতেছিল। চীনা কূটনীতিবিদরা জানান যে, চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি স্থগিত আছে, যদিও এ ব্যাপারে শীঘ্রই সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে বলে তারা বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের আশ্বাস প্রদান করে যাচ্ছিলেন।

১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে চীন। ১৯৭৫ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— চীন বাংলাদেশকে সমরাস্ত্র দেয় অন্য যেকোনো যোগানদাতার চেয়ে অনেক কম মূল্যে। ২০১৬-১৭ সালে চীনের কাছ থেকে দুইটি মিং-ক্লাস সাবমেরিন ক্রয় করে একটা নতুন মাইলফলক অর্জন করে। যদিও মিং-ক্লাস একটি অপেক্ষাকৃত পুরনো প্ল্যাটফর্ম, কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি মধ্য আয়ের দেশের জন্য, যারা সবে সাবমেরিন পরিচালনা করতে শিখছে, এটি খুবই কার্যকরী। বাংলাদেশ যে এ ধরনের জলযান কিনতে পারছে, এ থেকেও প্রতিফলিত হয় উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামরিক বাহিনীকে উচ্চমানের সমরাস্ত্রের অধিকারী করে তোলার ব্যাপারে বেইজিংয়ের আগ্রহ রয়েছে।

চীন বাংলাদেশে রফতানি করে প্রায় ১৬ থেকে ১৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, অথচ বাংলাদেশে থেকে আমদানি করে মাত্র ৭৫ কোটি ডলারের পণ্য। বাংলাদেশকে তারা বছরে একশো কোটি ডলারের সাহায্য দেয়। তবে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২৪ বিলিয়ন বা দুই হাজার চারশো কোটি ডলারের সাহায্য দেয়ার কথা ঘোষণা করেন।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশ-চীনের মধ্যে সম্পাদিক ঋণ চুক্তির মধ্যে— ২৮টি উন্নয়ন প্রকল্পে ২১.৫ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি সাহায্য, আট কোটি ৩০ লাখ ডলার অনুদানের জন্য অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা চুক্তি, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে ৭০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি, দাশেরকান্দি পয়ঃনিষ্কাশন ট্রিটমেন্ট পয়েন্ট প্রকল্পের জন্য ২৮ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি অন্যতম। এছাড়া দু’দেশের মধ্যে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ ও দাশেরকান্দিতে ট্রিটমেন্ট পয়েন্ট নির্মাণেও দুটি কাঠামো চুক্তি, ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ সহযোগিতা, মেরিটাইম কো-অপারেশন, মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল গঠনের সম্ভাব্যতা যাচাই, আইসিটিতে নতুন ফ্রেমওয়ার্ক, সন্ত্রাস দমনে সহযোগিতা, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ও তথ্য আদান-প্রদান, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতার লক্ষ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়।

শুধু বেসরকারি খাতেই চীন বিনিয়োগ করবে ১৩.৬ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া সরকারি পর্যায়ে আরও কয়েক বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি হয়েছে দেশটির সঙ্গে। সফরকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে ছয়টি প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন করেন। সেগুলো হলো— কর্ণফুলী নদীর নিচে একাধিক লেনের টানেল নির্মাণ,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ইনস্টিটিউট স্থাপন, চার স্তরের জাতীয় তথ্যভাণ্ডার, পটুয়াখালীর পায়রায় ও চট্টগ্রামে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং শাহজালাল সার কারখানা নির্মাণ প্রকল্প।

শুধু বেসরকারি খাতেই চীন বিনিয়োগ করবে ১৩.৬ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া সরকারি পর্যায়ে আরও কয়েক বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি হয়েছে দেশটির সঙ্গে। সফরকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে ছয়টি প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন করেন। সেগুলো হলো- কর্ণফুলী নদীর নিচে একাধিক লেনের টানেল নির্মাণ,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ইনস্টিটিউট স্থাপন, চার স্তরের জাতীয় তথ্যভাণ্ডার, পটুয়াখালীর পায়রায় ও চট্টগ্রামে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং শাহজালাল সার কারখানা নির্মাণ প্রকল্প।

তবে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের অবস্থান যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ । পরিসংখ্যান বলছে, ভারত থেকে ২০১৯ সালে ৭ হাজার ৬৪৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই একই বছরে চীন থেকে আমদানি করা হয়েছে ১৩ হাজার ৬৩৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অর্থাৎ ভারতের চেয়ে চীন থেকে প্রায় দ্বিগুণ পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে ২০১৯ সালে ভারতে পণ্য রফতানি হয়েছে ৯৩০ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের। আর চীনে পণ্য রফতানি হয়েছে ৭৪৭ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারের।২০১৯ সালে চীন থেকে বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগ এসেছে এক হাজার ৪০৮ মিলিয়ন ডলার। আর ২০১৯ সালে ভারত থেকে নতুন বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ১৫০ মিলিয়ন ডলার। নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও চীনের ধারেকাছে নেই ভারত।

বেশ কিছু আন্তর্জাতিক বিষেশজ্ঞ মনে করেন যে, বাংলাদেশে চীনের লগ্নি বাড়লেও সেক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে কোনো ঘাটতি ঘটবে না, যেহেতু দু’দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ক চিরসবুজ। মনে রাখতে হবে যে, রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ইচ্ছা থাকলেও মৌলবাদী প্রচারকারীরা  সামাজিকভাবে দেশটাকে মৌলবাদ এবং জঙ্গিবাদের আবাসভূমি রূপে প্রতিস্থাপিত করেছে।আমারদের এও মনে রাখতে হবে যে, যদি চীনা অর্থের পরিমান বাংলাদেশে বাড়তে থাকে তাহলে ভারত বিরোধী শক্তি সহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ধীরে ধীরে আরো ডালপালা বিস্তার করার সাহস পাবে।


তাপস দাস, বাংলাদেশ বিষয়ক গবেষক

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা 

তাপস দাস