বাংলাদেশ ভালো আছে, ভালো নেই

Bangladesh

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে পরবর্তী ৫০ বছর জুড়ে বাংলাদেশের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, সার্বিক অবস্থা ভালো হয়েছে। তবে দেশের অবস্থার পরিবর্তন কতটা রাজনৈতিক এবং কতটা বৈশ্বিক ধারাবাহিক উন্নতির ফলাফল তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। ১৯৮০, ১৯৯০, ২০০০, ২০১০, ২০২০ এবং এখন ২০২৩ সালে এসে যদি বিভিন্ন সূচকে হিসাব করা হয়, দেখা যাবে বাংলাদেশের মানুষের জীবনমানের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। কিছু সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। পুষ্টিমান ও শিশুমৃত্যুর সূচকে ভারত এবং পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। তবে একথা অনস্বীকার্য যে শিশু মৃত্যু, মাতৃমুত্য, শিশু স্বাস্থ্য এবং মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে বাংলাদেশ সরকারগুলো যতটা না কাজ করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো। বাংলাদেশের এমন অনেক ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে সরকারের চেয়ে বেসরকারি খতের অবদান বেশি। মাথাপিছু আয়ের সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে। শুধু মালদ্বীপের কথা বাদ দিয়ে বাংলাদেশ এদিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে রয়েছে। এক্ষেত্রেও সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে বেসরকারি বা ব্যক্তিখাত- বিশেষ করে প্রবাসী আয় এবং তৈরি পোশাক শিল্প।  মাথাপিছু আয়ের হিসাব করলে বাংলাদেশ ভারতের চেয়েও ভালো আছে। তবে মাথাপিছু আয় সহ কয়েকটি সূচকে যেমন দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এগিয়ে আছে, পাশাপাশি অনেক দিক থেকে বাংলাদেশ পিছিয়েও আছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান বিষয়ক বিখ্যাত জার্নাল ‘নেচার’ ২০২২ সালের দেশ ভিত্তিক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। নেচার ইনডেক্সে শুধু ভারতের চেয়েই নয়, শ্রীলংকা-নেপাল এমনকি পাকিস্তানেরও পেছনে বাংলাদেশের অবস্থান। ২০২২ সালের ইনডেক্স অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের অবস্থান ১০তম। এ ছাড়া পাকিস্তান ৩৯, শ্রীলঙ্কা ৮৬তম, নেপাল ৯১তম ও বাংলাদেশ ১০২তম অবস্থানে রয়েছে। এ ছাড়া ইনডেক্সে আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া ৮৮, কেনিয়া ৯২, তানজানিয়া ৮৩তম অবস্থানে থেকে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। দেশ কতটা এগোচ্ছে সেটি শুধুমাত্র পেট ভরে ভাত খাওয়া দিয়ে ধারণা করা যায় না, শিক্ষা গবেষণা, চিকিৎসার মতো বিষয়গুলোতে একটি দেশ কেমন করছে সে সূচকগুলো আমলে নেওয়া অত্যন্ত জরুরী।

বাংলাদেশ কেন শিক্ষা ও গবেষণায় ভালো করতে পারছে না? মূল সমস্যাটি আসলে কথায়? গত ৩-৪টি বাজেট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শিক্ষাখাতে বাংলাদেশের বরাদ্দ ছিল জিডিপির ২ শতাংশের মতো। ২০২১ সালে ছিল ২.০৯ শতাংশ। গত বাজেটে শিক্ষায় প্রকৃত বরাদ্দ ছিল মাত্র ১.৮৩ শতাংশ। যেখানে ইউনেস্কো বলে একটি দেশকে অন্তত তার জিডিপির ৫.৫ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়া উচিৎ, সেখানে আমরা দেই ১.৮ শতাংশ থেকে ২.১ শতাংশের মতো। এই টাকার বেশির ভাগই চলে যায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং দুর্নীতিতে। সত্যিকারের শিক্ষা ও গবেষণায় তেমন ব্যবহারই করা হয় না। আমাদের অবহেলিত শিক্ষা ও গবেষণার কথা বিবেচনায় নিয়ে এই খাতে উন্নতি করতে হলে আমাদের উচিৎ জিডিপির ৭ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া। অবকাঠামোগত উন্নয়নের গুরুত্ব রয়েছে, কিন্তু প্রকৃত উন্নয়ন বলতে যে জনসম্পদের উন্নয়ন সে জায়গাটিতে আমরা বিশেষভাবে পিছিয়ে রয়েছি।

শিক্ষাখাতে দক্ষিণ এশিয়ায় বাজেটে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয় বাংলাদেশ। যেখানে ভারতের ৩.০৮ শতাংশ, পাকিস্তানের ২.৭৬ শতাংশ, আফগানিস্তানের ৩.৯৩ শতাংশ, মালদ্বীপের ৪.২৫ শতাংশ, নেপালের ৫.১০ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার ২.৮১ শতাংশ। বাংলাদেশ সেখানে পরপর কয়েকটি বাজেটে গড়ে বরাদ্দ দিচ্ছে মাত্র ২ শতাংশ। শিক্ষাখাতে গত ২০ বছর ধরেই দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম ব্যয় করে বাংলাদেশ। ইউনেস্কোর নির্দেশনা, শিক্ষাখাতে জিডিপির অন্তত ৪-৬ শতাংশ বরাদ্দ থাকতে হবে। বাংলাদেশে এই প্রস্তাবে রাজিও হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে গত ২০ বছর ধরে ২ শতাংশের আশেপাশেই থাকছে।

শিক্ষার মতো স্বাস্থ্যখাতেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম ব্যয় করে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট জিডিপির মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থ মাথাপিছু স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হচ্ছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। স্বাস্থ্য ব্যয়ের অতিরিক্ত চাপের কারণে অনেক সময়ই তুলনামূলকভাবে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। সরকারি হাসপাতালের বেহাল অবস্থার কারণে মানুষ বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে মোট ৩২,৭৩১ কোটি টাকা, বা জিডিপি’র মাত্র ০.৯৫ শতাংশ, যা গেল বছরের সংশোধিত বাজেটের ১.০২ শতাংশের চেয়েও কম। স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির শতাংশ অনুপাতে বরাদ্দের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট কেবল পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের চাইতে উপরে আছে। অথচ, দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ তার জিডিপির ৯ শতাংশ এখাতে ব্যয় করে।

বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে ১৫৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় ১১৯তম, প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় ৭৭ তম, উচ্চশিক্ষায় ১২২ তম, গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবনে ১৩৬ তম , তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে ১১৭ তম, অর্থনীতিতে ১০১তম এবং সাধারণ সক্ষমতার পরিবেশে ১৩৪তম। ২০২১ সালের ‘গ্লোবাল ট্যালেন্ট কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্সে’ ১৩৪ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৩ নম্বরে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সবার নীচে। এই অঞ্চলে শীর্ষে আছে ভারত (৮৮)। এরপর আছে শ্রীলঙ্কা (৯৩), পাকিস্তান (১০৭) ও নেপাল (১১৩)।

আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের পর স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলছি। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ডিজিটাল বা স্মার্ট বাংলাদেশে ইন্টারনেটের গতির ২০২১ সালের সূচকে ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৩৭তম। যেখানে ভারতের অবস্থান ১২৬তম। ইন্টারনেটের গতিতে নেপালের অবস্থান বাংলাদেশের চেয়ে ভালো, ১১৪তম। মালদ্বীপের অবস্থান ৪০তম, পাকিস্তান ১২০তম। অর্থাৎ, ডিজিটাল বা স্মার্ট বাংলাদেশেও দক্ষিণ এশিয়ার সবার চেয়ে আমরা ইন্টারনেটের গতিতে ভালো নেই। এ কারণে আমাদের ফ্রিল্যান্সাররা কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত সমস্যায় পড়ে।

তাহলে বাংলাদেশ ঠিক কোন জায়গায় ভালো আছে? বাংলাদেশ ভালো করছে কৃষিতে, যদিও বিষমুক্ত খাদ্য আমরা উৎপাদন করতে পারছি কিনা সেটি নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। তথাপি বাংলাদেশ এখন কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে পাট ও কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, ধান ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আম ও আলু উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয় এবং বদ্ধ জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। বর্তমানে আমাদের মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়ে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন হয়েছে।

পৃথিবীব্যাপী ধান উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইরি)। অবদান আছে বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ব্রি)। গত ৫০ বছরে তারা ১০০ জাতেরও বেশি উচ্চফলনশীল ধান উদ্ভাবন করেছে। ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নাম বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট রাখা হয় স্বাধীনতার পর। নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে তারা সাফল্য পেয়েছে। গবেষণার সাফল্যকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে বাংলাদেশের কৃষক। এখানে রাজনীতি এবং সরকারের ভূমিকা নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণের দাবী রাখে।

বাংলাদেশের সফলতার প্রতিটি ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে মূলত দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। যে তিনটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বেগবান রেখেছে সে তিনটি ক্ষেত্রে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের উপস্থিতি। প্রধানতম রপ্তানি খাত- তৈরি পোশাক খাতে কাজ করছে অর্ধকোটি নারী-পুরুষ শ্রমিক। সতেরো কোটি মানুষের জন্য খদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণতা এনেছে বাংলার কৃষক। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঠিক রাখছে এক কোটির বেশি প্রবাশী শ্রমিক। প্রবাসী বাংলাদেশীরা দেশে নিয়মিত টাকা না পাঠালে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মহা সংকটে পড়ে যেত।

শহরকেন্দ্রীক অবকাঠামো নির্মাণে সরকার এগিয়ে রয়েছে। এটাকে সরকার উন্নয়নের একটা বড় সূচক হিসেবে দেখাতে চায়। অবকাঠামোগত উন্নয়নও অবশ্যই উন্নয়নের একটা সূচক। কিন্তু একইসাথে যদি মানব সম্পদ তথা শিক্ষা চিকিৎসা ক্ষেত্রের মতো মৌলিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন না ঘটে, জ্ঞান বিজ্ঞানে দেশ সমৃদ্ধ না হয়, তাহলে প্রকৃতপক্ষে দেশ এগিয়েছে বলা যাবে না।  বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের দেশে প্রায় ৫ কোটি মানুষই খাদ্য সংকটে আছে। ২ কোটির বেশি মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়। ফলে উন্নয়নের যে জায়গাতে আমারা সবচেয়ে বেশি গর্ব করছি সেখানেও রয়েছে গলদ। জিডিপি এবং মাথাপিছু আয়ে আমরা ভারত এবং পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে গিয়েছি একথা যেমন সত্য, আবার ভারত এবং পাকিস্তানের চেয়ে অনেক দিক থেকে আমরা পিছিয়েও রয়েছি একথাও সত্য। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভারতে চেয়ে আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি।

মাথাপিছু জিডিপিতে ১৯৯১ সালেও বাংলাদেশ একবার ভারতের চেয়ে এগিয়ে গিয়েছিলো। ফলে মাথাপিছু জিডিপিতে এগিয়ে যাওয়াটাই শেষ কথা নয়। এটা সত্য যে, জিডিপি ছাড়াও আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। গড় আয়ু ভারতে চেয়ে বেশি, অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণে বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের চেয়ে ভালো। গত এক দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক যে ভিত্তি পেয়েছে, সে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে জ্ঞান বিজ্ঞানে এবং গবেষণায় ভালো করতে পারলে আগামী এক দশকে নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশ আরো এগিয়ে যাবে।  তবে সেজন্য দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে বাংলাদেশকে বেরিয়ে আসতে হবে। লাগামহীন দুর্নীতিই এখন উন্নতির পথে আমাদের প্রধান বাধা।