এর জন্য নিজের মাঝে চিন্তা-ভাবনা এবং যুক্তিবোধের ফ্যাক্টরি লাগে। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ এখনও এতখানি মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি। এজন্যই তো এত সব বিচার-আচার-আইন-আদালত লাগে। মানুষ মানুষ হলে তো আর এত কিছু লাগত না।
মুহূর্তে চারপাশের মানুষের মন সহজে মুক্ত হয়ে যাবে সে আশা করার সুযোগ নেই। মানতে হবে সবাইকে। কুলি মজুর অফিসার ব্যবসায়ী চোর ডাকাত বৈশ্য বেশ্যা কুতসিৎ রূপশী আস্তিক নাস্তিক— ভালোবাসার বিচারে কাউকেই ভিন্ন চোখে দেখা যায় না। বিচারক আমি নই, বিচার করার দায় আমার নেই। আমি মানুষ, আমার কাজ ভালোবাসা।
সমালোচনা ভিন্ন বিষয়। সংশোধনের জন্য, রোগ সারাবার জন্য সমালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। তবে কারো সমালোচনা করা মানে তাকে শত্রু জ্ঞান করা নয়। আস্তিক নাস্তিকের সমালোচনা করতে পারে, নাস্তিক আস্তিকের সমালোচনা করতে পারে— এতে কোনওটাই সহজে ভিত্তিহীন হয়ে যায় না। তর্ক বিতর্কের মাধ্যমে আসলটা টিকে থাকে।
আমি আজ পর্যন্ত কোনদিন শুনিনি যে— কোনও নাস্তিক কোনও আস্তিককে কুপিয়ে মেরেছে বা শারীরিকভাবে আহত করেছে। তাহলে ধর্মান্ধরা কেন শারীরিকভাবে আক্রমণ করে? আসলে দ্বন্দ্বটা কোথায়? আধ্যাত্মিক ঈশ্বর থাকা বা না থাকায়, নাকি যুগ যুগ ধরে অতিকায় যে সামাজিক ঈশ্বর মানুষ পয়দা করেছে তার গুমোর ফাঁস হয়ে যাওয়ায়?
আসলে ‘আধ্যাত্মিক ঈশ্বরের’ সাথে ‘নাই-ঈশ্বরের’ কোনও বিরোধ নেই। ‘নিরাকার ঈশ্বরের’ সাথেও ‘নাই-ঈশ্বরের’ কোনও বিরোধ নেই। আপনি ঈশ্বরে যুক্ত হচ্ছেন, কেউ ঈশ্বর-নাই তে মুক্ত হচ্ছে। মুক্তি-ই যদি শেষ কথা হয় তাহলে এই সামাজিক ঈশ্বর থাকাটা অবশ্যই সে মুক্তি’র পথে বাঁধা। মূলত মুক্তি-ই মানুষের প্রকৃত ঈশ্বর।
সমস্যা ঐ সামাজিক ঈশ্বরে, যে ঈশ্বর মানুষকে মুক্ত করে না, বিষয়-আশয় দিয়ে বেঁধে রাখে, আবদ্ধ হতে বলে, আবদ্ধ করতে বলে— যে ঈশ্বর প্রার্থনা চায়, যে ঈশ্বর ভক্তকে বুকে টেনে নেয় না, পা বাড়িয়ে দেয়। এই ঈশ্বরের ভক্তরাও তার মতো হবে— তাই তো স্বাভাবিক। বিরোধটা হচ্ছে ‘মুক্তি’ এবং স্বার্থপর এই ঈশ্বরের মধ্যে।
বিরোধটা হচ্ছে সামাজিক ঈশ্বরের সাথে আধ্যাত্মিক ঈশ্বর এবং ‘ঈশ্বর-নাই’ তত্ত্বের। তাই যুদ্ধটাকে ‘আস্তিক বনাম নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে সরলীকরণের কোনও সুযোগ নেই। যুদ্ধটা ভালোর সাথে মন্দের। যুদ্ধটা শোষকের সাথে শোষীতের। যুদ্ধটা মানুষের সাথে অমানুষের। আপনি হয় অসুন্দরের পক্ষে, না হয় সুন্দরের পক্ষে। পক্ষ একটা আপনাকে নিতেই হবে।
যারা চাপাতি দিয়ে একজন মানুষকে কুপিয়ে মারতে পারে তারা কোন ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করে— তা আপনাকে ভেবে দেখতে হবে। আপনি নিজেও যদি সেই একই ঈশ্বরের সাগরেদ হন তাহলে আপনিও এই খুনের জন্য দায়ী, অবশ্যই ভীষণভাবে দায়ী। ধর্মের অবমাননা হয় না, মুক্তধর্মের বিশালত্ব আছে বলে তার অবমাননা হয় না। সাগরে মুতে দিলে সাগরের পানি দিয়ে মুতের গন্ধ আসে না। বিশালতা না থাকাটাই এসব ধর্মের প্রকৃত রোগ।
আধ্যাত্মিক ঈশ্বরের অবমাননা হয় না। খ্যাক খ্যাক করে খেপে ওঠে অতিকায় ঐ সামাজিক ঈশ্বর, যার ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে দুর্বৃত্তরা, বিভ্রান্ত হয়ে যার পায়ে পড়ছে ধর্মান্ধরা। আপনাকেও এখন নিজেকে চিনতে হবে, বুঝতে হবে— আপনি কি ঐ ঈশ্বরের ঘাড়ে আছেন, নাকি পায়ে আছেন।