লেখালেখি অত্যন্ত অথরিটেটিভ বিষয়, সাবজেকটিভ বিষয়। এক্ষেত্রে কম্প্রোমাইজের কোনো সুযোগ নেই। প্রকৃত লেখক চরিত্রের মানুষের মধ্যে প্রবল এক ধরনের বৈপরিত্য থাকে— তারা বাস্তব জীবনে খুব বিনয়ী এবং কম্প্রোমাইজিং হয়, কিন্তু লেখালেখিতে অত্যন্ত কঠোর থাকে।
এই কঠোরতা অবচেতন নয়, এটা প্রয়োজনীয়। ব্যবস্থাপনার জন্য সবার মতামত গ্রহণ করা দরকার, ভালো; কিন্তু সৃষ্টির জন্য, অগ্রগতির ক্ষেত্রে আপোষের সুযোগ নেই, ভবিষ্যত বিনির্মাণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত দিতে হয়— সেটি গল্প-কবিতা-উপন্যাস-নাটকের মধ্য দিয়ে কৌশলে হতে পারে, আবার প্রবন্ধ এবং নিবন্ধের মধ্য দিয়ে সরাসরিও হতে পারে।
বাস্তব জীবনে লেখক ধার্মিক, অধার্মিক, আস্তিক, নাস্তিক, সাম্প্রদায়িক, চোর, ডাকাত, মাদকাসক্ত, শিশু, বৃদ্ধ, যুবতী, রূপবতী বা ন-রূপবতী সবার সাথেই ভালোবেসে চলতে পারে— সেটি চলমান জীবন, কিন্তু সৃজনশীল লেখালেখি ঠিক চলমান বা গড়পড়তা জীবনের জন্য নয় সবসময়। অতএব, একজন লেখককে স্পষ্টতই দ্বৈত সত্তার অধিকারী হতে হয়, এবং তা সচেতনভাবেই।
একজন লেখক এত বোকা নয় যে সে এটা জানবে না— আজকে লিখলে কালকেই কিছু পরিবর্তন হয়ে যাবে না। কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে যে ভাবার্থপূর্ণ যুক্তি নিহীত থাকে, সেটি খুব প্রবল হয়, নীরবে তা আপাত শত্রুপক্ষকেও নির্দেশনা দেয়, এই কারণে প্রকৃত সাহিত্যিক খুব শক্তিশালী মানুষ, সে রাজার ওপরও কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা রাখে, করেও পরোক্ষভাবে তা। উন্নত সমাজে সেটি এখন প্রত্যক্ষও।
মুক্ত দেশ, মুক্ত সমাজ লেখককে কর্তৃত্বপরায়ন হবার সুযোগ দেয় বলেই সমাজটা সুন্দর হয়, মানবিক হয়। অবশ্য ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে লেখক তার লেখালেখিতে কর্তৃত্বপরায়নতার জন্য অনেক কৌশল অবলম্বন করেছে, আমাদের দেশে এখনও সেই অবস্থা চলছে। এতে অসুবিধা হয়, অকাজে সময় নষ্ট করতে হয়, আবার তাতে কিছুটা উপকারও হয়, যেটাকে বলে মন্দের ভালো— নিজের লেখাটা বেশি বেশি যাচাই করার জন্য মনোযোগী হতে হয়, অনেক সময় তাতে চিন্তা-ভাবনা পরিশিলীত হয় খানিকটা, তবে দিনশেষে ক্ষতির পরিমাণই বেশি।
লেখকের সাথে সমাজের দ্বন্দ্ব নিয়ে কিছু বলা দরকার। লেখকের সাথে সমাজের দ্বন্দ্বটা আসলে গণমানুষের সাথে নয়, অবাক হলেও এটা সত্যি যে, একজন লেখকের সাথে সর্বপ্রথম দ্বন্দ্ব হয় তার পরিবার, আত্মীয় স্বজন এবং বন্ধু বান্ধবদের সাথে।
এক্ষেত্রে পরিবারের সাথে দ্বন্দ্বের কারণ— লেখালেখির কারণে পরিবার স্পষ্টতই বঞ্চিত হয়, যেহেতু সৃজনশীল লেখালেখি বর্তমান মানুষের জন্য খুব বেশি কাজে আসে না, ফলে মানুষ এটাকে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে চায় না, কারণ, বেশিরভাগ মানুষ নিজের জীবন, এবং বড়জোর আর এক প্রজন্ম, অর্থাৎ তার ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভাবতে চায়, এর বেশি না। সেক্ষেত্রে পরিবার এবং আত্মীয় স্বজন লেখালেখি মানতে পারে না, যেহেতু ব্যবসা বাণিজ্য বা অন্য কিছু করে সম্পদ অর্জন করলে তাতে তাদের কিছু হলেও লাভ ছিল। আবার যদি দেখে সাহিত্য চর্চা করে কেউ বর্তমান জীবনেই বিশাল নাম-খ্যাতি-অর্থ করে ফেলেছে তখন তারা খুশি, অর্থাৎ তাদের আগ্রহের জায়গাটা কাজ নয়, অর্জন/সম্পদ। কারণ, সম্পদ অর্জনে তাদের পরোক্ষ হলেও কিছু প্রাপ্তি থাকে।
বন্ধু-বান্ধবদের (সিনিয়ররাও) সাথে দ্বন্দ্বটা হয় একটু ভিন্নভাবে— বেশিরভাগ মানুষ বর্তমান জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে সরাসরি কর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করে, ভালো লাগুক বা না লাগুক সেটি করে ভালো থাকার চেষ্টা বেশিরভাগ মানুষই করে, করতে বাধ্য হয়। এবং অনেক সম্পদশালীও হয় কেউ কেউ— সেক্ষত্রে তারা এটা মানতে পারে না যে, তাদের মধ্য থেকে কেউ একজন ভিন্নভাবে জীবনটা যাপন করছে এবং অর্থবিত্ত না থাকা সত্ত্বেও ভীষণ প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। যদিও একজন প্রকৃত লেখকের সংগ্রামটা হয় বহুমাত্রিক— যেটি খুব কাছের মানুষ ছাড়া কেউ জানতে পারে না।
তাদের (পরিচিত মহলের) মানতে না পারাতে কিছু হত না, সমস্যা হয় লেখক যদি দরিদ্র হয়, তাহলে তারা সুযোগটা নেয়, সুযোগটা নেয় এই কারণে— লেখকের সাহিত্যে কর্তৃত্বপরায়নতাকে তারা বাস্তব জীবনের সাথে মিলিয়ে ফেলে এবং প্রত্যুত্তরে তারা বাস্তবিকই কর্তৃত্বপরায়ন হতে চায় পদাধীকার এবং গচ্ছিত সম্পদের জোরে। বন্ধু তথা পরিচিত মহলের সাথে লেখকের এই যে দ্বন্দ্ব, এটিই ধীরে ধীরে সামাজিক দ্বন্দ্বে রূপ নয়, অনেক সময় সেটি খুব প্রবল হয়েও দেখা দেয়।
# বন্ধু বলতে এখানে পরিচিত জনকেও বুঝানো হয়েছে, এবং সিনিয়র জুনিয়র সব পক্ষই।