৭ নভেম্বর তথাকথিত সিপাহী বিপ্লব ও একটি নিবেদিতপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের গল্প

সিতারা বেগম

আলী আকবর টাবি

বড়ভাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর। ছোটবোন সিতারা বেগমও ঢাকা মেডিকেল থেকে পাশ করে পাকিস্তান সেনা মেডিকেলে লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ মুহুর্তে দুই ভাইবোন ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে তারা কর্মস্থলে যোগদান না করে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দুই ভাইবোন কর্মস্থলে ফিরে না গেলে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা তাদের পিতা মোহাম্মদ ইসমাইল মিয়া ও মেজর হায়দারকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে।

মেজর হায়দার ২ নং সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন। সিতারা বেগম ২ নং সেক্টরের অধীনে ৪৮০ বেডের বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরাও সেখানে চিকিৎসা নিতেন। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য সিতারা বেগম বীর প্রতীক উপাধী পান, দু’জন নারী বীর প্রতীকের মধ্যে তিনি একজন। মেজর হায়দারের একমাত্র ছোটভাই এ টি এম সফদারও (জিতু) মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মেঘালয়ে ট্রেনিং নেওয়ার পর শালদানদী এলাকায় বিভিন্ন সম্মুখযুদ্ধে তিনি বীরত্বের সাথে লড়াই করেন। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মেজর হায়দার মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের জন্য মেজর হায়দারকে বীর উত্তম খেতাব দেওয়া হয়।

পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর জেনারেল জিয়ার নির্দেশে ভোর বেলায় শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার মেসে নাস্তা করার সময় মেজর জলিল ও মেজর আসাদের নেতৃত্বে একদল উচ্ছৃঙ্খল সৈনিক কিল ঘুষি লাথি মারতে মারতে মেজর হায়দারকে দোতলা থেকে নীচে নামিয়ে এনে গুলি করে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার পর মেজর হায়দার খুন হলে এবং সিতারা বেগম নিজেও উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকদের দ্বারা অসম্মানজনক আচরণে ক্ষোভে দুঃখে এদেশ ছেড়ে চলে যান। প্রকৃতপক্ষে ৭ নভেম্বর সিপাহী বিদ্রোহের নামে স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হত্যা করা হয়েছিল।

১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পরে ব্রিটিশরা যে উন্মত্ততা নিয়ে সিপাহিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জিয়াউর রহমান তারচেয়ে অধিক নিষ্ঠুরতা নিয়ে ৭ নভেম্বরের পর সিপাহীদের ওপর হত্যাযঞ্জ চালিয়েছিলেন। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সুফল সিপাহীরা পায়নি, পেয়েছিল ইংরেজ পদলেহী রাজা ও নবাবরা। তেমনি ৭ নভেম্বরের সিপাহী বিদ্রোহ সিপাহীদের জীবনে কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি। এর সুফল ভোগ করেছে জিয়া পরিবার, কিছু কায়েমী স্বার্থবাদী দুর্নীতিবাজ সামরিক অফিসার, বেসামরিক আমলা ও যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-মুসলিম লীগ চক্র।


লেখক: ঘাতক নির্মূল কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক