স্কুল জীবনে বঙ্গবন্ধু ভালো ফুটবল খেলতেন। ফুটবল খেলে তিনি অনেকবার চ্যাম্পিয়নও হয়েছেন। অধিনায়ক হিসেবে সে সময় দেশের অন্যতম সেরা ফুটবল ক্লাব ঢাকা ওয়ান্ডারার্সকে জিতিয়েছিলেন শিরোপা। বঙ্গবন্ধু ১৯৪০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত টানা আট বছর ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের জার্সি গায়ে স্ট্রাইকার পজিশনে খেলেছেন। ১৯৪৩ সালে বগুড়ায় আয়োজিত একটি ফুটবল টুর্নামেন্টে বঙ্গবন্ধুর অধিনায়কত্বে শিরোপা জিতেছিল ওয়ান্ডারার্স।
চোখের সমস্যার কারণে বঙ্গবন্ধুর পড়াশুনা কিছুদিন বন্ধ ছিলো। তখন তিনি পিতার চাকরিসূত্রে মাদারিপুর থাকতেন। হাতে ছিলো অফুরন্ত সময়। তখন থেকেই তিনি ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সময়কালটা তখন ১৯৩৬-৩৭ সাল হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে লিখেছেন—
চোখের চিকিৎসার পর মাদারীপুরে ফিরে এলাম, কোন কাজ নেই। লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই, শুধু একটামাত্র কাজ, বিকালে সভায় যাওয়া। তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন ইংরেজের আতঙ্ক। স্বদেশী আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে। আমার মনে হত , মাদারীপুরে সুভাষ বোসের দলই শক্তিশালী ছিলো। পনের-ষোলো বছরের ছেলেদের স্বদেশীরা দলে ভেড়াত। আমাকে রোজ সভায় বসে থাকতে দেখে আমার উপর কিছু যুবকের নজর পড়ল। ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হল। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম। এই সভায় যোগদান করতে মাঝে মাঝে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর যাওয়া-আসা করতাম। আর স্বদেশী আন্দোলনের লোকদের সাথেই মেলামেশা করতাম। গোপালগঞ্জের সেই সময়ের এসডিও আমার দাদা খান সাহেবকে একদিন হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন, এ গল্প আমি পরে শুনেছি।
কলকাতার তালতলা থানার বেকার হোস্টেল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১০ সালে। ৮, স্মিথ লেনের এই হোস্টেলে থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন। এখন ইসলামিয়া কলেজের নাম হয়েছে মৌলানা আজাদ কলেজ। বেকার হোস্টেল সরকারি হোস্টেল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মুসলিম ছাত্রদের কলকাতায় এসে পড়াশোনা করার জন্য এটি তৈরি হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে কলকাতার বেকার হোস্টেলে ওঠার বর্ণনা পাওয়া যায়— “পরীক্ষা দিয়ে কলকাতায় যাই। সভা–সমাবেশে যোগদান করি। আবার পড়তে শুরু করলাম। পাস তো আমার করতে হবে। শহীদ সাহেবের (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) কাছে এখন প্রায়ই যাই।… এই বৎসর আমি দ্বিতীয় বিভাগে পাস করে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে বেকার হোস্টেল থাকতাম।”
ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে ছিলেন। কারাগারে বসেই তিনি আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৩৮ সালে প্রথম কারাগারে যান। এরপর ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত তিনি পাঁচ দিন কারাগারে ছিলেন। একই বছর ১১ সেপ্টেম্বর আটক হয়ে মুক্তি পান ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি। এ দফায় তিনি ১৩২ দিন কারাভোগ করেন। এরপর ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল আবারও কারাগারে গিয়ে ৮০ দিন কারাভোগ করে মুক্তি পান ২৮ জুন। ওই দফায় তিনি ২৭ দিন কারাভোগ করেন। একই বছরের ১৯৪৯ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৩ দিন এবং ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টানা ৭৮৭ দিন কারাগারে ছিলেন। তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট কোঠায় বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা। কেমন করে তার সাথে আমার পরিচয় হলো, কেমন করে তার সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম, কিভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তার স্নেহ আমি পেয়েছিলাম।” বঙ্গবন্ধু ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্নেহধন্য। বঙ্গবন্ধুর সাথে সোহরাওয়ার্দীর প্রথম সাক্ষাত ঘটে ১৯৩৮ সালে। তখন শেখ মুজিবের বয়স ১৮ বছর। সে সময় বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, শ্রমমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের চারজন বিশাল মাপের নেতা ছিলেন তখন শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশেম এবং মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ইতিহাসের যে প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু রাজনীতির মাঠে পদচারণা করেন তখন এই চার নেতার স্নেহ-শুভাশিস নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে এগাতে হয়েছে। এরমধ্যে শেখ মুজিবের আদর্শ নেতা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের সময় তরুণ শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে ঘনিষ্টভাবে কাজ করার সুযোগ পান। ১৯৪৩ সালে খাজা নাজিমউদ্দীন যখন প্রধানমন্ত্রী হন, সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে এ মন্ত্রীসভায় সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী করা হয়। দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে সোহরাওয়ার্দী সাহেব মন্ত্রীত্ব নেওয়ার পর গ্রামে গ্রামে লঙ্গরখানা খোলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন— “আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেকগুলি লঙ্গরখানা খুললাম। দিনে একবার করে খাবার দিতাম। মুসলিম লীগ অফিসে, কলকাতা মাদ্রাসায় এবং আরও অনেক জায়গায় লঙ্গরখানা খুললাম। দিনভর কাজ করতাম, আর রাতে কোনদিন বেকার হোস্টেলে ফিরে আসতাম, কোনদিন লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে থাকতাম।”
এটি শেখ মুজিবের প্রথম চীন সফর। এই সফরে তিনি চীনের অবিসংবাদিত নেতা মাও সে তুং এর সঙ্গে দেখা করেন। সফরকালে তিনি গভীরভাবে চীনের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন। পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ-এইড দফতরের মন্ত্রী থাকাকালে পাকিস্তান সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে তিনি দ্বিতীয় বার চীন ভ্রমণ করেন। চীন ভ্রমণের এসব অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি একটি ডায়েরি লেখেন, যেখানে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান ও চীনের রাজনৈতিক-আর্থসামাজিক অবস্থার তুলনা, কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের চর্চা প্রভৃতি বিষয়াদি প্রাঞ্জলভাবে আলোচনা করেন। তিনি তাঁর এই লেখার নাম দেন ‘নয়া চীন ভ্রমণ’। এ ডায়েরিটিই ‘আমার দেখা নয়া চীন ‘ নামে বই আকারে প্রকাশ করা হয়। ২০২০ সালে বাংলা একাডেমী বইটি একুশে বইমেলায় প্রকাশ করে। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর বদলে যাওয়া চীন বঙ্গবন্ধুকে বিশেষভাবে আন্দোলিত করেছিলো। নতুন সমাজতান্ত্রিক চীনা সরকার যেভাবে মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলো, বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে মুগ্ধ করেছিলো। চীনা সরকারের দুর্নীত দমন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “‘নয়াচীন থেকে ঘুরে এসে আমার এই মনে হয়েছে যে, জাতির আমূল পরিবর্তন না হলে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করা কষ্টকর। নতুন করে সকল কিছু ঢেলে সাজাতে হবে। …ভিত্তিটা মজবুত করতে হয়। …তারা ভিত্তি মজবুত করে কাজ শুরু করেছে।”
পাকিস্তানের জনপ্রিয় জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ২-১২ অক্টোবর চীনের বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত এশিয়া ও প্যাসিফিক রিম পিস কনফারেন্সে যোগ দেন।
১৯৫৪ সালের ৭-১২ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দী দল দুটি ছিল মুসলিম লীগ ও যুক্তফ্রন্ট। মোট আসন ছিল ৩০৯টি। এর মধ্যে ৭২টি হিন্দু ও তফসিলি। ২৩৭টি মুসলমান আসন। ৯টি বাদে সব আসনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। যুক্তফ্রন্টের প্রধান চার নেতা ছিলেন মওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। অপরদিকে মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন নুরুল আমিন। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে ও শেরে বাংলা একে ফজলুল হক পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন। শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ আসন থেকে মুসলিম লীগ প্রার্থী ওহিদুজ্জামান ঠাণ্ডা মিয়াকে পরাজিত করে প্রাদেশিক আইনসভার এমএলএ নির্বাচিত হন। শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভায় কৃষি, ঋণ, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী ছিলেন। এই মন্ত্রিসভা বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা, ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটি ঘোষণা এবং বর্ধমান হাউসকে বাংলা একাডেমি করার প্রস্তাব গ্রহণ করে। পরবর্তীতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রাদেশিক সরকারকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে ও গভর্নরের শাসন চালু করে।
আইয়ুব খান ছিলেন সম্পূর্ণরূপে অগণতান্ত্রিক ব্যক্তি। তিনি বলেছিলেন যে, পাকিস্তান গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নয়, এবং রাজনীতিবিদরা দেশের সমস্ত বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী। তিনি রাজনীতিবিদ এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উভয়ের হাত থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন। এ জন্য তিনি ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সমস্ত রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত/নিষিদ্ধ করে দেন। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর জেনারেল আইয়ুব খান ‘পাবলিক অ্যান্ড রিপ্রেজেন্টেটিভ অফিস ডিসকোয়ালিফিকেশন অ্যাক্ট (প্রোডা) পাবলিক অফিস ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডার (পিওডিও) নামে একটি নতুন আইন দিয়ে প্রতিস্থাপন করেন, যা ইলেকটিভ বডিজ ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডার (ইবিডিও) দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় আগস্ট ১৯৫৯-এ।
১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের নিরাপত্তা আইনের অধীনে করাচিতে গ্রেফতার হন, যা তাকে এক বছরের জন্য বিনা বিচারে আটক রাখার অনুমোদন দেয়। যখন লাহোর হাইকোর্টে তার অবৈধ আটককে চ্যালেঞ্জ করে একটি হেবিয়াস কর্পাস পিটিশন দাখিল করা হয়, তখন আইয়ুব খান পাকিস্তানের নিরাপত্তা আইনের অধীনে আটক ব্যক্তিদের হেবিয়াস কর্পাস অধিকার স্থগিত করে একটি অধ্যাদেশ জারি করেন।