জেলায় জেলায় রাজাকারের তালিকা করতে নতুন উদ্যোগ

রাজাকারের কোরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ নিচ্ছে

মহান মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডারদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি হবে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যদের তালিকা। এর আগে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হলেও তাতে কাঙ্ক্ষিত সাড়া মেলেনি। তাই রাজাকারের তালিকা করতে জেলা প্রশাসকদের নয়, শিগগিরই প্রতিটি উপজেলায় যুদ্ধকালীন কমান্ডারদের চিঠি দেবে সরকার। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ তালিকা প্রণয়ন করবে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। ওই তালিকা চূড়ান্ত করে গেজেট আকারে প্রকাশ করবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ কারণে ৭ ডিসেম্বর (২০২০) মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হয় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০২০-এর খসড়া।

রাজাকার বাহিনী
রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা কোরআন শরীফ হাতে নিয়ে শপথ নিচ্ছে। শপথটি ছিল- “I shall bear true allegiance to the constitution of Pakistan as framed by law and shall defend Pakistan, if necessary, with my life.” অর্থাৎ, “আমি আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের সংবিধানের প্রতি সত্যিকার আনুগত্য প্রদর্শন করব এবং প্রয়োজনে জীবন দিয়ে হলেও পাকিস্তানকে রক্ষা করব।” জীবন দিয়ে তারা পাকিস্তান রক্ষা করেনি, কিন্তু জীবন কেড়ে  নিয়েছিল তারা পঞ্চাশ লক্ষাধিক। বর্বরতার সে ইতিহাস ভুলতে গিয়ে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যে ভুল করেছিল, সে ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। তথ্যসূত্র: জেনোসাইড আর্কাইভ

 

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও জামুকার চেয়ারম্যান আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘রাজাকারের নির্ভুল তালিকা তৈরি করতে জামুকার বিদ্যমান আইন সংশোধন করা হয়েছে। আগের আইনে রাজাকারের তালিকা তৈরি করার কোনো ক্ষমতা ছিল না।’

রাজাকারের তথ্য চেয়ে যুদ্ধকালীন কমান্ডারদের কাছে চিঠি পাঠানো হবে জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত রাজাকারের আংশিক তালিকা স্থগিত করার পর এ বিষয়ে তেমন অগ্রগতি নেই। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বে সংসদীয় উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের সুপারিশেই আইন সংশোধন করে রাজাকারের তালিকা করার ক্ষমতা জামুকাকে দেওয়া হয়েছে। এর আগে রাজাকারের তথ্য চেয়ে জেলা প্রশাসকদের একাধিক চিঠি দেয়া হলেও কাঙ্ক্ষিত সাড়া মেলেনি। তাই এবার জেলা প্রশাসকদের নয়, রাজাকারের তথ্য চেয়ে প্রতিটি উপজেলার যুদ্ধকালীন কমান্ডারদের চিঠি দেওয়া হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই তৈরি করা হবে রাজাকারের তালিকা।’

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলকে রাজাকারের তালিকা করার ক্ষমতা দিয়ে সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার ভার্চুয়াল বৈঠকে ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০২০’ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্য হিসেবে কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন বা আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে সশস্ত্র যুদ্ধে নিয়োজিত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, তাদের একটা তালিকা প্রণয়ন ও গেজেট প্রকাশের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করবে মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল। রাজাকারের তালিকা করার বিষয়টি খসড়া আইনে রাখা হয়েছে। আইনে সব বিষয়ে ডিটেইল করা নেই, এটা রুলস্ করবে। স্বাধীনতাবিরোধী বলতে কী বোঝাবে, রুলে তা বিস্তারিত বলা থাকবে। আগে আইন হোক, এরপর বিধি করা হবে।’

প্রায় এক দশক আগে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর রাজাকারের তালিকা তৈরির দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছর বিজয় দিবসের আগের দিন সংবাদ সম্মেলন করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ১০ হাজার ৭৮৯ জন ‘স্বাধীনতাবিরোধীর’ তালিকা প্রকাশ করেন। কিন্তু ওই তালিকায় গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের নাম আসায় ক্ষোভ আর সমালোচনার প্রেক্ষাপটে সংশোধনের জন্য ওই তালিকা স্থগিত করা হয়। এ বছর জানুয়ারিতে সংসদেও এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে। খোদ সরকারি দলের সদস্যরাই এ নিয়ে মন্ত্রী সমালোচনায় মুখর হন। সেসময় মন্ত্রী নতুন করে তালিকা তৈরির কথাও জানান। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একটি উপকমিটি ওই তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে। তবে জামুকার মাধ্যমে রাজাকারের তালিকা তৈরির বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, ‘শুধু জামুকার কর্মকর্তাদের মাধ্যমে রাজাকারের তালিকা করলে তা মুক্তিযোদ্ধার তালিকার মতো জগাখিচুড়ি হবে। ১১ বছরেও তারা প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করতে পারেনি। রাজাকারের বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকদের বিভিন্ন বই, সাময়িকী ও লেখা রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন জেলার সুনির্দিষ্ট রাজাকারের তালিকা রয়েছে। সেগুলো জামুকার একটি তথ্যের উৎস হতে পারে। মোট কথা, এই তালিকা প্রণয়নে গবেষকদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নইলে এর সফলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধে জড়িত চিহ্নিত পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরদের বিচার করার উদ্যোগ নেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)। এর প্রাথমিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের ২৫ জানুয়ারি পাকসেনা ও তাদের দোসরদের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের তথ্য চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে জেলা প্রশাসক ও কারা মহাপরিদর্শককে চিঠি দিয়েছিল আইসিটি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কারা মহাপরিদর্শককে দেয়া আইসিটির এক চিঠিতে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের সব এলাকায় যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, ধর্মান্তরিতকরণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধ শেষে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা আত্মসর্মপণ করে। এ সময় পাকসেনা বাহিনীর কমান্ডার বা অফিসার ও সদস্যদের অনেককেই গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়। সে মোতাবেক তাদের ওই সময় যেসব কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল সেখানে তাদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। এমন বিবেচনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এসব পাকসেনার নাম-পরিচয় ও জেলখানার নাম, মামলা নম্বর ও অন্য তথ্যাদি চায় আইসিটি। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সাড়া মেলেনি তাতে।

সূত্র: যুগান্তর