নতুন প্রজন্মের কাছে এক মুক্তিযোদ্ধার খোলা চিঠি // বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল

দেবেশ চন্দ্র স্যানাল

প্রিয় প্রজন্ম,
তোমরা আমার ভালোবাসা নিও। তোমরা লেখাপড়া কর, মানুষের মতো মানুষ হও। তোমরা সৎ ও দেশপ্রেমিক হও। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন বাঙালি জাতির বিভিন্ন গৌরবময় অর্জনের মধ্যে অন্যতম। তোমরা লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ সুবিধা মতো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়বে। তাহলে বাঙালিদের বীরত্বগাঁথা জানতে পারবে।

আমরা ব্রিটিশদের শাসন শোষনের হাত থেকে মুক্ত হয়েছিলাম ১৯৪৭ সালে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিলো। পাকিস্তানি রাষ্ট্রের দুইটি অংশ ছিলো। আমাদের অংশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের শাসন করতো পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক। তারা শাসনের নামে পূর্ব পাকিস্তানি ও বাঙালিদের শোষণ, নির্যাতন ও নিপীড়ণ করতো। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থানগত দূরত্ব ছিল ১০০০ কিলোমিটারের অধিক। তারা আমাদের ন্যায্য অধিকার দিত না। চাকরি ও অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে আমাদেরকে বঞ্চিত করত। পূর্ব-পাকিস্তানের সম্পদ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে কলকারখানা বানাতো।

১৯৫২ সালে পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নিয়েছিলো। কিন্তু বাঙালিদের আন্দোলনের কারণে পারে নাই। বাংলা ভাষাকে রক্ষার জন্য রফিক, শফিক, বরকত ও জব্বার সহ অনেকে শহীদ হয়েছেন। শহীদ মিনার বাঙালিদের ভাষা আন্দোলনের স্মারক।

বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের পর ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২ টি আসনের ১৬০টিতে গণভোটে বিজয়ী হয় তৎকালীন বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ আনুপাতিক হারে আরো ৭টি সংরক্ষিত আসনের অধিকারী হয়। মোট ১৬৭টি জাতীয় পরিষদের আসনের অধিকারী হয়ে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তখন দেশের সামরিক প্রেসিডেন্ট ছিলেন সেনবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান।

বাঙালিদের বিজয়ে বিহারী শাসক সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি ষড়যন্ত্র শুরু করলেন। সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল বাতিলের পরিকল্পনা করলেন। ২২ ফেব্রুয়ারি ’৭১, পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলদের এক বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গোপন নির্দেশ দিলেন— আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থকদের হত্যা করুন। তাহলে বাকিরা আমাদের বশ্যতা স্বীকার করবে।

তার ধারণা ছিলো নির্যাতন করে লাখ তিনেক বাঙালি হত্যা করলেই আন্দোলন থেমে যাবে। কালক্ষেপন করে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য ১৩ ফেব্রুয়ারি ’৭১ ইয়াহিয়া খান মিথ্যা আশ্বাস দিলেন যে, ৩ মার্চ ’৭১ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হবে। ১৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে পার্লামেন্টারি নেতা নির্বাচন করা হয়। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান দুপুরে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া বেতার ভাষণে ৩ মার্চ আহুত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বে-আইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলেন।

বেতার ভাষণ শুনে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দিলেন। সারা দেশের মানুষ বাঁশের লাঠি হাতে রাস্তায় নেমে এলেন। পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানো শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চ জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালনের নির্দেশ দিলেন। ২মার্চ ঢাকায় এবং ৩-৫ সারাদেশব্যাপী অর্ধদিবস হরতাল আহবান করলেন। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় জাতীয় সংগীত হিসেবে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আমার সোনার বাংলা…” গানটি নির্বাচিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও জাতির পিতা ঘোষণা দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের ইশতেহার পাঠ এবং কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হলো। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়ানো হলো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ষড়যন্ত্র জাতির পিতা বুঝতে পারলেন। ৭ মার্চ ’৭১ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির পিতা বললেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…।” ১৫ মার্চ নতুন কুটকৌশল নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। ১৬ মার্চ থেকে কালক্ষেপন ও ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের প্রস্তুতিমূলক কার্যাদি করার জন্য সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রহসনমূলক আলোচনা শুরু করেন।

অন্যদিকে গোপনে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও গোলা বারুদ আনতে থাকেন। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক লেঃ জেনারেল টিক্কাখান ও অন্যদের দিয়ে বাঙালি নিধনযজ্ঞ চালানোর জন্য ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। ২৫ মার্চ বিকাল পৌঁনে ৬টায় আলোচনা শেষ না করে অপারেশন সার্চ লাইট নামক বাঙালি নিধনযজ্ঞ চালানোর নির্দেশ দিয়ে প্রেসিডেন্ট বিশেষ বিমান যোগে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান।

পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি সৈনিক, ইপিআর ও অন্যান্যদের নিরস্ত্র করে আটক করতে থাকলো। অবস্থা বুঝে বাঙালি সৈনিক ও ইপিআরের অনেকে অস্ত্র নিয়ে, কেউ কেউ জীবন বাঁচানোর জন্য খালি হাতে পালিয়ে এলেন। ২৫ মার্চ’ ৭১ রাত সাড়ে ১১টার পর টিক্কা খান মর্টারশেল, কামান ও অন্যান্য ভারী অস্ত্র নিয়ে অপারেশন সার্চ লাইট শুরু করেন। তারা একযোগে পিলখানা ইপিআর ক্যাম্প, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, জগন্নাথ হল, ইকবাল হল ও অন্যান্য স্থানে আক্রমণ করে। ঢাকা সহ অন্যান্য শহরে গণহত্যা শুরু করে। নিরীহ, ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। পাখির মতো লোক হত্যা করে। বস্তি ও অন্যান্য স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়।

বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় অনিবার্য এক যুদ্ধ— মুক্তিযুদ্ধ। দেশের সার্বিক অবস্থা দেখে ও বুঝে ২৬ মার্চ’ ৭১, প্রথম প্রহরে রাত ১২.২০মি.-এ ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বর নিজ বাড়িতে উপস্থিত নেতা কর্মীদের সম্মুখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। জাতির পিতার স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা ই.পি.আর-এর ওয়ারলেসযোগে মগবাজারের টেলিগ্রাম অফিসের মাধ্যমে চট্রগ্রাম সহ দেশের সর্বত্র প্রেরণ করা হয়। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা– ইপিআর, আনসার ও ছাত্র-জনতা প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। রাত ১.১০টার পর জাতির পিতাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ঢাকা সেনা নিবাসে নিয়ে যায়। পরের দিন জাতির পিতাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।

২৬ মার্চ ’৭১, চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে দুপুর ১.১০মি. এর পর জাতির পিতার স্বাধীনতা ঘোষনার বার্তাটি পাঠ করেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এম,এ হান্নান। ২৭মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার বার্তা পাঠ করেন তদানীন্তন মেজর জিয়াউর রহমান। তখন সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সারাদেশ তাদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কার্যক্রম শুরু করে নির্মম গণহত্যার মধ্য দিয়ে। মো: নুরুল আমিন ও অধ্যাপক গোলাম আযম সহ ১২জন ইসলামী বিভিন্ন ইসলামী দলের নেতা টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। টিক্কা খান স্বাধীনতা বিরোধীদের এই বলে প্রলোভন দেন যে, ৭ ডিসেম্বর ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচন বাতিল করা হবে। স্বাধীনতা ঘোষণা করার কারণে আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্টকে নিষিদ্ধ ও দেশদ্রোহী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রেসিডেন্টের সাথে আমার কথা হয়েছে। দেশদ্রোহী হিসেবে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মামলা করে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে। নির্যাতন, ধর্ষণ ও জ্বালাও পোড়াও করে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী ও ভারতের দালাল হিন্দুদেরকে শেষ করে দেওয়া হবে। আপনারা আমাদের সহযোগিতা করুন। পুনরায় সাধারণ নির্বাচন দিয়ে ইসলামী দলগুলোর হাতে পূর্ব-পাকিস্তানের ক্ষমতা দেওয়া হবে।

টিক্কা খানের প্রলোভনে ইসলামী দলগুলোর অধিকাংশ নেতারা পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করে। স্বাধীনতা বিরোধীরা পীচ কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ ও অন্যান্য বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। জীবনের ভয়ে কিছু আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী ও এ দেশের অধিকাংশ হিন্দুরা ভারতে আশ্রয় নিতে চেষ্টা করে। যেহেতু হিন্দুদের নারীশিশু নির্বিশেষে নির্বিচারে টার্গেট করা হয়েছিলো, ফলে হিন্দুদের পালানো ছাড়া কোনো বিকল্প ছিলো না।

১০ এপ্রিল ’৭১, ৭ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত এম.এন.এ. ও. এম.পি.দের নিয়ে বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। ১৭ এপ্রিল ’৭১, মুজিব নগরে বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে। মহান মুক্তিযুদ্ধ কী, কীভাবে যুদ্ধ করতে হবে, কতদিনে দেশ স্বাধীন হবে, একটি প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত পেশাদার হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করা সম্ভব কিনা, ভারত ‍যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের অন্যান্য কয়েকটি শক্তিশালী দেশের চাপে বাংলাদেশকে সহযোগীতা করতে পারবে কিনা ইত্যাদি বোঝার বয়স তখন আমার হয়নি। আমি তখন রতনকান্দি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। সকলের আলোচনা ও স্থানীয় প্রাদেশিক সদস্য জনাব এ্যাড. মো: আব্দুর রহমান স্যারের কাছ থেকে সব কথা শুনে জাতির ক্রান্তিকালে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।

২৩ জুলাই ’৭১ (৬ শ্রাবণ ১৩৭৯), শুক্রবার হঠাৎ করেই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার একটা সুযোগ এলো। আমাদের শাহজাদপুরের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জনাব এ্যাড মোঃ আব্দুর রহমান সাহেব মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ দিতে ইচ্ছুকদের ভারতে নিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের গ্রামের সুনিল কুমার হাজরা সহ আমরা ২২জন তার সাথী হই। আমাদের ঘাট থেকে নৌকা ছাড়া হলো। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা দেখে শুনে ভোরে আমাদের কে নামিয়ে দেওয়া হলো সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া নামক স্থানে। হেঁটে সুজানগরের একটি নিভৃত গ্রামে গেলাম। এক আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে আশ্রয় নিলাম, খাওয়া দাওয়া করলাম। এম.পি.এ স্যার পদ্মা পার হয়ে কুষ্টিয়া যাওয়ার জন্য নৌকা ভাড়া করলেন। সবাই বললো, দিনের বেলা পদ্মা পার হওয়া যাবে না। পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকাররা স্পিডবোটে করে পদ্মা নদীতে টহল দেয়। তারা নৌকা ধরলে সবাইকে নির্যাতন করে হত্যা করবে। দিনে সুজানগরের ঐ গ্রামে থাকলাম। রাত ৯টায় সাতবাড়িয়া ঘাটের নিকট থেকে নৌকাযোগে কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। রাত ২টার পর কুষ্টিয়া জেলার এক নিভৃত গ্রামে পৌঁছালাম। তারা কাঁঠাল গাছ থেকে কাঁঠাল পেড়ে মুড়ি দিয়ে আমাদের খাওয়ায়। জানা গেল স্থানটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। অদূরে পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকার ক্যাম্প আছে। গ্রামেও পীচ কমিটির সদস্য আছে। তারা জানতে পারলে পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকারদের হাতে ধরিয়ে দেবে। পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকাররা নির্যাতন করে হত্যা করবে সবাইকে। ডাল ভাত রান্না হলো। আমরা তাড়াহুড়া করে খেয়ে হেঁটে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

রাতে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতেই পথ চলা। এম.পি.এ স্যারের হেঁটে চলা কষ্ট হচ্ছিল। সুনিল কুমার হাজরা, মো: এরশাদ আলী, মো: আব্দুর রাজ্জাক ও অন্যান্যরা পর্যায়ক্রমে এম.পি.এ স্যারকে ধরে হাটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ভোরে নিরাপদে ভারতের নদীয়া জেলার জলঙ্গী বর্ডার পার হলাম। বর্ডারের কাছেই ছিল বি.এস.এফ ক্যাম্প। বি.এস.এফ ক্যাম্পে ঢুকে সবাই প্রস্রাব পায়খানা করে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। যার যার কাছে বাংলাদেশী টাকা ছিল তা বদলিয়ে নিলো। এম.পি.এ স্যার মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র— কামার পাড়া যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যাবার জন্য বাসের ব্যবস্থা করলেন। আমাদেরকে নিয়ে গেলেন মালদহ শহরে। মালদহ শহরে কাঁঠাল ও মুড়ি খাওয়ালেন। এম.পি.এ স্যার আমাদেরকে সব বুঝিয়ে বালুর ঘাটের নিকটে কামার পাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে তিনি প্রবাসী সরকারের উদ্দেশ্যে কলকাতা রওনা হলেন।

আমরা রাত ৯টায় কামারপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে পৌঁছালাম। আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হলো। পরদিন ফলোইন করিয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়ানো হলো ও পিটি প্যারেড করানো হলো। আমাদের কয়েকজনকে কুড়মাইল ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হলো। পরের দিন মালঞ্চ ক্যাম্পে স্থানাস্তর করা হলো। পরেরদিন পতিরাম ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হলো। দু’দিন পর পতিরাম ক্যাম্প থেকে ভারতীয় সেনা ট্রাকে শিলিগুড়ির পানিঘাটা নামক মুক্তিযোদ্ধা হায়ার ট্রেনিং ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হলো। পানিঘাটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে শিখ সেনা ডি.এস ভিলনের নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাদের দ্বারা বিভিন্ন অস্ত্রের প্রশিক্ষণ হলো। থ্রি নট থ্রি রাইফেল, এলএমজি, স্টেনগান, হ্যান্ড গেনেড, ও অন্যান্য অস্ত্রের ওপর ২১ দিনের প্রশিক্ষণ হলো। আমার এফ এফ নম্বর হলো-৪৭৪২। আমাকে পানি ঘাটা থেকে ৭নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার পশ্চিম দিনাজপুরের তরঙ্গপুর নিয়ে আসা হলো। আমাদের প্রত্যেকের নামে অস্ত্র ইস্যু করা হলো। একই এলাকার রাস্তা চেনা মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে ১০ সদস্যের একটি গ্রুপ করা হলো। গ্রুপ কমান্ডার নিযুক্ত হলেন বেলকুচি উপজেলার তামাই গ্রামের জনাব এম.এ. মান্নান, ডেপুটি কমান্ডার নিযুক্ত হলেন শাহজাদপুর উপজেলার বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচী।

আমাদেরকে রেশনিং ও পকেট মানির টাকা দেওয়া হলো। তরঙ্গপুর বাজার থেকে আমি একখানা শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থ, বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত একটি জাতীয় পতাকা ও একটি চার ব্যান্ডের রেডিও ক্রয় করলাম। তরঙ্গপুর থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে কালীয়াগঞ্জ পর্যন্ত বাসে এসে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেনে শিলিগুড়ি রেলওয়ে জংসনে এলাম। শিলিগুড়ি জংসন থেকে ট্রেন বদলি হয়ে আসামের ধুবরী স্টেশনে এলাম। ধুবরী স্টেশন থেকে বাস যোগে মানিকার চর এলাম। রাত হয়ে পড়ায় রাতে মানিকার চরে একটি বোর্ডিং-এ থাকলাম। পরের দিন সকালে মানিকার চর নদী পার হয়ে তদানিন্তন রংপুর জেলার মুক্তাঞ্চল (বর্তমানে কুড়িগ্রাম জেলার) রৌমারীতে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে এলাম। এখানে খাওয়া-দাওয়া করলাম।

আমাদের কমান্ডার স্যার সিরাজগঞ্জ চরে পৌঁছার জন্য নৌকা ভাড়া করলেন। সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমাদের নৌকা ছাড়লো। বাহাদুরাবাদ, ফুলছড়ি, জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের সম্মুখ দিয়ে আসতে হয়। তাছাড়া বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সৈনিক ও রাজাকারদের ক্যাম্প। তারা নদী পাহারা দেয়। প্রতিটা মুহুর্ত ছিলো ঝুঁকিপূর্ণ। সব চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাহাদুরাবাদ ঘাট। পাকিস্তানি হানাদাররা স্পিডবোট দিয়ে নদী টহল দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা পেলে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করে। বাহাদুরাবাদ ঘাট অতিক্রম করার পূর্বে কমান্ডার স্যার নির্দেশ দিলেন— ‘আপনারা সবাই নৌকার ডওরার মধ্যে পজিশন অবস্থায় থাকুন। পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকাররা স্পিডবোট নিয়ে ধরতে এলে আমরা ধরা দিব না, যুদ্ধ করব। যুদ্ধে শহীদ হব কিন্তু হায়েনাদের হাতে ধরা দিয়ে নির্যাতীত হয়ে জীবন দিব না।’

রাত ২ টার দিকে বাহাদুরবাদ ঘাটের সম্মুখ দিয়ে নৌকা অতিক্রম করতে থাকলো। সার্চ লাইটের আলো এসে নৌকায় পড়ছিল। ভাগ্যক্রমে হানাদাররা স্পিডবোট নিয়ে আমাদের কে ধরতে এলো না। বাহাদুরাবাদ ঘাট অতিক্রম করে এক কাইশা বনের মধ্যে নৌকা লাগিয়ে দিল। আমরা প্রস্রাব পায়খানা করে নিলাম। আমাদের সঙ্গে চিড়াগুড় ছিলো। সকলে চিড়াগুড় দিয়ে সকালের খাবার খেলাম। দেখে শুনে থেমে থেমে মাঝিরা নৌকা চালাচ্ছিলো। আমরা নৌকায় ঘুম ও বিশ্রাম নিতে থাকলাম। নৌকায় ডালভাত রান্নার ব্যবস্থা ছিল। মাঝিরা ডাল ভাত রান্না করে আমাদের খাওয়ালো। আমরা দুপুর ও রাতের খাবার খেলাম। এভাবে মাঝিদের রান্না করা খাবার খেতে খেতে চার দিন পর ভোর ৫টায় গিয়ে সিরাজগঞ্জের স্বাধীন এলাকা যমুনার চর পৌছালাম। নৌকায় শেষরাত ও পরের দিন সারাদিন যমুনার চরে থাকলাম। পরের রাতে যমুনা পার হয়ে কামারখন্দ বেলকুচি নির্বাচনী এলাকার এম.এন.এ জনাব মোঃ আব্দুল মোমিন তালুকদারের গ্রামের বাড়ি এলাম।

এম.এন.এ স্যার বাড়িতে ছিলেন না। তার ভাই জনাব মো: রশিদ তালুকদার আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। আমরা বেলকুচি থানার বিভিন্ন গ্রামে থাকতে থাকলাম। আজ এখানে কাল সেখানে থাকতে থাকলাম। আমরা দিনের বেলা রেকি করতাম। রাতে আজ এ থানা কাল এ রাজাকার ক্যাম্প আক্রমন করতে থাকলাম। প্রতি রাতে কমান্ডার স্যার আমাদের কে পাসওয়ার্ড দিতেন। প্রতিদিন সকালে আমরা অস্ত্রে ফুল থ্রু মারতাম ও পরিষ্কার করতাম। আমরা তিনটি হিট এন্ড রান কার্যক্রম করেছি। আমরা বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধ, কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ব্রিজ সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্প এ্যাম্বুস, কল্যানপুর ও শাহজাদপুর থানার ধীতপুর নামক স্থানে পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়েছি।

প্রিয় ছোট্ট বন্ধুরা,

তোমরা লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়বে। আমরা চাই তোমরা উচ্চশিক্ষিত, মানবীয় গুণসম্পন্ন এবং দেশ প্রেমিক হয়ে জীবন গড়ো।


ইতি,
বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল, পিতাঃ দ্বিজেন্দ্র নাথ সান্যাল, মাতাঃ নীলিমা রাণী সান্যাল। জন্মঃ ১৯৫৪ সালের ২৬ নভেম্বর। গ্রাম ও ডাকঘরঃ রতনকান্দি, ইউনিয়ন পরিষদঃ হাবিবুল্লাহ নগর, উপজেলাঃ শাহজাদপুর, জেলাঃ সিরাজগঞ্জ।