Headlines

যেভাবে মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী কমান্ডারের জীবন বাঁচানোর কথা বলেছেন মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ তোফাজ্জল হোসেন

Syed Toffazzal Hossain

দিনটি ছিল ১২ নভেম্বর (১৯৭১)। ঐ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর বড় ক্যাম্প ছিল মাদারটেক। এছাড়া রামপুরা টিভি সেন্টারে তাদের ক্যাম্প ছিল। এখন যেখানে আফতাবনগর বা জহুরুল হক সিটি, ওখানে ছাইতানতলী নামে ছোট্ট একটি গ্রাম ছিল। ঐ গ্রামেও পাকিস্তানি বাহিনী ছোট্ট একটি ক্যাম্প করেছিল। ক্যাম্পগুলো থেকে ভিন্ন ভিন্ন দল এসে এলাকায় টহল দিত। ঐ দিনও পাকিস্তানি বাহিনী এই এলাকায় টহল দিচ্ছিল।

১১ নভেম্বর সন্ধ্যের পরে মেরাদিয়া বড় বাড়ীর মতি ভাইয়ের কাছে (মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মতিন) একটি স্টেনগান রেখে গোরানে আমার আস্তানায় গিয়ে ঘুমাই। পরের দিন সকাল বেলা শুনি মেরাদিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী আসছে। তখন হালকা শীত ছিল— তখন তো এই এলাকাটি গ্রাম, গাছপালা জঙ্গলে ঘেরা, শীতকালে ভালো শীত পড়ত। আমি একটি চাদর গায় দিয়ে মেরাদিয়া এলাকায় অলি মাতব্বরের বাড়ির কাছে এসে দেখি লিয়াকত ভাই তার লোকজন নিয়ে পশ্চিম দিকে যাচ্ছে, আমি পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে আসছিলাম।

আমি লিয়াকত ভাইকে বললাম, তুমি কোথায় চলে যাচ্ছ, আমি তো শুনলাম এদিকে পাকিস্তানি বাহিনী আসছে? উনি বললেন, আমার কাছে তো কোনো অস্ত্র নেই, আমার কাছে একটা টু-টু পিস্তল আছে শুধু। আমি তখন ওনাকে বললাম, আমার কাছে একটা স্টেনগান আছে। তখন আমরা দুজন নয়াপাড়ার (বর্তমান নাম নয়াপাড়া) আইয়ুব আলী মাতব্বরের ভাই জাফর আলী মাতব্বরের টিনের ঘরে গিয়ে বসি।

লিয়াকত ভাই আমাকে বললেন, তুমি বসো, আমি একটু দেখে আসি। দেখতে গিয়ে লিয়াকত ভাই একজন রাজাকার এবং দুজন পাকিস্তানি বাহিনীর সামনে পড়ে যান। ওরা লিয়াকত ভাইকে বেদম প্রহার করে ছোট নৌকায় করে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমি এসব কিছুই জানি না। এর মধ্যে হঠাৎ করে একজন মহিলা এসে বললেন, পাঞ্জাবিরা একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে মেরে নিয়ে যাচ্ছে। আমি তখন বুঝতে পারলাম যে, লিয়াকত ভাইকেই ধরেছে। 

মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী
বীর মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী কমান্ডার। বর্তমানে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ২২ নং ওয়ার্ডের কমিশনার। ওনার জীবন রক্ষা করেছিলেন আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা, যিনিও কমান্ডার ছিলেন- সৈয়দ তোফাজ্জল হোসেন। যদিও সৈয়দ তফাজ্জ্বল হোসেনের এ দাবীর সাথে একমত নন মেরাদিয়াবাসী এবং মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী। লিয়াকত আলী বরং বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জ্বল হোসেন চুক্তিমোতাবেক পাকিস্তানি সে সৈন্যটিকে ধরতে সহযোগিতা না করায় বরং তার জীবন সংশয়ে পড়ে। তফাজ্জল হোসেন ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৭৫নং ওয়ার্ডের কমিশনার। গত নির্বাচনে তাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। কোর্টে মামলাটি চলমান রয়েছে বলে তিনি জানান। 

স্টেনগানটা নিয়ে দ্রুত যাওয়ার সময় একটা খড়ের পালার পাশে গোবরের গর্তে পড়ে প্রায় কোমর অবদি ডুবে যাই। স্টেনগানটা রেখে অনেক কষ্টে উঠে গিয়ে লিয়াকত ভাইকে খুঁজে পাই। দেখি দুজন পাকিস্তানি সেনা লিয়াকত ভাইকে চেপে ধরে রাখছে। পরে বুঝতে পেরেছিলাম যে, তখনও উনি অচেতন ছিলেন। আমি কাছে যাবার আগে বন্দুক উপরে তুলে ফাঁকা আওয়াজ করি। কিন্তু চাপ লেগে ব্রাশ ফায়ার হয়ে যায়, ফলে একসাথে অনেক গুলি বের হয়ে যায়। ভয় পেয়ে একজন পাকিস্তানি সেনা দৌঁড়ে পালায়। আরেক জনকে আমি গুলি করে ফেলে দিই। রাজাকারটি তখন বন্দুক তাক করে আমার দিকে তেড়ে আসে। আমি তাকে একটা গালি দিয়ে তখন বললাম, তুই তোর লোক নিয়ে সরে যা, আমি আমার লোক নিয়ে সরে যাই। কারণ, আমি তখনও নিশ্চিত ছিলাম না যে, আমার বন্দুকে আর গুলি ছিল কিনা। রাজাকারটি এক হাতে আমার দিকে বন্দুক তাক করে আরেক হাত দিয়ে বৈঠা ঠেলে ঠেলে সরে যায়। আমি লিয়াকত ভাইকে কান্দে তুলে নিয়ে আসি। পরে বুঝতে পেরেছিলাম আমার বন্দুকে আসলেই আর গুলি ছিল না।

তখন তো এদিকে বিল ঝিল, মাঝে মাঝে টিলার মতো ছোট ছোট গ্রাম। আমি লিয়াকত ভাইকে একটি কোষা নৌকায় তুলে দাসেরকান্দি নিয়ে যাই। (আফতাবনগর বা জহুরুল হক সিটির শেষ প্রান্তে এখন গ্রামটি অবস্থিত) এখান থেকে যাওয়ার সময় বিভিন্ন দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনী বৃষ্টির মতো আমাদের দিকে গুলি ছুড়েছিল, কিন্তু ভাগ্য ভালো গুলি আমাদের গায় লাগেনি।

এর আগে— তখন বর্ষা কালেরে শেষের দিক সম্ভবত, পাকিস্তানি বাহিনীর লঞ্চ ছিনিয়ে নেওয়ার একটি ঘটনা আছে। সে ঘটনায়ও পাকিস্তানি বাহিনীর তিনজন সদস্য নিহত হয়েছিল। লঞ্চটি আমরা নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলাম। তখন বুড়িগঙ্গা থেকে ধোলাই খাল হয়ে এদিকে নৌকা চলাচল করত। পাকিস্তানি বাহিনী একটি বড় ইঞ্জিন বোট নিয়ে টহল দিত। লোকে অবশ্য ওটিকে গানবোট বলত। এটাই ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে এ অঞ্চলে আমাদের যুদ্ধের শুরু। এ ঘটনাটি অন্যদিন বলব।

এই দিনেই (১২ নভেম্বর) এই এলাকার একজন শহীদ হয়েছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনী আসার খবর পেয়ে বেশিরভাগ পুরুষ লোক এলাকা ছেড়ে এদিক ওদিক পালিয়ে গিয়েছিল। পরে যখন তারা নৌকায় করে ফিরে আসে তখন পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল নৌকা লক্ষ করে গুলি করলে আইয়ুব আলী মাতব্বর মারা যান। ইনিই মূলত মেরাদিয়া এলাকার প্রথম শহীদ। মেরাদিয়া হিন্দু পাড়ায় গণহত্যাটি ঘটেছিল আরও এক সপ্তাহ পরে— ২০ নভেম্বর তারিখে।