২৫ মার্চ, ১৯৭১ টেলিভিশনের খবর দেখে একে একে সবাই যে যার বাড়ীতে চলে গেল। একটা ক্ষীণ আশার আলো সবার মনে। হয়তো একটা সমঝোতার দিকে যাচ্ছে বৈঠক। মজিবর রহমান, সদ্য যোগদান করা অর্থনীতির অজিত কুমার ঘোষ এবং আমি আমাদের ঘরে ফিরলাম। রাত তখন ১২টা, ঢাকায় আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। আমরা এসব কিছুই বুঝতে পারিনি।
অজিত ও আমি পাশাপাশি ঘরে থাকি। মজিবর সামনের ঘরটিতে। তার পাশেই ডাইনিং রুম। মার্চের নাতিশীতোষ্ণ রাত। ঘুমটা ভালোভাবেই জডিয়ে ধরেছিল। হঠাৎ দরজায় প্রবল ধাক্কা। তাড়াহুড়ো করে মশারি থেকে বের হয়ে দরজা খুলতেই দেখি তিনটি রাইফেল আমার দিকে তাক করে আছে।
তিন জন মৃত্যুদূত গর্জন করে উঠল- “নিকালো শালা।” একজন ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লো। পিছন থেকে বুটের এক লাথি মেরে আমাকে বারান্দায় এনে ফেলল। দেখি মজিবর ও অজিত। মুখ তাদের সাদা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। তখনও অন্ধকার কাটেনি। আমার পরনে লুঙ্গি ও গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। জিজ্ঞেস করল,“আর কোই হ্যায়?” আমরা মাথা নেড়ে জানালাম ‘না’।
‘চলো’ বলে তিনটি রাইফেলের সামনে আমরা যেন কোন দোজখের দিকে রওনা দিলাম! গেস্ট হাউস থেকে নামতেই আমি ওদের ভাঙ্গা উর্দুতে বলি, “আমার চশমাটা ফেলে এসেছি। ওটা নাহলে বেশ অসুবিধা হচ্ছে।” ওদের একজন আমার চোখের সামনে একটা আঙ্গুল তুলে জিজ্ঞেস করল, ‘কতটা’?
তারপর তিনটি আঙ্গুল তুলে পরীক্ষা করলো সত্যিই চশমা ছাড়া আমি দেখতে পাই কিনা! কোনো রকমে তাদের বোঝালাম ওটা রিডিং চশমা। তখন একজন রাইফেল ধরে ঘরে নিয়ে গেল। বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে চশমাটা নিয়ে তার সঙ্গে রওনা দিলাম। জুবেরি ভবন থেকে প্যারিস রোড়ের দিকে এগিয়ে চললাম।
আম গাছগুলিতে তখন গুটি আম আসতে শুরু করেছে। আমের মুকুলের গন্ধে চারধার মৌ মৌ করছে। হাতের বামে পাঁচটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা জানলা সামান্য ফাঁক করে আমাদের মৃত্যুযাত্রা দেখছিলেন। উদ্ভিদবিদ্যার ড.জব্বার সাহেব, এবাদত হোসেন মোল্লা, বজলুল মোবিন চৌধুরি তখন সেইসব ভবনে বাস করতেন।
প্যারিস রোড়ের ডান দিকে মোড় নিতেই আদেশ আসল যাতে আমরা প্রশাসনীক ভবনের দিকে এগিয়ে চলি। উপাচার্যের বাড়ীর গেটের সামনে এসে হঠাৎ মজিবর চোস্ত উর্দুতে বলে উঠলেন, “মহম্মদ নামের একজন ভালো মানুষ ছিলেন। এরপর মহম্মদ নামের সবাই চোর বদমাশ খুনি। শুনে সেপাইরা তাকে লাথি মেরে রাস্তার ওপর ফেলে দিল। সেইসঙ্গে রাইফেলের মার। আমি ও অজিত ভয়ে শিটকে দাঁডিয়ে আছি। মজিবরকে তুলে তারা ভিসির বাড়ীর মধ্যে ঢোকালো।
সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী পরে ড.সাজ্জাদ হোসাইন বাগানে পায়চারি করছিলেন। তাঁর সামনে আমাদের হাজির করা হলে তিনি বললেন, “এরা শিক্ষক।” বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ তবু আমরা এখন কি করছি—এ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তর্কাতর্কি হলো। তারপর আমাদের যার যার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে সাবধান করে দিল।
দরজা বন্ধ করে আমি ন্যাশনাল প্যানাসনিক রেডিওটা মৃদু আওয়াজে অন করলাম। ঢাকা বেতার থেকে একের পর এক মার্শাল ল’র আদেশ জারি করছে। আকাশবাণীতে গিয়ে দেবদুলালের কাঁপা কণ্ঠে শুনলাম ঢাকায় গোলাগুলি চলছে। অর্থাৎ গণহত্যা শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
দশটা নাগাদ পিছনের দরজা খুলতেই দাঁড়ানো দুজন জোয়ান রাইফেল তাক করলো। আমি হাত তুলে বললাম, “টয়লেট বাথরুমে যেতে হবে।” শেষে তারা অনুমতি দিলো। আমি স্নান সেরে বের হয়ে নাস্তার কথা বললাম। তারা সামনে এলো। জিজ্ঞেস করলো ‘কোথায়’। আমি সামনের ব্লকের রুমটি দেখালাম। রাইফেলের সামনে আমরা খাবার ঘরে গেলাম। অজিত ও মজিবরকে ডেকে নিলাম। বাবুর্চি জয়নালকে ডেকে বের করে আনলাম। কিছু ঘুষি থাপ্পর মেরে আমাদের জন্য নাস্তা বানাতে বললো।
আমরা তিনজন টেবিলে বসলাম। একজন সেপাই দরজার সামনে পাহারায়। সে নিজ মনে বলতে লাগলো, “হিন্দুদের মারার জন্য এক মাস হলো পাকিস্তান থেকে তাকে আনা হয়েছে। কিন্তু আমরা তো হিন্দু দেখছি না। তোমাদের মধ্যে হিন্দু আছো? আমি বলি ‘না’। অজিতের হার্টফেল করার অবস্থা। এক ফাঁকে আমি অজিতকে বলি কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে বলবে ওয়াজেদ গাউস।
নাস্তা দিলে ভদ্রতার খাতিরে বললাম, “আপ আইয়ে”। বলল, “অর্ডার নাহি”। খাওয়া শেষে রাইফেলের সামনে ঘরে পৌঁছে দিল। দুপুরে একইভাবে খেয়ে এলাম। তারা অজিতের রেডিওটা নিয়ে গেলো। ফেরত দেয়নি। আমার ঘরে এসে এটাসেটা দেখে বলে, “তুমি এত বই পড়ো?” ট্র্যানজিস্টার ছাড়া ছিল বুশের রেকর্ড প্লেয়ার। বলে, “তোমার দু’টি রেডিও?” বোঝালাম—ওটা রেডিও না। একটা লং প্লে বাজিয় শুনালাম—নাজাকাত সালামত আলির মিয়া কি টোডী। বললাম, “এরা পাকিস্তানের শিল্পী।” ওরা এদের নামও শোনেনি।
সারাদিন কেটে গেলো। দুটোর সংবাদ শোনার জন্য আমার রেডিওটা নিয়ে গেলো ফিরিয়ে দিয়ে যাবে বলে। আমারটা ফিরিয়ে দিয়ছিলো।
সন্ধ্যায় শিফট পরিবর্তনের সময় আমরা ১০/১৫ মিনিট পেলাম। অজিতকে তৈরি হতে বলে মজিবরকে বললাম, ‘চলুন’। উনি কিছুতেই রাজী হলেন না। আমি এবং অজিত পালালাম। আমি উঠলাম পুকুর পাড়ের আফতাবুর রহীমের বাড়ীতে। অজিত স্যার মোশাররফ হোসেনের বাসায়।
মজিবর রহমানের ওপর অমানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। তাঁকে নাটোরের কোনো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিলো। স্বাধীনতার পর তাঁকে উদ্ধার করা হয়। বিকৃত মস্তিষ্ক। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে রেজিস্টারকে চিঠি দিয়ে নিজের নাম পাল্টে রেখেছিলেন দেবদাস। মজিবর রহমানের নামের অর্থও ‘ঈশ্বরের গোলাম’।
শহিদুল ইসলাম
ভূতপূর্ব অধ্যাপক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।