Headlines

অস্বাস্থ্যকর ও ভেজাল খাদ্যপণ্য বাজারজাতকরণ এবং বিএসটিআই-এর দায়িত্ব

কৃষ্ণেন্দু দাস

খাদ্য হল মানুষের বেঁচে থাকার অপরিহার্য উপাদান। তাই খাদ্যে কোনো প্রকার ক্ষতিকর উপাদান থাকলে তা মানুষের শরীরে রোগ ব্যধি সৃষ্টি করে। এজন্য আমাদের খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে খাদ্যটি যাতে পুষ্টিগুনসম্পন্ন এবং সম্পূর্ন জীবানুমুক্ত হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। বর্তমানে দৈনন্দিন বহু খাবার আমরা খাচ্ছি যেগুলো অস্বাস্থ্যকর এবং অপুষ্টিকর।

আমাদের বাজারে অতি চাহিদা সম্বলিত অনেক অস্বাস্থ্যকর খাবার রয়েছে। যেমন, ফুসকার পাপড়,  খোলা সেমাই, খোলা বনরুটি, খোলা টোস্ট, নন ব্র্যান্ড খোলা ও প্যাকেটজাত বিস্কুট, অস্বাস্থ্যকর নোংড়া পরিবেশে তৈরি মিষ্টি ও দই তেতুলের সস, ভেজাল তেল ইত্যদি।

এ সকল খাদ্যপণ্য যেহেতু বেশ কিছুদিন সংরক্ষণ করে খাওয়া হয়। কিন্তু এগুলো হাতের স্পর্শে তৈরি করা হয় বলে তা জীবানুমুক্ত থাকে না। আর খোলাভাবে বাজারজাতকরণের কারণে এই সকল খাদ্যদ্রব্যে সহজে ধুলিকণা ও রোগজীবানু মেশে।

দীর্ঘদিন ব্যবহারের জন্য কোনো খাদ্যের সেলফ লাইফ বা গুনগত মান যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য সকল খাদ্য উৎপাদনে মান নিয়ন্ত্রণ অত্যাবশ্যক।

বাংলাদেশের কোনো কোনো ছোট নিম্নমানের কারখানায় ফুসকা, পাউরুটি, সেমাই  ইত্যাদির ডো শ্রমিকেরা খোলা পা দ্বারা পাড়ায়ে তৈরি করে। এ সকল কারখানা বিএসটিআই-এর চোখের অগোচরে এভাবে অস্বাস্থ্যকর খাদ্য তৈরি করছে। বাংলাদেশে যে সকল খাদ্যপণ্য বাজারজাতকরণ ও ক্রয়ের জন্য বাধত্যামূলক বিএসটিআই এর সার্টিফিকেশন মার্কস থাকতে হয় সেগুলি নিম্নরুপ:

Screenshot_2017-07-08-16-00-41

ছবি সূত্র: www.bsti.gov.bd

উপরোক্ত ছবির মধ্যে ২৯ ও ৩১নং খাদ্যপণ্য নয়। বাংলাদেশে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়- আমরা বাজার থকে প্রাপ্ত যে বোতলজাত সরিষার তেলগুলো খেয়ে থাকি তার একটি কম্পানির সরিষার তেলের সাথে অন্য কোম্পানির সরিষার তেলের স্বাদের পার্থক্য রয়েছে। কোনোটার ঝাঁঝ বেশি আবার কোনোটার ঝাঁঝ কম। ঝাঁঝ বেশি হওয়ার কারণ অসাধু ব্যবসায়ীরা কেমিক্যালের দ্বারা কৃত্রিমভাবে ঝাঁঝ তৈরি করেছে। আর ঝাঁঝ  স্বাভাবিকের চেয়ে কম হওয়ার কারণ অসাধু ব্যবসায়ীরা কমমূল্যে মেয়াদ উত্তীর্ণ সরিষা সংগ্রহ করে তা হতে তেল বের করছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা এ সকল অস্বাস্থ্যকর ও নিম্নমানের পণ্য তৈরি করেও মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে বিএসটিআই এর অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় বিএসটিআই অনোমোদন প্রাপ্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশের বাজারে যত ধরনের চিপস পাওয়া যায় তার ৯৯% চিপসই শিশু ও কিশোর কিশোরীরা খায়। আর এই সকল চিপস এর স্বাদবর্ধক মূল উপাদান হল মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট বা প্রচলিত নামে টেস্টিং সল্ট, এর রাসায়নিক সংকেত C5H8No4Na। মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট একটি নীরব ঘাতক। এটি খেলে মাথা ব্যাথা, অস্থিরথা, অতিরিক্ত ঘামা, অসাড় হয়ে পড়া, হৃদকম্পন, বুক ব্যাথা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। এ সকল ক্ষতিকর দিক থাকা সত্ত্বেও এদেশের সকল কোম্পানির ব্যবসায়ীরা তাদের চিপস এ মনোসোডিয়াম  গ্লুটামেট (টেস্টিং সল্ট) অধিক পরিমাণে মিশিয়ে স্বাদ বৃদ্ধি করছে। এছাড়া বাজারে যে সকল ফ্রুট জুস বা স্কোয়াস পাওয়া যায় তার অধিকাংশই ফলের নির্যাসবিহীন কৃত্রিম রং, ফ্লেভার ও প্রিজারভেটিভ দ্বারা তৈরি। যা খেলে শিশুদের কিডনিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

বাংলাদেশে কোনো উৎপাদিত পণ্যের জন্য বিএসটিআই এর ছাড়পত্র ও লাইসেন্স প্রাপ্তির প্রক্রিয়া:

  • কোনো পণ্য উৎপাদনকারী, প্যাকেটজাতকারী প্রতিষ্ঠানের বিএসটিআই এর Certification Marks বা CM  লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য bsti কর্তৃক প্রদানকৃত নির্ধারিত আবেদন ফরম সঠিকভাবে পূরণ করে বিএসটিআই এর কার্যালয়ের নির্ধারিত ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার’ এ প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্রাদি ও আবেদন ফিসহ জমা দিতে হবে।
  • দরখাস্তের সাথে নিম্নে উল্লেখিত কাগজপত্র সংযুক্ত করতে হবে।
  • i) কারখানা বা উৎপাদনকেন্দ্রের নিজস্ব নাম ঠিকানা সম্বলিত বৈধ ট্রেড লাইসেন্স;
  • ii) রেজিস্টার্ড ট্রেড মার্কস;
  • iii) আয়কর পরিশোধের অনুলিপি;
  • iv) কারখানার স্পেশিফিকেশন ও লে-আউট;
  • v) কারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি এবং যানবহনের তালিকা;
  • vi) কারখানায় নিযুক্ত সকল কর্মচারী এবং শ্রমিকের স্বাথ্যগত সনদপত্রের বিবরণ;
  • vii) খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী কারখানার জন্য Premises লাইসেন্স;
  • viii) কারখানার ল্যাবের যন্ত্রপাতির তালিকা;
  •  ix) ল্যাবে নিয়োজিত পরীক্ষকদের জীবজীবনবৃত্তান্ত;
  • x) খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে উৎপাদন প্রক্রিয়ার ফ্লো-চার্ট।
  • xi) “প্যাকেজ কমোডিটিজ রুলস্ ২০০৭” অনুসারে উৎপাদিত পণ্যের বিবরন ও ফয়েল মোড়ক অথবা লেবেলের স্যাম্পল।

জমাকৃত আবেদনপত্র এবং সকল কাগজপত্রাদি পর্যবেক্ষণের পর সরকারি বিধি মোতাবেক কারখানা পরিদর্শনে পরিদর্শক পাঠানো হয়। পরিদর্শক যে যে বিষয় পর্যবেক্ষণ করে তা নিম্নরুপ:

১) পণ্য উৎপাদনের সকল কাচামালসমুহ;
২) উৎপাদন প্রক্রিয়ার ধাপসমুহ;
৩) পরীক্ষাগার ও পরীক্ষার প্রক্রিয়া;
৪) স্বাথ্যগত দিক, পরিচ্ছন্নতা, হাইজিন ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা;
৫) উৎপাদিত পণ্যের সংরক্ষন প্রক্রিয়া;
৬) পরীক্ষাগারে নিয়োজিত সকল ব্যক্তিদের দক্ষতা ও যোগ্যতার তথ্য।

পরিদর্শক যদি কারখানার সমস্ত কার্যক্রম সন্তোষজনক দেখেন তখন তিনি কারখানার উৎপাদিত কয়েকটি ভিন্ন ব্যাচের পণ্যের নমুনা, মজুদকৃত পণ্য হতে সংগ্রহ করে কারখানার কর্তৃপক্ষ ও পরিদর্শকের যৌথ স্বাক্ষরে সীলগালা করেন।  এভাবে সীলগালাকৃত একাধিক নমুনা বিএসটিআই-এর পরীক্ষাগারে পরীক্ষার জন্য ফিসহ একটি চিঠি লিখে বিএসটিআই তে পাঠানো হয়।

কোনো কারখানার উৎপাদিত পণ্যের নমুনা যদি বিএসটিআই-এর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় তবেই বিধি মোতাবেক ঐ পণ্যটির অনুকূলে ৩ বছর মেয়াদী বিএসটিআই Certification Marks (CM) লাইসেন্স প্রদান করা হয়। কোনো লাইসেন্স প্রদানকারী পণ্যের গুনগতমান ধারাবাহিকভাবে বিএসটিআই-এর স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী সঠিক আছে কিনা তা জানার জন্য ১৫ দিন অন্তর কিছু নমুনা বিএসটিআই পরীক্ষাগারে প্রেরণ করতে হয়।

এতক্ষণ আমরা আলোচনা করলাম উৎপাদিত কোনো পণ্য কীভাবে বিএসটিআই-এর সনদপ্রাপ্তি লাভ করে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উপরিউক্ত যে সকল বিষয় বিএসটিআই পর্যবেক্ষণ করে (করার কথা) তার সবকটি সঠিকভাবে বাংলাদেশের কোনো কারখানায় থাকে না। অনুমোদন পাওয়ার সময় পণ্য উৎপাদনের কাঁচামালের যে নমুনা পরিদর্শকদের দেখানো হয় সেটি থাকে উচ্চমানের কাঁচামাল। পরবর্তীতে বিএসটিআই অনুমোদন লাভের পর অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় নিম্নমানের কাঁচামাল ব্যবহার শুরু করে। অন্যান্য যে সকল ত্রুটি যেমন, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, অদক্ষ কর্মচারী, নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ইত্যাদি ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও অসাধু ব্যবসায়ীরা বিএসটিআই-এর অসাধু কর্মকর্তাকে মোটা অংকের ঘুষ প্রদান করে বিএসটিআই-এর সনদ এবং অনুমোদন লাভ করে।

উৎপাদিত পণ্যের গুণগতমান সঠিক রাখার জন্য বিএসটিআই যে সকল বিষয় নিয়ন্ত্রন করে (করার কথা):

  • কারখানার সর্বস্থানের হাইজিন ও স্যানিটেশন নিশ্চিতকরণ;
  • ফুড মাইক্রোবায়োলজি বিশেষজ্ঞ দ্বারা উৎপাদিৎ খাদ্যপণ্যে জীবানুর উপস্থিতি পরীক্ষাকরণ;
  • ফুড পয়জনিং নিয়ন্ত্রণ;
  • ফুড কন্টামিনেশন নিয়ন্ত্রণ;
  • ফুড ইনটক্সিকেশন নিয়ন্ত্রণ;
  • ফুড সেফটি নিশ্চিতকরণ
  • খাদ্যের গুণগত মান অপরিবর্তীত রেখে খাদ্য সরক্ষণ;
  • খাদ্যের পুষ্টিমান বিশ্লেষণ।

খাদ্যপণ্যের পুষ্টিগুণ সঠিক না হলে এবং খাদ্য জীবানুমুক্ত না হলে তা অস্বাস্থ্যকর খাদ্য হয় এবং ঐ খাদ্য গ্রহণ করলে শরীরে রোগ ব্যধির সৃষ্টি হয়। তাই খাদ্য উৎপদনকারী প্রতিষ্ঠান যদি অসাধু হয় এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্য বাজারজাত করে তা একটি দেশের মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়।


লেখক:

কৃষ্ণেন্দু লেনিন

জুনিয়র ইনস্ট্রাকটর,

ফুড টেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট

নরসিংদী সংরকরি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট