ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দিয়াজ গ্রুপের প্রধান দিয়াজ ইরফান চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৫ কোটি টাকার টেন্ডারের বলি হয়েছেন! রোববার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসংলগ্ন বাসা থেকে দিয়াজের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের পর এ বিষয়টিই ঘুরে-ফিরে আসছে। এটি হত্যা না আত্মহত্যা পুলিশ তা নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও দিয়াজের পরিবার ও সতীর্থদের দাবি এটি হত্যাকাণ্ড। টেন্ডার নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে প্রতিপক্ষ গ্রুপ দিয়াজকে হত্যা করে লাশ বাসার সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে পালিয়ে যায়। তারা এ হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যা বলে চালানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এটি প্রতিষ্ঠিত করতে প্রতিপক্ষ গ্রুপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। যদিও এরই মধ্যে দিয়াজ যে আত্মহত্যা করেননি তার বেশ কিছু আলামত পেয়েছে পুলিশ। বিশেষ করে ময়নাতদন্তে দিয়াজের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত চিহ্ন পাওয়া গেছে। লাশ সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে থাকলেও পা ছিল খাটের সঙ্গে লাগানো। এ কারণে এটি আত্মহত্যা নয় বলেই বদ্ধমূল ধারণা দিয়াজের সহকর্মী ও পরিবারের। দিয়াজের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
দিয়াজ গ্রুপের একাধিক নেতাকর্মী ও দিয়াজের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু হলের সম্প্রসারণ ও নতুন কলা অনুষদ ভবনের সম্প্রসারণের ৯৫ কোটি টাকার টেন্ডার নিয়ে চবি ছাত্রলীগের দু’পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। এক পক্ষের নেতৃত্বে বর্তমান সভাপতি আলমগীর টিপু এবং আরেকপক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন দিয়াজ ইরফান। তারা নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। এর জেরে ৩০ অক্টোবর দিয়াজের বাসায় ভাংচুর ও লুটপাট হয়।
সূত্র জানায়, রোববার রাত ১২টায় দিয়াজের লাশ ঝুলন্ত অবস্থা থেকে নামিয়ে নেয় পুলিশ। পরে লাশটি ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সোমবার সকালে তার মরদেহ নিতে এসে পরিবারের সদস্যরা এটিকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করেন। দিয়াজের মামা রাশেদ আমিন চৌধুরী ও বোনের স্বামী সরওয়ার আলম যুগান্তরকে বলেন, কিছুদিন আগে দিয়াজের বাসায় যারা হামলা চালিয়েছে তারাই পরিকল্পিতভাবে তাকে (দিয়াজকে) খুন করে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে লাশ ঝুলিয়ে দিয়েছে।
পরিবারের মতো এটিকে পরিকল্পিত হত্যা বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। দিয়াজ ইরফানকে হত্যার পর লাশ ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের শতাধিক বর্তমান ও সাবেক নেতা এ নিয়ে নানা বক্তব্য তুলে ধরেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এটি কেন আত্মহত্যা নয় তার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন তারা। পাশাপাশি এ ঘটনার পর ৩ ঘণ্টায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো কর্তাব্যক্তি ঘটনাস্থলে না আসায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত টেন্ডার সিন্ডিকেটের হাতেই খুন হয়েছেন দিয়াজ। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।’
লাশ উদ্ধারের পর দিয়াজের শরীরের তিন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আফসানা বিলকিস। তিনি বলেন, দিয়াজের গলার উভয় পাশে আঁচড়ের চিহ্ন আছে। তবে বাঁ পাশে আঁচড়ের পরিমাণ বেশি। এছাড়া তার হাতের কবজি ও পায়ে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। ভিসেরা প্রতিবেদন পাওয়ার পর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
সড়ক অবরোধ, ডেমু ট্রেন ভাংচুর : দিয়াজের মৃত্যুর খবরে শোকে ফেটে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতারা। দিয়াজকে হত্যা করা হয়েছে এমন অভিযোগ এনে এ ঘটনার বিচার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়গামী সব ট্রেন ও সড়ক অবরোধ করেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। সোমবার সকাল ৮টায় ক্যাম্পাসগামী প্রথম ট্রেনটি ফতেয়াবাদে পৌঁছলে তারা আটকে দেন। এর পরবর্তী ট্রেনও একই স্থানে পৌঁছলে তারা আটকে দেন। এর ফলে কোনো ট্রেনই ক্যাম্পাসে পৌঁছতে পারেনি। একই ঘটনায় হাটহাজারী সড়কের বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক এলাকায়ও অবরোধ করেন তারা। এছাড়া চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কের নন্দীরহাটে অবরোধ করেছেন তারা। অবরোধের ফলে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। সড়কে দু’পাশে আটকে থাকে অসংখ্য গাড়ি। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। ট্রেন অবরোধের বিষয়টি নিশ্চিত করে ষোলোশহর রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার সাহাব উদ্দিন বলেন, ফতেয়াবাদে দুটি শাটল ট্রেন আটকে দেয়া হয়। ফলে সকাল থেকে কোনো ট্রেন ক্যাম্পাসে পৌঁছতে পারেনি। এ সময় ডেমু ট্রেন ভাংচুর করেছেন তারা। এর আগে একই দাবিতে নগরীর প্রবর্তক মোড়ে সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে রাখেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এ সময় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয় সড়কে। অবরোধ চলাকালে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ঘটনাস্থলে ছিল। পরে দিয়াজের পরিবারের অনুরোধ ও পুলিশের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে অবরোধ তুলে নেয়া হয়।
দিয়াজের মৃত্যুর খবরে শোক প্রকাশ করেছে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদ। সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, ‘আমরা শোকাহত। দিয়াজের মতো একটি ছেলে এমন কাজ করেছেন বলে বিশ্বাস হচ্ছে না।’ এটি হত্যাকাণ্ড কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফরেনসিক রিপোর্ট পাওয়ার পরে কোনো ধরনের অসংগতি পাওয়া গেলে আমরা ব্যবস্থা নেব।
হত্যার সন্দেহ যে কারণে ঘনীভূত হচ্ছে : বিশ্ববিদ্যালয়ের ২নং গেট এলাকায় চার তলা একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন দিয়াজ ও তার পরিবারের সদস্যরা। রোববার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঝুলন্ত অবস্থায় দিয়াজের লাশ পাওয়া যায়। এ সময় বাসায় কেউ ছিলেন না। প্রতিবেশী ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র বলছে, দিয়াজ যে বাসার দ্বিতীয় তলায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন সেই বাসাটি নির্মাণাধীন। দ্বিতীয় তলায় একটি জানালা রয়েছে যেটি দিয়ে সহজেই একজন লোক গমনাগমন করতে পারে। তা ছাড়া বাসার বাইরে একটি মইও পড়েছিল। বাসার দরজায় ছিল ডিজিটাল লক সিস্টেম। দরজা ভেঙে প্রবেশ করে পুলিশ লাশ উদ্ধার করলেও বলা হচ্ছে, যে কেউ ভেতর থেকে দরজা লক করে বের হয়ে গেলে বাইরে থেকে চাবি ছাড়া খোলার কোনো অবকাশ নেই। এসব সুযোগ কাজে লাগিয়েই দুষ্কৃতকারীরা দিয়াজকে হত্যা করে লাশ সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে পালিয়ে গেছে বলেই সন্দেহ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
৯৫ কোটি টাকার টেন্ডার নিয়ে কোন্দল : দুটি ভবন নির্মাণে প্রায় ৯৫ কোটি টাকার টেন্ডারকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দু’গ্রুপে কোন্দল চরম আকার ধারণ করে। গত দু’মাসে অন্তত পাঁচবার দু’পক্ষে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এর মধ্যে রয়েছে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক দিয়াজ ইরফান গ্রুপ ও সভাপতি আলমগীর টিপু গ্রুপ। সর্বশেষ ২৯ অক্টোবর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ আবদুর রব হলের সামনে কুপিয়ে আহত করা হয় সহ-সভাপতি তাইফুল হক তপুকে। এরপর ক্যাম্পাসের ২নং গেটে দিয়াজের বাসাসহ ছাত্রলীগের চার নেতার বাসায় তাণ্ডব ও লুটপাট চালানো হয়। হামলার এসব ঘটনার সঙ্গে দরপত্রের ভাগ-বাটোয়ারার বিষয়টি জড়িত বলে জানা গেছে। এসব কারণে ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পাসে অবরোধের ডাক দেয় ছাত্রলীগের একটি পক্ষ। এর জের ধরে ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত দু’পক্ষে চার দফা সংঘর্ষ হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ধরনের টেন্ডারের সঙ্গে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ। ওই সময় ছাত্রলীগের এ সভাপতি যুগান্তরকে বলেন, ‘সংঘর্ষ-হামলার ঘটনায় কারা জড়িত সে বিষয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন আমাদের হাতে রয়েছে। আমরা শিগগিরই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেব।’
কী ছিল সেই টেন্ডারে : বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা অনুষদ ভবনের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজের দরপত্র ৭৫ কোটি টাকার। আর শেখ হাসিনা হলের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজের দরপত্র প্রায় ২০ কোটি টাকা। দুটি দরপত্রের সিডিউল বিক্রি করা হয় ১৮ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। শিডিউল কিনতে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দফতর থেকে। ফরম জমা দেয়ার শেষ তারিখ ছিল ২৭ সেপ্টেম্বর। আর এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দফতর অবরোধ করে রাখে ছাত্রলীগ। ফলে ছাত্রলীগের পছন্দের বাইরে সিডিউল কিনতে পারেনি কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
চেষ্টা করেও দরপত্র ফরম কিনতে না পারা কয়েকজন ঠিকাদার বলেন, ছাত্রলীগের বড় একটি অংশের সহযোগিতায় নিজেদের পছন্দের বাইরে অন্য কাউকে সিডিউল কিনতে দেয়া হয়নি। গত কয়েকটি দরপত্রে একটু খেয়াল করলে এটি সহজেই বোঝা যায়। তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ দরপত্রগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু হলের প্রথম অংশের কাজ একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে ১৪ শতাংশ কমে, জীববিজ্ঞান অনুষদের কাজ দেয়া হয়েছে ১২ শতাংশ কমে। সংখ্যালঘুদের জন্য দুটি হলের কাজ দেয়া হয়েছে যথাক্রমে ৭ ও ৯ শতাংশ কমে। কিন্তু নতুন কলা অনুষদ ভবনের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ দেয়া হয়েছে ৩ শতাংশ কমে ও ১ শতাংশ কমে। ফলে ওই দরপত্রগুলোর হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় তথা রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১১ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, আইন অনুযায়ী শিডিউল কেনার জন্য তিনটি স্থানে বুথ রাখার কথা কিন্তু তা রাখা হয়নি। শুধু পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে দরপত্র দেয়ার জন্য ক্যাম্পাসের বুথ বসানো হয়েছে। এসব অনিয়ম করার জন্য পিএনডি কমিটি ও একজন প্রকৌশলীকে পরিবর্তন করা হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। সর্বশেষ ৩ দিন আগে ৯৫ কোটি টাকার টেন্ডারের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। টিপুর পছন্দের ঠিকাদাররাই এ কাজ পেয়েছেন। সূত্র জানায়, মূলত গ্রুপগুলোর মধ্যে বিশাল অংকের এ টেন্ডার নিয়ে এক প্রকার নেগোসিয়েশন হয়। নেগোসিয়েশনে দিয়াজকে ২৫ লাখ টাকার চেক দেয়া হয় বলে জানায় একটি সূত্র। তার মৃত্যুর পর সেই চেকটি এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। নেগোসিয়েশনের টাকার ভাগ-বাটোয়ারায় গরমিল বা টাকা দেয়া না দেয়ার কারণেও দিয়াজ খুন হতে পারেন। যদিও এখনও দিয়াজ আত্মহত্যা করেছেন নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে তা নিশ্চত করতে পারছে না পুলিশ।
# সংবাদ : যুগান্তর