মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সা. সম্পাদক জাকির ‘শিবিরের প্রোডাক্ট’

জাকির হোসাইন

ছাত্র শিবিরের সাবেক নেতা ও হল সেক্রেটারি এস এম জাকির হোসাইন এখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক।ছাত্রলীগের কেন্দ্রিয় সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইনকে নিয়ে নতুন বিতর্ক এখন দেশ জুড়ে আলোচনার ঝড় বইছে।

‘জাকির শিবিরের প্রোডাক্ট’ এমন খবরে দীর্ঘদিন কানাঘুষা থাকলেও বিষয়টি এখন প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষ করে, বর্তমান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি এস. এম. জাকির হোসাইন গত ৮ আগস্ট সিলেটের সোবহানি ঘাটে শিবিরের হামলায় আহত ছাত্রলীগ কর্মী শাহিন আহমদকে হাসপাতালে দেখে এসে ফেইসবুক একটি স্ট্যাটাস দিয়ে তিনি লেখেন, “কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে সিলেটে শিবিরের নৃশংস হামলার ছবিগুলো দেখে স্থির থাকা সম্ভব নয়। আমার ভাইয়ের শরীর থেকে ঝরা প্রতিটি রক্তবিন্দু বৃথা যেতে পারে না। একদম পাই-টু-পাই জবাব দেয়া হবে। জাস্ট ওয়েট…”- এই স্ট্যাটাসের পর সারা দেশে বিতর্কের ঝড় ওঠে।

অভিযোগ উঠেছে, ’জাস্ট ওয়েট’ বলে ছাত্রলীগের কর্মীদেরকে শান্ত রেখে ছাত্র শিবিরের নেতা কর্মীদেরকে নিরাপদ রাখা। এই নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে।

বিভিন্ন সূত্রমতে, জাকির জামায়াত ঘরনার পরিবারের সন্তান। ছোটবেলা থেকেই জামায়াত শিবিরের পরিবেশে বেড়ে উঠেন। ভর্তি হন জামায়াত প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা জামেয়া ক্বাসিমিয়া নরসিংদিতে। এই মাদ্রাসায় জামায়াত শিবিরের সাথে সংশ্লিষ্ট পরিবারের ছাত্ররাই লেখাপড়া করেন। শিবিরের সদস্য, সমর্থক না হলে সেখানে পড়ালেখা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এস এম জাকির সেখান থেকে আলীম পাশ করেন। এই মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বেয়াই মাওলানা কামাল উদ্দিন জাফরী। সারদেশে শিবিরের আড়ৎ হিসেবে দুটি মাদ্রাসাই সর্বমহলে পরিচিত, এর একটি হলো জামেয়া ক্বাসিমিয়া নরসিংদি।

সেখানেই শিবিরের সাথী শপথ নেন জাকির। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন ২০০৯ সাল। তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্দার আড়ালে শিবিরের তৎপরতা ব্যাপক। যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিবিরের প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ, তাই সেখানে যারা শিবির করে- তারা হয় ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল করেন, আর ভেতরে ভেতরে শিবিরের কাজ চালিয়ে যায়।

ক্ষমতাসীন দলের লেবাসে ছাত্র রাজনীতি করা হচ্ছে ছাত্র শিবিরের একটি রাজনৈতিক কৌশল। এছাড়া প্রশিক্ষিত কর্মীকে ক্ষমতাসীন দলে প্রবেশ করিয়ে, নিজেদের আদর্শ বাস্তবায়ন করা, অন্যান্য সংগঠনের অভ্যন্তরীণ খবরাখবর জেনে নিরাপদে নিজেদের সাংগঠনিক কাজ চালিয়ে যাওয়াই হচ্ছে তাদের নতুন রাজনৈতিক কৌশল। সেইভাবে জাকিরকে শিবিরের নেতাদের নির্দেশে ছাত্রলীগের ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।

এর আগে ঢাবি শিবিরের সাবেক সভাপতি শিশির মোহাম্মদ মনিরের নজরে আসেন তিনি। হয়ে যান সংগঠনের সদস্য প্রার্থী ও হল সেক্রেটারী।

এদিকে অপর একটি সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ বছর শিবিরের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, বিভিন্ন প্রোগ্রামে বক্তব্য রেখেছেন, শিবিরের রিপোর্ট রেখেছেন, শিবিরের সাথে হাতে হাত আর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন।

২০০৯ সালে শিবিরের কেন্দ্রিয় সভাপতি নির্বাচন নিয়ে আভ্যন্তরীন কোন্দল দেখা দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ কেন্দ্রিয় কার্যকরী পরিষদের ২৫ জন সদস্য দল থেকে পদত্যাগ করেন। সে সময় সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে শিশির মনির সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু তৎকালীন সভাপতি রেজাউল করিমকে পূনরায় সভাপতি ঘোষণা করা হলে বিষয়টি মেনে নেননি শিবিরের সদস্যরা। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃবৃন্দের সাথে শিবিরের সদস্য প্রার্থী পদ থেকে পদত্যাগ করেন জাকির হোসাইনও। কারণ সিলেটি হিসেবে তিনিও চেয়েছিলেন শিশির মনিরই সভাপতি হোন।

পদত্যাগ করলেও ছাত্রলীগে তার অবস্থান ঠিক রাখেন এবং আরও পাকাপোক্ত করতে থাকেন। কারণ শিবির করার বিষয়টি ছিল গোপনীয়। এক পর্যায়ে জিয়া হলের ছাত্রলীগের সেক্রেটারী হন জাকির। এরপর সিদ্দিকী নাজমুল আলমের কাছের মানুষ হিসেবে কেন্দ্রিয় সহ সম্পাদক হিসেবে কো অপ্ট করা হয় তাকে। পরের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদকের পদ লাভ করে সবাইকে  চমকে দেন।

বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট। বিশেষ করে সিলেট ও মৌলভী বাজার অঞ্চলের শিবির নেতারা অনেকেই অবগত। এতদিন তারা বিষয়টি প্রকাশ করেনি। তাদের মতে, সাবেক শিবির নেতা হলেও তিনি এখনও সবার সাথে যোগাযোগ রাখছেন। আর উশৃঙ্খল ছাত্রলীগকে সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে আনতে তিনি গঠনমূলক ও শিবির থেকে শেখা কর্মসূচি ছাত্রলীগে বাস্তবায়ন করছেন।

কিন্তু সম্প্রতি সময়ে সিলেটে ছাত্রলীগ কর্মীদের উপর শিবিরের হামলার ঘটনায় জাকিরের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস তাঁর মনের কথা প্রকাশ পায়।

শিবিরের এক শীর্ষ নেতার সাথে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে হেসে হেসে বলেন, যা কিছু রটে, কিছু না কিছু সত্য বটে। এ বিষয়ে আর কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ছাত্রলীগের সেক্রেটারি এস. এম. জাকির হোসাইন সম্পর্কে:

নাম: এস. এম. জাকির হোসাইন। পিতা: হাফিজ মাও. আব্দুল জলিল (বড় হাফিজ সাব নামে এলাকায় পরিচিত)। ৫ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে তিনি অষ্টম। গ্রাম: হালগরা। ডাক: শিলুয়া বাজার। উপজেলা: জুড়ী। জেলা: মৌলভীবাজার।

২০০৪ সালে দাখিল ও ২০০৬ সালে আলিম পাশ করেন জামেয়া ক্বাসিমিয়া নরসিংদী থেকে (উল্লেখ্য এই মাদ্রাসা মাওলানা কামাল উদ্দিন জাফরীর মাদরাসা)।

জামেয়া ক্বাসিমিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়ার সময় ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন জাকির। ধারাবাহিকভাবে সমর্থক, সহযোগী, কর্মী ও ২০০৪ সালে শিবিরের শপথের আলোকে সাথী শপথ গ্রহণ করেন।

উক্ত মাদরাসায় অধ্যয়নকালে শিবিরের বিভিন্ন শাখা।, উপশাখার দায়িত্বপালন করেন। ২০০৬ সালে আলিম পাশ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ওঠেন শহীদ জিয়া হলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে অধ্যয়নকালে ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং ২০০৯ সালে শিবিরের সদস্য প্রার্থী ছিলেন।

ক্ষমতার পটপরিবর্তনে তিনিও ছাত্রশিবির থেকে ছাত্রলীগে যোগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল্য থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স পাশ করেন। ছাত্রলীগ সেক্রেটারি জাকির হোসাইনের পিতা-মাতা, ভাই-বোনসহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্য জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সাথে জড়িত।


সূত্র: সম্পাদক.কম