ছোটগল্পঃ পরকীয়া // দিব্যেন্দু দ্বীপ

পরকীয়া

– অতদূর থেকে তুমি কীভাবে আসবে?
– তুমি ডাকলেই চলে আসবো।
– মিছেমিছি তোমার সময় নষ্ট হবে, টাকা নষ্ট হবে। থাক, আসতে হবে না।
– তোমার বুঝি আমাকে ভালো লাগে না?
– যার জন্য শিক্ষিত সুন্দর সুন্দর মেয়েরা সতী হয়েও স্বামীকে ঠকায়, সে আমার মতো মূর্খের কাছে আসলে ভালো লাগবে কেন?
– তুমি অনেক পাস করো নাই সত্য, কিন্তু যা বললে তার মানে করতে কতজন শিক্ষিত নারী সমর্থ হবে আমার সন্দেহ আছে।
– পুরুষ মানুষ এরকম প্রশংসা করেই থাকে। কেন করে তা আমি জানি না বুঝি?
– কী জানো বলোতো? বলোতো, আমি কেন তোমার প্রশংসা করি।
– তোমাকে মন্দ কিছু বলতে আমার ভালো লাগে না। ফোনে তো বলবোই না।
– বলো, না বললে আজকে রাতে আমার একটুও পড়াশুনা হবে না। তুমি না আমার পড়াশুনা নিয়ে অনেক ভাবো। সবসময় তো বলো, “তুমি অনেক বড়ো হবে, কেউ আর তোমার মতো বড় হবে না।” পড়াশুনা না করলে কীভাবে বড়ো হবো? কেন প্রশংসা করি বলো, তাহলে ঠিকমতো পড়বো এবং পড়ার পরে তুমি যে হরলিকসটা দিয়েছিলে সেই হরলিকস গরম পানিতে গুলে কানায় কানায় এক গ্লাস খাবো, চিনি দিয়ে খাবো। অনেক শক্তি হবে। অনেক শক্তি হলে তো তোমারই লাভ, তাই না?
– কী বললে?
– বললাম আমার অনেক শক্তি হওয়া দরকার।
– শক্তি হওয়া তো সবারই দরকার, তোমারও দরকার আমারও দরকার। বাংলাদেশের সব মানুষের শক্তি হওয়া দরকার। শয়তান।
– এখন বলো আমি আসতে চাইলে কেন সবসময় তুমি না করো?
– তোমাকে যদি ভালো না বাসতাম তাহলে যখন তখন আসতে বলতাম, ইচ্ছে পূরণ করতাম। নারীর শরীর তো চিনেছো। জ্বালালে কেউ কেউ অবিরাম জ্বলে। তবে তোমাদের মতো চোখ না ভরা স্বভাবের না। আমাকে দিয়েই কি প্রথম চিনেছো? বলো তো সত্যি করে।
– তোমাকে দিয়েই প্রথম চিনেছি। আমি বোধহয় একটু দেরিতেই চিনেছি। নাকি?
– তোমাকে ভালো না বাসলে নারীর যত রকমের ছলাকলা আছে সব করতাম। একটা মিনিট তোমার সাথে থাকতে পারা আমার কাছে স্বপ্নের মতো। কিন্তু একই সাথে মনে হয় নিজের সুখের জন্য তোমার মূল্যবান সময় আমি নষ্ট করছি। আমার তো থালা বাসন আর বিছানা, সেখানে যখন তখন তোমাকে ডাকবো কেন? কাছাকাছি থাকলে ডেকে রোজ তোমাকে খাওয়াতাম। তোমাকে খাওয়াতেই আমার সবচে’ ভালো লাগে। ওটা বাদ দিয়েও তোমার সাথে আমার অনেক ভালো সময় কাটে। তোমার কথা ভেবেই বেশ্যার মতো তোমাকে বিছানায় ডেকে নিই। তুমি তো আবার ভাব ধরা বদমাশ। আপ্যায়ন করতে হয়।
– আমি কিন্তু আজকে রাতের বাসে আসবো।
– আসবে না। তোমার কাছ থেকে আমি সবই পাই, কিন্তু আমার কাছ থেকে যা তুমি নিতে আসো তা একজনের কাছ থেকে নিলেই হয়। ওখানেই ম্যানেজ করে নাও।
– ভুল জানো। ওটা চাই তা সত্য, তবে সবার কাছ থেকে নয়। যাই ভাবো না কেন অনেকের কাছে যাওয়া আর তোমার কাছে আসা এক কথা নয়। তোমাকে যেভাবে পাই ওভাবে কাউকে পাওয়া এত সহজ কথা নয়।
– এখন তো কত কী বলবা। দেখো, সব মেয়েরই মনে মনে একজন স্বপ্নের পুরুষ থাকে। তুমি আমার স্বপ্নের পুরুষ, একই সাথে এ-ও ভাবি— আমি তো তোমার বাসার কাজের বুয়া হবারও যোগ্য নই। এরকম একটা মেয়ে তো তুমি হাতের কাছে জুটিয়ে নিলেই পারো। যখন তখন যেতে পারবে, আমার কাছে এত কষ্ট করে আসতে হবে না।
– ভালোবাসায় কি এত হিসেবনিকেশ চলে?
– কীসের ভালোবাসা? সত্যিই যদি ভালোবাসা থেকে থাকে তাহলে ‘তুমি আসতে চাইবে’ এটা যেমন সত্য, আবার ‘আমি আসতে না করব’ এটাও সত্য। এবং দ্বিপক্ষীয় ভালোবাসার ক্ষেত্রে এই ‘না’-টা জয়ী হওয়া খুব জরুরী।
– এই দুই সত্যের মাঝেও তো একটা সত্য আছে।
– সেই সত্য তোমার মাঝে যেমন আছে আমার মাঝেও আছে। জানি না তুমি কোন সত্যের কথা বলছো। আমার মতো সাধারণ একজন মহিলা তোমাদের মতো শিক্ষিত মানুষের সব সত্য বুঝবে না।
এতক্ষণ সব আকাঙ্ক্ষা-আবেগ-অনুভূতি বিসর্জন দিয়ে তোমার সাথে কথা বলছিলাম। আমার শরীর কাঁপছে।
– তুমি অশিক্ষিত হলে পৃথিবীতে কোনো শিক্ষিত মানুষ নেই। জীবনের কোনো মাত্রা তোমার মধ্যে আমি অনুপস্থিত দেখিনি।
– আমাদের সম্পর্ক হলো দু’জন দু’জনকে কষ্ট দেওয়ার সম্পর্ক। তুমি যা চাও তা পাও না, আমি যা চাই তাও পাই না।
– আমাকে এখন থেকে প্রতি মাসেই প্রায় বাড়িতে আসতে হবে। তখন তোমার কাছে আসবো।
– তোমার ইচ্ছেমতো আসলেই কি হবে? তাছাড়া সুযোগের ব্যবহার আমার ভালো লাগে না। আমার কাছে আসা একরকম আর কাজে এসে আমার কাছ থেকে ঘুরে যাওয়া, সে আরেক রকম। দু’এর মানে কী কখনো এক হয়? কোনো কোনো বেসামাল ট্রাক ড্রাইভারের থেকে একটু ভালো বৈকি। তারাতো মাল গাড়ি রেখে ভালোবাসতে যায়।
– তোমার কী হয়েছে বলোতো?
– তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। শত শত বৎসর তোমার সাথে থাকতে ইচ্ছে করছে। সত্যি বলছি, শরীর তোমার কাছ থেকে পেতে চায় না। তুমি চাও বলে দিতে চায়। তুমি কি জানো তোমার প্রতি আমি সবচে’ বেশি দুর্বল হয়েছিলাম কবে?
– জানি না।
– বিছানায় বসে আমরা খাচ্ছিলাম। তুমি খাওয়ার পরে মুখ না ধুয়ে একটু জিরিয়ে নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে। ঘুমাবস্থায় তোমার মুখ মুছে দিতে দিতে ভাবছিলাম এরকম একটা সন্তান আমার চাই। অসতী যখন হয়েছি তখন আসল চাওয়াটা কেন আদায় করে নেব না? তুমি তো সবই নিয়েছো।
– মানে?
– মানে এই সন্তানটিই হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তান।
– মানে?
– মানে তোমাকে আরো বড় করে রেখে দিলাম। এটি হবে আমার দ্বিতীয় সন্তান, তোমার প্রথম।
– তুমি আর তোমার স্বামীর সঙ্গে থাকতে চাও না?
– থাকতে চাই তোমার সাথে যাবো না বলে। তোমার সাথে যেতে চাইলে তুমি আমাকে নেবে ঠিকই, তবে করুণা করে নেবে। তুমি পরের বউকে এতদিন ভালোবেসেছো, কিন্তু আমি কারো স্বামীকে ভালোবাসিনি। আমি তোমাকে ভালোবেসেছি, একইসাথে অনেক বোকা এবং অনেক বুদ্ধিমান একটি ছেলেকে আমি ভালোবেসেছি, তার দেওয়া সবচে’ বড় স্মারক রেখে দিলাম। এমন স্মারক রেখে দিলাম— তোমাকে আসতেই হবে। তুমি না আসলেও তোমার ভেতরে একটি মানুষ বাস করে, ঐ মানুষটা আসবে, বারে বারে আসবে। আমি এখন নির্ভার। তুমি যেতে পারো, যাকে ভালোবাসো তাকে বিয়ে করো গিয়ে।
– ভালোবাসি মানে?
– সত্য করে বলোতো, তোমার সন্তানের দিব্যি দিয়ে বলোতো তুমি কাউকে ভালোবাসো না?
– সত্যিই কি তুমি তাই করেছো।
– এর মধ্যে একচুলও মিথ্যা নেই। পৃথিবী উল্টো ঘুরলেও এই সন্তানটি ভূমিষ্ট হবে।
– তাকে ছাড়ছো না, আবার বলছো আমার সন্তান নিচ্ছো?! তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?
– আমার মতো অশিক্ষিত একটি মেয়ে স্বামী ছাড়লে সমাজ আমাকে ছাড়বে? বাপের বাড়িতে গিয়েও থাকতে পারবো না, নিজেও কিছু করতে পারবো না।
– সন্তানের পিতৃপরিচয় কী হবে?
– যা হলে সমাজের মান সম্মানের হানি হবে না তাই-ই হবে।
– সে কী ভাববে?
– নিজের সন্তান ভাববে? আমাদের দ্বিতীয় সন্তান নেবার পাকাপাকি কথা হয়েছিলো।
– এভাবে কতদিন চলবে?
– আমি মারা যাবার পূর্ব পর্যন্ত।
আমি লুকাবো, তবে তুমি লুকাবে না। যাকে বিয়ে করছো তাকে সব খুলে বলবে। সত্য করে বললে মেনে নেবে। তুমি চঞ্চল, তবে অনেক বড় একজন মানুষ, একইসাথে এক্ষেত্রে তুমি অপরাধীও। আমাকে দিয়ে শুধু প্রবৃত্তির প্রয়োজন মিটিয়েছো তা জেনেও আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। আর যাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসো সে তোমাকে অল্পতে অপরাধী ভাববে বলে আমার মনে হয় না।
– এটা কী অল্প?
– তোমার জন্য অল্প, আমার জন্য এত বেশি, যা আমি নিজে সারা জীবনেও বিশ্বাস করতে পারবো না। এখন থেকে আমি একজন অপরাধী মানুষ। তোমার বাস কয়টায়?
– ৭ টায়
– ৬ টা বাজে। খাবার গরম করে দেই। পেট ভরে খেয়ে যাও। ওখানে গিয়ে তো দিনে একবার খাও। আমি বলে তুমি বেঁচে গেলে। শহরের মেয়ে, যতই ভালোবাসুক এত আদর যত্ন করতে পারবে না। দেখো, খাবার সময় তোমার কিন্তু আমার কথা মনে পড়বে। বউ আনমনা দেখলে ঠিকই ধরতে পারবে।
– এমনভাবে বলছো যেন আমি তাকে আজকেই বিয়ে করছি। খেতে ইচ্ছে করছে না।
– ছোট্ট বাবু, তোমার কি জ্বর হয়েছে? কেন খেতে চাচ্ছো না?
– এত বড় একটা ঘটনা ঘটাতে যাচ্ছো, তারপরেও তুমি এতটা সহজ থাকতে পারছো!
– তোমরা পুরুষেরা ঘটনা ঘটানোর জন্য পাহাড়-পাথার সব এক করে ফেলো। আমরা পারি, তোমরা শুধু শূন্যে রাজপ্রাসাদ বানাতে চাও, আর আমরা আজীবন শূন্যে রাজপ্রাসাদ বানিয়ে বাস করছি।
– সত্যিই আমি ওকে অনেক ভালোবাসি। তোমার কাছে স্বীকার করছি।
– স্বীকার করছি! তোমার স্বীকার করায় কার কী যায় আসে, শুনি? কী ভাবেছো? ভাবছ দু’টোকেই রেখে দিই, না? বেশি খেতে না পারলে কী হবে, তোমাদের চোখ কিছুতেই ভরে না। সাড়ে ছয়টা বাজে, এখন ওঠা উচিৎ। যাও, হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে বিদায় হও।
– একটু আসো, আসো না প্লিজ!
– তা আর হচ্ছে না। ফ্রি ফ্রি অনেক পেয়েছো। যাও, এখন বিয়ে করে নাও।
– তোমাকে বলেছিলাম না আমি মানিব্যাগে ওর একটা ছবি রাখি।
– বলেছিলে তাতে কী? আমি তার ছবি দেখতে চাই না। আমি জানি সে আমার চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত, অনেক বেশি সুন্দর। তাকে আমার দেখারও দরকার নেই, জানারও দরকার নেই।
– কিন্তু আমার দেখানোরও দরকার আছে জানানোরও দরকার আছে। দেখো তো এই মেয়েটাকে চিনতে পারো কিনা?
– বলছিতো দেখবো না।
– তোমাকে দেখতেই হবে।
– ছাড়ো, ছাড়ো বলছি! ছুলে যাচ্ছে তো …
– এই মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি। মূর্খ-অশিক্ষিত-অসতী মেয়েটিকে আমি ভালোবাসি। যে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে, আমার জন্য যে ‘অসতী’ হয়েছে, আমি তাকেই ভালোবাসি।