ছোটগল্প: আগন্তুক // দিব্যেন্দু দ্বীপ

আগন্তুক
একজন পথিক, বেশ পরিপাটি, কিন্তু মুখে তার বিষাদের ছায়া স্পষ্ট। বসে আছে বটগাছতলায় একটি চিকন বেঞ্চে। জিয়লের খুটির উপর একটা বাকল তক্তা সেঁটে পাড়ার ছেলেদের বানানো চিকন একটা বেঞ্চি, বেশ কষ্ট করে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে সে। আমিও এখানে নবাগত, কাজের উছিলায় ঘুরতে এসেছি, উঠেছি ডাকবাংলোতে। আমার জীবনের গল্পটা না হয় উহ্যই থাক, যদিও ইচ্ছে করছে কোনো অচেনা মহীয়সীকে অন্তত কিছুদিনের জন্য সঙ্গী করে জীবনটা সযত্নে তার মাঝে রেখে দিতে। কিন্তু এসব স্বপ্নকে আজকাল অলিক জেনেছি। একটা বিড়ম্বিত একাকী জীবন মেনে নিয়েছি।
বটগাছটা একটা নদীর পাড়ে— কালিগঙ্গা নদী। আমি নদীর কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি, আর মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লোকটিকে দেখছি। ইচ্ছে করছে গিয়ে লোকটির সাথে কথা বলি। কিন্তু আজকাল কিছুতেই আর শক্তি পাই না, শরীর মন সব অসাড় হয়ে থাকে।
হঠাৎ লোকটি উঠে আমার দিকে আসলো। জানতে চাইলো, ভাই, কাছে দূরে কি কোনো হোটেল আছে? দু’একটা রাত থাকতে চাই। বললাম, ব্রিজটা পার হয়ে ওপার গেলেই হোটেল পাবেন। যদি কিছু মনে না করেন, তবে আমার সাথে থাকতে পারেন, আমি এই ডাকবাংলোতে একা আছি। লোকটা একটু ভেবেচিন্তে রাজি হয়ে গেলো। দু’জনে পরিচিত হলাম। ওনার নাম তাহির, বয়সে আমরা প্রায় সমান সমানই হবে বোধহয়। ধুমপানের অভ্যাস আছে কিনা জানতে চেয়ে তাহির সিগারেটের প্যাকেটটা আমার দিকে ধরলো। আমি একটা সিগারেট নিয়ে তার সাথে যুগপৎ ধরালাম। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে, গ্যাস লাইটের আলোয় তার বিষাদময় মুখখানি আরও বিবর্ণ দেখাচ্ছে।
দু’জনেই নদীর দিকে তাকিয়ে সিগারেট টানছি। কয়েক মিনিট কেটে গেছে। শীতকালের মরা নদী, মাঝখান দিয়ে ভটভট করে গোলপাতাভর্তি একটা ট্রলার যাচ্ছে।
ভটভট শব্দের মধ্যেই খুব অপ্রাসঙ্গিকভাবে তাহির আমাকে একটি প্রশ্ন করে বসে— দাদা, আপনার জীবনে কি কোনো অনুশোচনা আছে? হঠাৎ প্রশ্নে আমি একটু হতভম্ব হয়ে গেলাম, কী বলবো বুঝতে পারছি না। কোনো উত্তর না দিয়ে বললাম, চলেন চা খাই। নদীর পাড়েই একটা টং দোকান। সম্ভবত স্বামী-স্ত্রী তারা, পিছনে নদী ঘেষে ছাপড়া ঘর। জিজ্ঞেস করে জানলাম ঐ ঘরেই তারা থাকে। দেখতে কত সহজ জীবন তাদের! অথবা হয়ত খুবই কঠিন! কে জানে?
দু’টো চা, একটা চিনি কম। একটু বয়স হলে সবাই দেখি চিনি ছাড়া চা খায়, আমি বলি চিনি কম। কেন চিনি কম দিয়ে চা খাই তা জানি না, তবে যখনই চা খাই, বলি চিনি কম।
কারো মুখে কোনো কথা নেই, নিরবতা ভাঙতে খালাকে বললাম, খালা, আপনাদের বাড়ি কোথায়? যশোরের ঝিকরগাছায় বাড়ি, সামান্য জায়গা ছিলো, মেয়ে অসুস্থ হলে জায়গা বিক্রী করে চিকিৎসা করেও বাঁচাতে পারেনি। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের স্বামী-স্ত্রীর এখন ভ্রাম্যমান জীবন। বললেন, ভালো আছি। জগৎটা তাদের ছোট, এজন্য আমাদের চেয়ে যে তারা ভালো আছে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
তাহির ভাই একটু বিব্রত, সাথে থাকলে আমার কোনো অসুবিধা হবে কিনা জানতে চাচ্ছেন। সত্যিই আমার কোনো অসুবিধা হবে না, আমি খুব অজানা অচেনা কাউকেই খুঁজছি। আশ্বস্ত হয়ে তাহির ভাই স্বাভাবিক হয়ে বললেন, আমাদের বাড়িটা কিন্তু কাছেই, কিন্তু বাড়িতে কেউ নেই। আমিও সাধারণত আসি না, এবার আসছিলাম পৈতৃক সম্পত্তির খোঁজ খবর নিতে। খুব একটা সুবিধা হয়নি, শরিকরা চায় যাতে আমি না আসি। এই যে বাড়িতে গেলাম, তারা তেমন কথাও বললো না। মা মারা গিয়েছেন মাত্র তিন মাস হলো, এখনই কোনো ভাঙাগড়া করতে ভালো লাগছে না। মা অনেক কষ্ট পেয়ে মারা গিয়েছেন! একথা বলে হঠাৎ একটু আনমনা হয়ে গেলেন তাহির ভাই।
আমরা নদীর পাশ দিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছি। সামনে লাল কাপড়ে ঢাকা একটি মাজারের মতো। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, লম্বা উস্কোখুস্কো চুল, পরিচয়ে মুসলমান, আসলে মানুষ, ওরা জীবনের শূন্যতা মেনে নিয়ে কাওয়ালি গাইছে। আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শুনলাম। তাহির ভাই দেখলাম মাঝে মাঝে অন্যকমনস্ক হয়ে যান। কোথায় যেন হারিয়ে যান!
আবার উনি কথা বলা শুরু করলেন। জানেন, আমার ভাইটা প্যারালাইজড্ হয়ে গেছে। মাত্র আঠাশ বছর বয়স, এই বয়সে তাকে কোনোমতে লাঠি ভর দিয়ে হাঁটতে হয়। ওনার গল্পটা শোনার জন্য আমি কৌতুহলী হয়ে উঠলাম। তাহির ভাই, চলেন, আমরা আবার ঐ বটগাছটার নিচে গিয়ে বসি। আপনার গল্পটা শুনতে চাই।
আপনি ভাইয়ের কথা বলছিলেন। উনি বলে চললেন। এখন ভাইটাকে দেখাশোনার জন্য একজন লোক লাগে। অথচ খুবই ভালো ছাত্র ছিলো, চাকরিও পেয়েছিল, মাত্র এক বছর চাকরিটা করতে পেরেছে। একটা ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়ে ও এবং আমার ছেলে। আমার ছেলের বয়স তখন মাত্র তিন বছর। ও তীর্থকে নিয়ে বেরিয়েছিলো রিক্সায় করে ঘুরতে। একটা ট্রাক ওদের ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আমার ছেলেটারও একহাত কেটে ফেলতে হয়। এরপর থেকে আমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। এক পর্যায়ে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। চার বছর হলো ও ছেলেটাকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় ওর পিতার কাছে চলে গেছে।
মা ছিলেন, কিন্তু এতসব দেখে ওনারও শরীর দ্রুত ভাঙতে থাকে। এরপর তো করোনায় আক্রান্ত হলেন, কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। ১৭ সেপ্টেম্বর স্ট্রোক করে মারা যান।
এখন আমার ছোট ভাইটা ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব নেই। ছেলেটা…. না, এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। কিছু কথা মানুষের না-বলা থাকাই ভালো।
দুর্ঘটনার পরে একটা মামলা করেছিলাম, ট্রাকের মালিক দশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। ওটা ছোট ভাইয়ের নামে পোস্ট অফিশে রাখা আছে, পাশাপাশি আমি প্রতি মাসে দশ হাজার টাকা দিই, এভাবে ওর জীবনটা চলছে। ভবিষ্যত বলে তো আর কিছু নেই। কোনোমতে বেঁচে আছে।
বাড়িতে আসছিলাম পৈতৃক সম্পত্তির কিছু করা যায় কিনা এজন্য। মন টানে না। কিছুই ভালো লাগে না। তারপরও আসতে হলো, প্রতিবেশীরা বলে, খোঁজখবর করো না মোটেও, দেখো গিয়ে তোমাদের শরীকরা গোপনে তাদের নামে জমিজমা রেকর্ড করিয়ে নিলো কিনা। পড়াশুনা চিন্তাভাবনার জীবন আমার, বলেন, এসব ভাবতে কি ভালো লাগে?
তাহির ভাই, আপনি কি ঢাকায় থাকেন? জ্বি, ঢাকায় থাকি। ব্যাংকে চাকরি করি। বেতন যা পাই খুব ভালোভাবে চলে যায়। একা থাকি, খরচ তো বিশেষ কিছু নেই। কোনো বন্ধু বান্ধবও এখন আর নেই, মন থেকে কেন জানি একা হয়ে গেছি। চাকরিটা করতে হবে তাই করি, বাসায় এসে পড়াশুনা, একটু লেখালেখি, এই হলো জীবন। বিয়ে করতে পারেন তো আবার? সবাই তো তাই-ই বলে। কিন্তু কোনো কিছুতে আর মন টানে না, এ অবস্থায় কাউকে জীবনের সাথে জড়ানো ঠিক না। জীবন নিয়ে যেভাবে ভাবতাম, সমাজটাকে যেভাবে দেখতে চাইতাম, সেসবও কিছু হলো না, আবার সংসারটাও হলো। সবই এখন এলোমেলো লাগে। তাহির ভাই আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। একটা সিগারেট ধরালেন, আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম।
ফোনে কেয়ারটেকারকে খাবারের কথা বলা ছিলো। রুমে দু’জনের খাবার রেখে গেছে। ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার ছেলেটা বোধহয় সদ্য চাকরি পেয়েছে। অল্প বয়স, কিন্তু সারাক্ষণ কেন জানি মনমরা হয়ে থাকে। ওর ছোট্ট একটা মেয়ে শিশু আছে। শিশুটার জন্য আমরা কিছু চকলেট বিস্কুট নিয়ে এসেছি। ফোনে ওকে ডেকে ওগুলো দিতেই একটা লাজুক হাসি দিয়ে ‘কোনো প্রয়োজন হলে বলবেন’ বলে চলে গেলো।
ডাকবাংলোটা অনেক পুরনো। তেমন কেউ বোধহয় এখানে থাকতে আসে না। আমি গত তিনদিনে আর কাউকেই দেখালাম না। নির্জন নিরিবিলি নদীর পাড়ে একটি পুরনো ভবন। কিছটা ভুতুড়ে বলা চলে। তাহির ভাইকে পেয়ে আমি খুশি, একাকীত্ব উপভোগ করতেও মানুষের একাকী কাউকে প্রয়োজন হয়।
দু’জনে খেয়ে নিলাম। রাত কম হয়নি, ঘুমিয়ে পড়ার আয়োজন সেরে যে যার মতো শুয়ে পড়লাম। আমি দ্রুতই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। খুব সকালে ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখি তাহির ভাই বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। আমি সন্তর্পণে রুম থেকে বেরিয়ে নদীর পাড় ধরে অনেকক্ষণ হেঁটে আসলাম। রুমে এসে টেবিলে হাত দিয়ে বুঝতে পারলাম রাতে ডায়েরিটা হয়ত তাহির ভাই পড়েছেন। একটু বিরক্তই হলাম। আবার ভাবলাম লোকটা খুব ভালো, অতটা সাতপাঁচ ভাবেন না বোধহয়।
উনি ঘুম থেকে থেকে উঠতে উঠতে দশটা বাজালেন। দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে নিতে বললাম। দেরি হলে কাছের দোকানটাতে নাস্তা থাকে না। দু’জনে রেস্টুরেন্টে গিয়ে তেলছাড়া পরোটা, ডিম আর ভাজি দিয়ে নাস্তা করলাম। কালকে থেকে উনি এই প্রথম হাসলেন— ‘তেল ছাড়া পরোটা বাঙালির এক যুগান্তকারী আবিষ্কার’ এটা বলে হাসতেই থাকলেন। ‘পরোটা চাই কিন্তু তেলের ক্ষতিটা নেব না! রুটি হলে আবার তুলতুলে নরমই লাগবে।’ দু’জন আমরা একচোট ভালোই হেসে নিলাম— যেন কতদিনের আমরা পরিচিত! খাওয়া শেষে এসে আবার বটগাছ তলায় বসলাম। তাহির ভাই একটা কবিতা শোনাতে চাইলেন। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। উনি শুরু করলেন—
আমি চেয়েছিলাম
একটা সুন্দর পরিপাটি জীবন,
দায়িত্ববোধে খাঁটি,
আমি আপন করতে চেয়েছিলাম
বাঙলার মানুষ, জন্মভূমি, এ মাটি।
কোথায় যেন ছন্দপতন ঘটে গেছে,
আমার ভুল, নাকি নিয়তি?
চৈত্রের খররৌদ্রে টুটাফাটা
মাঠের মতো নিস্ফলা এ সময়,
বড়ই দুঃসময়;
শশব্যস্ত মন,
তবু শরীরে এখন আমার কচ্ছপ গতি।
কেউ কিছু আশা করে নেই আর,
জানি ওরা আমার দিকে,
শুধু আমার দিকে পথ চেয়েছিলো বারবার!
আমি নিরুপায়,
সব চেষ্টা কেন জানি ভীষণ বিফলে যায়;
বানডাকা নদীও তৃষ্ণার্ত আমায় দেখে
তড়িৎ শুকায়!
সবার মতো রোজ বড় হয়
তবু আমার সন্তানের শৈশব না ফুরায়।
অসহায়! সত্যিই কি আমি আজ অসহায়?
আমি মুখ ভার করে বললাম, তাহির ভাই, আপনি আমার ডায়েরি পড়েছেন? কবিতা একটা মুখস্থও করে ফেলেছেন? তাহির ভাই আমার পিঠে একটা চাপড় দিয়ে বললেন, জীবনে এতটা আপন তো লাগেনি কিছু। ডায়েরিটা পড়েছি বলে মাপ করবেন, তবে না পড়লে ঠকতাম।
আচ্ছা, আপনি অটিস্টিক শিশুদের জন্য একটা আবাসিক স্কুল করতে চাচ্ছেন? চাচ্ছি, কিন্তু পেরে উঠছি না। আমাকে সঙ্গে নেবেন? যদি কিছু মনে না করেন প্রাথমিক বিনিয়োগটা আমিই করতে চাই। আমি একটু আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম। নিজের অজান্তেই চোখ থেকে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। কথা আর কিছু এগোলো না। তাহির ভাই নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে প্যাকেটটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।