ছোটগল্প: বিচার // শেকস্ রাসেল

বিচার
রোজকার মতো পথ দিয়ে যাচ্ছিল মধ্যবয়সী একটা লোক। রোজই এই পথ দিয়ে সে সাইকেল চালিয়ে কাজে যায়। মজুরির চাকরি। কাজে গেলে টাকা, না গেলে টাকা নেই। মাঝে মাঝে তা-ও নেই, টাকা আটকে রেখে জিম্মি করে। তবু যেতে হয়। মানুষ গিজগিজ করছে সবদিকে, এত কাজ কোথায়?
যথাস্থানে পৌঁছুনের কিছু আগে সাইকেল রিক্সার সাথে বেঁধে লোকটার ডান পায়ের গোড়ালির উপর দিয়ে বেশি খানিকটা কেটে যায়, প্যান্টও ছিঁড়ে যায়। কী করবে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ফুটপথে সাইকেলটা রেখে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকে।
রুক্ত পড়েই যাচ্ছে … লোকটার সেদিকে খেয়াল নেই, সে ভাবছে আজকে কাজেও যাওয়া হবে না, পকেটেও টাকা নেই, তাহলে বাজারটা হবে কীভাবে?
স্বামী-স্ত্রী দুজনে ভাগ করে নিয়েছে সংসারের খরচ— তার উপার্জন দিয়ে বাজার চলে, স্ত্রীর উপার্জন দিয়ে বাসা ভাড়া এবং টুকিটাকি খরচ চলে। দুই বাচ্চার পড়াশুনাও টেনেটুনে কোনোমতে চালিয়ে যাচ্ছে।
বাসায় বলতে গেলে বিশ টাকাও থাকে না, তিনশো টাকায় চারজন মানুষের একদিনের বাজার— লোকটা অবশ্য তিনদিন পর পর একসাথে নয়শো টাকার বাজার করে। খুব হিসেব করতে হয়, নইলে কোনও না কোনও দিকে টান পড়ে যাবেই।
আজকের হিসেব নিয়ে সে যখন খুব চিন্তিত হয়ে আছে তখন হঠাত শক্ত জুতোর পায়ের গুতোয় চমকে ওঠে। স্যুট টাই পরা এক ভদ্রলোক ফুটপথ ধরে যাচ্ছিল, পলিশ করে জুতো লোকটার প্যান্টের সাথে লাগতেই তার চকচকে জুতোর উপরে একটু রক্ত লেগে যায়। ভদ্রলোক বেদম চটেছে, পারলে লোকটাকে মেরেই বসে। চিতকার করছে শুনে দূর থেকে দৌঁড়িয়ে আসে একজন পুলিশ সদস্য- ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে পুলিশ সদস্য কিছু একটা আঁচ করে, এরপর আহত লোকটিকে শাঁসিয়ে বলে মাদার*** এখানে কি বসার জায়গা? ওঠ আগে, ভাগ! ভদ্রলোক আহ্লাদিত হয়ে ‘যত্তসব আবর্জনা’ বলে পকেট থেকে টিস্যু বের করে জুতো থেকে রক্ত মোছার চেষ্টা করে।
লোকটা সাইকেল কোনোমতে তুলে এগোনের চেষ্টা করে— পায়ে বল পাচ্ছে না, রক্ত বোধহয় এখনও পড়ছে— রক্ত জমাট বেঁধে জড়িয়ে গেছে প্যান্টের ছেঁড়া অংশ। প্যান্টের ছেঁড়া থেকে সুতো বেরিয়ে ঢুকে আছে পায়ের কাটা খাঁজে, তাতে টান পড়ে ব্যথা আরও বেশি করছে।
একটু সামনে গিয়ে মসজিদের পিছনের গেটের পাশে বসে। জায়গাটা একটু চওড়া, তাই ভাবে এখানে হয়ত কারও সমস্যা হবে না।
নামাজের সময় প্রায় হয়ে গিয়েছে। একটু পরেই মুসল্লিরা আসতে শুরু করে। দুএজন করে মসজিদে ঢুকছে। ঢোকার সময় তারা আড় চোখে লোকটিকে দেখছে।
মসজিদের দারোয়ান সম্ভ্রান্ত মুসল্লিদের মনোভাব বুঝতে পেরে সাথে সাথে লোকটির দিকে ছুটে আসে। বলে, তুমি এইখানে বইসো না, এইডা তো পার্ক না! তোমার প্যান্টের এ কী শ্রী! ড্রেনে পড়ছিলা নাকি সাইকেল নিয়া? এই অবস্থায় মসজিদে আবার ঢুইকো না কিন্তু। যাও অ্যান তে। অনেকটা অনিচ্ছুক খারাপ ব্যবহার, কারণ, এটাই তার চাকরি।
লোকটা ওঠার চেষ্টা করে প্রথমবার ব্যর্থ হয়— যতখানি কেটেছে হাসপাতালে গেলে কমপক্ষে ছয়টা সেলাই লাগবে। পা-টা কিছুতেই আর নড়ছে না। খুড়িয়ে খুড়িয়ে সাইকেল ঠেলে চেষ্টা করে বাসার দিকে ফিরতে, রাস্তা ক্রস করে ওপাশে যাওয়ার ক্ষমতাটুকু আর নেই, তাই রাস্তার ডান পাশ ধরেই এগোতে থাকে।
খুড়িয়ে খুড়িয়ে খুব ধীরে এগোতে হচ্ছে, মনোযোগ রাখতে হচ্ছে পায়ের দিকে। হঠাত একদম পাশ ঘেষে সামনে একটি গাড়ী দেখে চমকে ওঠে। সামনে লেখা ‘ভ্রাম্যমান আদালত’। নেমে আসেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব, পিছনে দাঁড়িয়ে যায় অস্ত্রহাতে দুজন পুলিশ। একদম চাক্ষুস অপরাধ, তাই কোনও দেরি হয় না, সাথে সাথে ম্যাজিস্ট্রেট লোকটিকে জরিমানা করে। আসলে ব্যাপারটা হয়েছে— ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ীটি অনেকক্ষণ ধরে লোকটির মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, এতেই সাহেব অপমান বোধ করেছে। “সবাই রাস্তা ছেড়ে দিচ্ছে, আর তুই ব্যাটা একটা ভাঙা সাইকেল নিয়ে এরকম নির্লিপ্ত!”
রাস্তা ছেড়ে না দেওয়ায় তাই চঠে গিয়েছে খুউব। না হলে অপরাধে আর কী এমন আসে যায়, দেখাই তো যাচ্ছে ফুটপথ ধরে মটর সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে, একটু সামনেই রাস্তায় বাড়ি নির্মাণের বালু ফেলা হয়েছে। চারপাশে কত অপরাধ! কে না জানে এসব? যেখানে অর্থ বা খ্যাতি— অন্তত কিছু একটা নেই সেখানে অপরাধ দমন করতে উদ্যোগী হওয়ার মতো ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ কজনই আছে আসলে?
লোকটা একেবারে কিংবর্ত্যবিমূঢ় হয়ে যায়। কিছু বলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। শুধু বলে, আমার কাছে টাকা নাই। সাথে সাথে ম্যাজিস্ট্রেট চটে গিয়ে পুলিশকে বলে, সাইকেল গাড়ীতে তোলেন, এটা নিলাম করে জরিমানার টাকা আদায় করা হবে। সাইকেলটি নিয়ে পুলিশ লোকটিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফুটপথে তুলে দেয়। লোকটি কোনোমতে সামলে নিয়ে একবারও পিছনের দিকে না তাকিয়ে ধীরে ধীরে বাসার পথে হাঁটতে থাকে।