ছোটগল্প: শত্রু // দিব্যেন্দু দ্বীপ

বান্দরবান
জঙ্গলের মধ্যে আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। পথ খুঁজে পেতে পেতে সন্ধ্যা ঘুরে গিয়েছে। এখন আর বান্দরবান সদরের কোনো গাড়ি পাওয়া যাবে না। আমরা একটু ভয়ই পাচ্ছি— একে তো পাহাড় জঙ্গল তার ওপর জায়গাটা খুবই নির্জন। আমরা পাহাড়ি সরু পথ ধরে হেঁটে আরেকটু সামনের দিকে অগ্রসর হলাম। হঠাৎ পাহাড় ঘেরা জঙ্গলের মধ্যে কয়েকটি বাড়ি চোখে পড়লো। গুচ্ছগ্রামের মতো এক জায়গায় কয়েকটি বাড়ি। এদিকে ওদিকে শুধু জঙ্গল আর পাহাড়। এখানেই যেভাবে হোক আমাদের থাকতে হবে, আর কোনো উপায় নেই।
আমরা তিন বন্ধু একটা বাড়িতে ভয়ে ভয়ে ঢুকলাম। দু’টো বাচ্চা উঠোনে খেলছিলো। ওরা আমাদের অবাক হয়ে দেখতে থাকলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছিমছাম গড়নের ত্রিশোর্ধ একজন নারী উঁচু মাচা ধরনের সাজানো একটি ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন। জনৈক সে নারী সন্ধ্যাত্তীর্ণ অন্ধকার ভেঙ্গে জ্যোৎস্নালোকিত পাহাড়ি এ জঙ্গলে তিনজন অপরিচিত যুবককে দেখে অবাক হচ্ছেন না বলে আমরা অবাক হচ্ছিলাম। আমরা কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, এ সময় আমাদের থামিয়ে দিয়ে তিনিই বললেন, ঘুরতে এসে আপনারা পথ হারিয়ে ফেলেছেন, তাই না? অনেকক্ষণ ধরে আপনাদের এদিকে ঘোরাঘুরি করতে দেখছি। বন্য হাতি আছে, সন্ধ্যার পর এদিকে আর ঘোরাঘুরি করা ঠিক না।
আমরা সায় দিলাম, ভয়ও পেলাম। জনৈক সে নারী সত্যিই আর কিছু শুনতে চাইলেন না। একটা “পরোয়া করি না ধরনের ভাব”। বললেন, আমার স্বামীর ফিরতে রাত হবে, তিনি না ফেরা পর্যন্ত আপনাদের থাকার বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না। তিনি মূলত ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় কথা বলেন। একসাথে পুরোটা বোঝা যায় না। একটু সময় নিয়ে কথাটা বোঝার পরে আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। হঠাৎ বেশি রাতে ওনার স্বামী আসার পরে আমাদের রাখতে অস্বীকার করলে তখন কী হবে! আরও অনেক কিছু ভেবে ভয় পাচ্ছিলাম। মূল ঘরের বিকল্প পুরনো ছোট একটি মাচা ঘরের বারান্দায় পাটি পেতে বসতে দিয়ে তিনি আমাদের কিছুটা আস্বস্ত করলেন। জ্যোৎস্নার তেজ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে- পাহাড়ি এ জঙ্গলে অপরিচিতা এক যুবতী নারীর সামনে আমরা তিনজন যুবক তখন কম্পমান, প্রকৃতির রহস্যময় রূপ দেখার মতো মনের অবস্থা আমাদের তখন কোথায়?
ঘণ্টাখানেক আমরা পাটিতে বসে এবং বাড়ির পুষ্পশোভিত পরিচ্ছন্ন আঙ্গিনায় হাঁটাহাঁটি করে কাটালাম। তখনও আমরা ভাবছি এবং বলাবলি করছি— ওনার স্বামী এসে যদি রাতে আমাদের থাকতে দিতে রাজি না হয়, তাহলে করণীয় কী হবে? আমরা সবাই আশাবাদী যে, ওনার স্বামী মহোদয় আসলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হবে। অন্যথা হলে প্রয়োজনে আমরা এই পাটিতেই রাত কাটাব, সেটুকু অনুমতি হয়ত মিলবে। আর কিছু না ভেবে মাথা থেকে আমরা দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে চাইলাম। কিছু সময় না যেতেই অপরিচিতা আসলেন, আমাদের অবাক করে দিয়ে বললেন, আমার স্বামী ফিরতে অনেক রাত হবে, আমি আপনাদের রাতে খাওয়ার ব্যবস্থা করি। আমরা সবাই তখন এতটাই ক্ষুধার্ত যে, মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পেয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। সবাই ঠোঁট কামড়াচ্ছি দেখে উনি সপ্রতিভ হয়ে বললেন, লজ্জা পাবেন না, আমাদের বাড়িতে সব সময় লোকজন আসত, আলোচনা, গানবাজনা চলত, তিন বছর হলো আর কেউ আসে না। যেভাবেই হোক আপনারা এসেছেন, আমার কিন্তু ভালোই লাগছে। আমরা কেউ সত্যিই কোনো কথা খুঁজে পেলাম না। উনি চলে গেলেন।
আধা ঘণ্টার মধ্যেই আমাদের খেতে ডাকলেন! তার মানে রান্না উনি আগেই শুরু করেছিলেন। আমরা আবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। “থাকার ব্যবস্থা না হলেও খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে, কপাল ভালো মনে হচ্ছে।” একথা বলে বেপরোয়া ঈমন তড়িৎ নামতে গিয়ে মাটির কলসি একটা পায়ে বাঁধিয়ে ফেলে দিয়েছে। ভাঙ্গেনি, ডং ডং শব্দ করে উঠোনের দিকে গড়িয়ে গিয়েছে খালি কলসিটা।
আমরা রান্নাঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। অপরিচিতা আমাদের হাত-মুখ ধোয়ার জন্য টিউবওয়েল দেখিয়ে দিলেন। গামছা আমাদের সাথেই আছে, তারপরও ওনার বাড়িয়ে দেওয়া গামছাটা নিলাম। ফ্রেস হয়ে বাঁশের মাচা করে বানানো ডাইনিং টেবিলে বসলাম। বসার বেঞ্চটাও বাঁশের মাচা করে বানানো। আমাদের অবাক করে দিয়ে একে একে খাবারগুলো টেবিলে হাজির হলো— পাহাড়ি মুরগির মাংস, ডাল এবং মিষ্টি কুমড়ার ফুল ভাজি। আমাদের জন্যই কিনা, রান্নাটা বাঙালি ঢংয়েই করা। এতটাই ক্ষুধা পেয়েছিল— এ খাবার এ মুহূর্তে স্বর্গের অমৃত সমান। তার মানে উনি আমাদের যখন খাওয়ার কথা বলেছেন তার আগে থেকেই খাবার প্রস্তুত করা শুরু করেছেন!
খাওয়ার পরে অপরিচিতা আমাদের মূল ঘরের একটি রুম দেখিয়ে দিয়ে বললেন, বিছানা করা আছে, আপনারা শুয়ে পড়তে পারেন। আমার স্বামীর আসতে হয়ত আরও দেরি হবে। ওনারা বাচ্চারা সম্ভবত ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরা সুবোধ বালকের মতো রুমে ঢুকে শুয়ে পড়লাম। ভাবলাম— উনি হয়ত ওনার স্বামীর সাথে মোবাইলে সব কথা সেরে নিয়েছেন। সবাই খুব ক্লান্ত ছিলাম। ওরা দু’জন খুব দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লো। আমিও এক সময় ঘুমিয়ে গেলাম। আমার মধ্যরাতে ঘুম ভাঙ্গার অভ্যাস। আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না। ইচ্ছে করছে— উঠে গিয়ে একটু বাইরেটা দেখে আসি। দ্বিধাদ্বন্দ্বে থেকে শেষপর্যন্ত উঠে রুমের দরজা খুললাম। দরজা খুলেই একটা ধাক্কা খেলাম, দেখি— অপরিচিতা চুপ করে বসে আছেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। আমাকে দরজা খুলে বাইরে আসতে দেখে বললেন, ওহ, আপনি বোধহয় বাইরে যাবেন। আমি বললাম, না, এমনিতেই আমি একটু বের হয়েছি, হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো তাই। আপনার স্বামী বোধহয় এখনো ফেরেননি?
উনি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, উনি ফেরেননি, আর কোনোদিন ফিরবেনও না। আমি বিস্মিত হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। উনি বলে গেলেন— উনিও আপনাদের মতো ছিলেন, ঘুরতে পছন্দ করতেন, খুব শিক্ষিত ছিলেন না, কিন্তু পড়াশোনা করতে পছন্দ করতেন, আমাকেও পড়াতেন। ওনার রুমটা দেখবেন? আসেন। আমি ওনার পিছু পিছু গেলাম। উনি ছোট্ট একটি টর্চের আলো জ্বেলে বইয়ের তাকগুলো দেখালেন। বললেন, উনি চাইতেন— পাহাড় জঙ্গল কেউ নষ্ট করবে না, কেউ ধ্বংস করবে না, কেউ দখল করবে না। উনি পাহাড়ি শিশুদের পড়াতেন। লোক ডেকে বাড়িতে এনে খাওয়াতেন। সভা সমাবেশ করতেন। ওনার কয়েকটি ছোট ছোট ব্যবসা ছিলো। আমরা খুব ভালো ছিলাম। স্বপ্নেও আমরা ভাবিনি– আমাদের জীবনে এমন কোনো বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এমনই এক শেষ রাতে যমদূতের মতো চার পাঁচ জন পোশাক পরা লোক এসে ওনাকে ধরে নিয়ে যায়। আর কোনোদিন উনি ফিরে আসেননি।
“আমি একটা কথা বলতে চাই, আমি একটা কথা বলতে চাই! আপনাকে বলব? আপনাকে বলা যায়?” আমি হতবিহ্বল হয়ে একবার উঁচু গাছের ফাঁক দিয়ে মৃতপ্রায় চাঁদের পানে, একবার ঐ নারীর পানে তাকাচ্ছিলাম। অবশেষে তিনি বললেন। জঙ্গলাকীর্ণ একটি পাহাড়ি বাড়ির নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে শেষরাতের ফ্যাকাশে চাঁদের আবছা আলোয় আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন, “তাকে খুন করা হয়েছে, অবশ্যই তাকে খুন করা হয়েছে।”
কিছুক্ষণের জন্য উনি যেন অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেলেন। রুমে ঢুকে একটি বাহিনীর পোশাক নিয়ে আসলেন। ঘৃণাভরে পোশাকটি সামনে ছুড়ে ফেলে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন, এরপর আবার চিৎকার করে বললেন, “এরা তুলে নিয়ে গিয়ে সেদিন আমার স্বামীকে খুন করে ফেলেছে! লাশটাও কোনোদিন বুঝায়ে দেয়নি। সবাই জানে আমার স্বামী নিখোঁজ। তিন বছর ধরে নিখোঁজ! এ কেমন নিখোঁজ?” দিগ্বিদিক হয়ে আমি প্রশ্ন করলাম, “ওনাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল কি পাকিস্তানি বাহিনী?” উনি নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলেন, “তিন বছর আগে পাকিস্তানি বাহিনী আসবে কোথা থেকে?”