ছোটগল্প: জয় বাংলা

 

 

কেন আমি অস্ত্র হাতে নিয়েছি? কেন মারব আমি ওদের?
আমার হাত কাঁপছে, আমার শরীর অবশ হয়ে আসছে। আমি পেরে উঠছি না। আমি পারব না, নরপশুর রক্ত ঝরাতেও আমি এমন অপারগ!!

কেন পারব না? আমাকে পারতে হবে, আমাকে পারতেই হবে।

তোমরা জানো না? তোমরা শুনতে চাও না?

ওরা সশস্ত্র দশ বারো জন সেদিন ২৫ শে মার্চ গভীর রাতে আমার বাড়িতে প্রবেশ করেছিল। আমি সেদিন বাসায় ছিলাম না। নিচে বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক ছিল, উপরে ওঠার সময় তাকে বেঁধে রেখে গিয়েছিল। পাকিদের সেদিন চিনিয়ে নিয়ে গেছিল আমার সহকর্মী সোবাহান!

আমি আর ভাবতে পারছি না। আমার গলা শুকিয়ে আসছে। দীর্ঘ একাকীত্ব আমাকে মৃত্যসম করে রেখেছে গত ৪২টি বছর। খুনীদের হাসি-ঠাট্টার মাঝে স্বাধীন বাংলাদেশে এখনো আমার মত বেঁচে আছে জানি না আরো কত অসহায় বৃদ্ধ!

আমার ছোট মেয়েটি সেদিন ওদের বলেছিল,
“তোমাদের আমি অনেক পয়শা দেব, দেখবে আমার কতগুলো জমানো পয়শা আছে? আমার অনেক খেলনা আছে, পুতুল আছে, সব তোমাদের দিয়ে দেব। সোবাহান কাকু, তুমি না হয় পতুলটি শাহনাজকে দিও। ছেড়ে দাও তোমরা আমার দিদি আর মাকে। নিয়ে যেও না ওদের। প্লিজ, ওদের তোমরা ছেড়ে দাও।”

যাওয়ার সময় মাসুম বাচ্চাটিকেও ওরা খুন করে রেখে গিয়েছিল! নরপশুরা ওকেও নির্যাতন করে হত্যা করেছিল। এখনো আমি শুনতে পাই, চারতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে তানু লাফাচ্ছে আর চিৎকার করে ওর মাকে বলছে, “বাবা আসছে, বাবা আসছে।”

নাহ! আমি এখনো কেন অস্ত্র ধরে আছি? কেন কাঁপছি আমি?

ছোট মেয়েটি ওর মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে অামায় বলত, “বড় হলে আমি ঠিকই এখন তোমায় খিচুড়ি রান্না করে দিতাম! মুচকি হেসে ওর মা আড়াল হত আরো।” ওরা রেহাই দেয়নি নিষ্পাপ শিশুটিকেও।

ঐ তো সোবাহান, সোবাহান যাচ্ছে …

আমি কি ভীরু? আমি কি কাপুরুষ? কেন আমি সোবাহানকে যেতে দিলাম? কেন তাকে হত্যা করলাম না?

কত বছর কেটে গেল, আমি এখনো বেঁচে রইলাম নতজানু হয়ে, হাহাকার করে! ছবিগুলো এখনো আমার সাথে কথা বলে। মিনুর দিকে তাকিয়ে রাতভর কতদিন যে কত আবোল তাবোল বকেছি!

নিজেকে ধিক্কার দিই অবশেষে, কেন যেতে দিয়েছিলাম নরপশুটাকে, কেন দেশটাকে, সভ্যতাকে হরণ করতে দিয়েছিলাম ওদের আবার!

আমি কি ভুল শুনছি, না, ভুল শুনছি না, স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি- “জয় বাংলা” স্লোগান, এ তো অবিকল সেই স্লোগান! ২০১৩ সাল, তারিখটা ঠিক মনে করতে পারছি না যে, আজকাল কিছুই আর মনে থাকে না। অস্পষ্ট হলেও চোখে দেখি- আজ ৫ ফ্রেব্রুয়ারি, বিস্যুদবার। কারা, তোমরা কারা? কে তোমরা “জয় বাংলা” বলে স্লোগান দিচ্ছ? কী চাও তোমরা?

আমরা বাঙ্গালীর জন্য একটা স্বাধীন দেশ চেয়েছিলাম, অনেক মূল্য দিয়ে পেয়েছিলাম। ওরা আবার তা কেড়ে নিয়েছিল বর্বরভাবে ১৯৭৫ সালে।

তোমরা কি পারবে দেশটাকে ফিরিয়ে দিতে? আমি আসছি, আমাকেও যোগ দিতে হবে তোমাদের সাথে। শরীরটাকে এতটুকু টেনে নিতেই হবে আমাকে অাজ। আমি পারব। “জয় বাংলা”।


গল্পটি ২০১৩ সালের ২৬ মার্চ লেখা। – দিব্যেন্দু দ্বীপ