রোমান্টিক পিরিয়ডের নিরীশ্বরবাদী কবি পার্সি বিশি শেলি

Shelly

১. অতিতের জন্য কেঁদো না, ভবিষ্যতকে ভয় পেয়ো না।

২. কবিতা পৃথিবীর রূপরস অনাবৃত করে এবং পরিচিত জিনিসগুলোকেও এমনভাবে তুলে ধরে যেন সেগুলো কখনো চেনা ছিল না।

৩. কবি হচ্ছেন অন্ধকারে বসে থাকা এমন একটি পাখি যে আপন একাকীত্বের সঙ্গ হিসেবে সুন্দর সকল গান করে।

৪. আজ রাতে এমনই সুধা পান করেছি আমি সরিয়ে রাখো সকল পানপাত্র।

৫. হৃদয়ে হৃদয় মেলে যখন প্রিয়ার অধরে প্রিয় চুম্বন করে।

৬. ইতিহাস সময়ের লেখা একটি পুনরাবৃত্ত কবিতা, যা মানুষের স্মৃতিতে জমা থাকে।

৭. আমাদের গভীর দুঃখগুলো ধারণ করে যে গান সেগুলোই শুধু সুমধুর।

৮. শীত আসলে বসন্ত কি আর দূরে থাকতে পারে?

৯. কবিতা এমন একটি আয়না যেখানে সবই সুন্দর দেখায়, এমনকি বিকৃত কিছুও।

১০. যুদ্ধ হচ্ছে রাজত্বকারীর খেলা, ধার্মিকের আনন্দ, আইনজীবীর আগ্রহ, অস্ত্র কারবারীর ব্যবসা।

পার্সি বিসি শেলি

পার্সি বিসি শেলি

অক্সফোর্ড এ পড়াকালীন নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলো করেছেন যে প্রশ্ন করা যায় না। যে বস্তু দিয়ে এত বিভাজন, যে বিভাজনে মানুষের বহুদিনের অভিযোজন তা ভাঙ্গতে গেলে তারা মানবে কেন? শেলিকে মানল না, দিল অক্সফোর্ড থেকে বের করে। অপরাধ, তিনি ‘নাস্তিকতার প্রয়োজনিয়তা’ শিরণামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। দুই বন্ধু মিলে ঈশ্বর যুগে তা প্রকাশও করেছিলেন— ফলাফল বন্ধু জেফারসন এবং নিজে দুইজনেই বহিস্কার। তাতে কী? জীবনের গান গাইবার জন্য যার জন্ম মৃত্যুপুরীর রাজা ঈশ্বরের সাধ্য নেই তাকে থামায়। শেলি ফরাসি বিপ্ল­বের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। ১৮১১ সালে লিখেছিলেন ‘necessity of atheism’ —এখানে তিনি কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন করেছিলেন:

If he is infinitely good, what reason should we have to fear him?

If he is infinitely wise, why should we have doubts concerning our future?

If he knows all, why warn him of our needs and fatigue him with our prayers? If he is everywhere, why erect temples to him?

If he is just, why fear that he will punish the creatures that he has filled with weaknesses?

মানবতাবাদী তরুণ কবি পার্সি বিসি শেলি জন্মগ্রহণ করেছিলন তৎকালীন ব্রিটিশ সাংসদ টিমথি শেলির পিতৃ পরিচয়ে এবং এলিজাবেথ শেলির গর্ভে। ১৭৯২ সালের ৪ আগস্ট ইংল্যান্ডের সাসেক্সে জস্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তার জন্মের সাথে সাথে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, বায়রনের সাথে ইংল্যান্ড পেয়ে গেল আরেকজন অসাধারণ কবি প্রতিভা। ধনী ঘরেই জন্মেছিলেন— কিন্তু কল্পনার কবি, স্বপ্নের কবি শেলি বিচরণ করতেন স্বপ্নরাজ্যে। সুবিধামতো জীবনযাপন করার সব সুযোগ তার ছিল, তবু বেছে নিলেন ঝঞ্জাময় জীবন। কবিতা মানে ভাবনা, কবিতা মানে মানুষ, কবিতা মানে সৌন্দর্য, কবিতা মানে প্রেম, কবিতা মানে সত্য— জীবনের এসব মোদ্দা কথা যার মনরাজ্যে কীভাবে তিনি সহজ সরল জীবনযাপন করবেন? পথ হারাবেন আবার পথ খুঁজে পাবেন, নিজে হারিয়ে যাবেন, পথ করে যাবেন মানুষের জন্য।

শেলি সেই কাজটিই করেছেন। মানুষের জয়গান গেয়েছেন। মানুষকে পথ দেখিয়েছেন। প্রথমে পড়াশুনা করেন লন্ডনের সিয়ন একাডেমিতে। এরপর ভর্তি হন লন্ডনের সে সময়ের দামী স্কুল– ইটনে। ইটন থেকে অক্সফোর্ডে এবং অবশেষে বহিষ্কার। ইটনে পড়ার সময় থেকে শেলি কবিতা লিখতেন। অক্সফোর্ডে শেলিকে সবাই পাগল শেলি বলত। তা বলুক— সৎ, সত্য, সুন্দরের শক্তিতে যার সাথে সাধারণ মানুষ পারে না তাকে পাগল বলে এসব মানুষেরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চেয়েছে যুগে যুগে। শেলি যুগেও তাই হয়েছে। অক্সফোর্ডে পড়াকালীন বন্ধু জেফারসনকে সাথে নিয়ে ব্যাঙ্গার্থক কবিতা লিখতেন। এমনিতেই শিক্ষকরা তার ওপর খ্যাপা ছিলেন। অবশেষে আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়ে লেখেন– ‘নাস্তিকতার প্রয়োজনিয়তা’ প্রবন্ধটি। প্যাম্পলেট বানিয়ে তা প্রচারও করেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শেলি এবং জেফারসনকে বহিস্কার করা হয়। সাংসদ পিতার মধ্যস্থতায় আবার পড়াশুনায় ফিরতে পারতেন— কিন্তু তিনি যা করেছিলেন তা সঠিক বলেই জানতেন এজন্য পিতার সাহায্য নিতে রাজি হননি, ফলে পিতার সাথে সম্পর্ক চুকে যায়। ঘর ছাড়তেও আর কোন বাধা থাকে না।

১৮১১ সালে যে বছর শেলি অক্সফোর্ড থেকে বহিস্কৃত হন ঐ বছরেই স্কটল্যান্ডে পালিয়ে গিয়ে হ্যারিয়েট ওয়েস্ট ব্রুককে বিয়ে করেন। ইয়ানথি এবং চার্লস নামে হ্যারিয়েটের সাথে কবির দুই সন্তান ছিল। বিয়েটা নিয়ে সামাজিক সমস্যা ছিল অনেক। শেষ পর্যন্ত নিয়ম মেনে আবার তাদের বিয়ে করতে হয়েছিল। সম্পর্ক অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।

১৮১৩ সালে প্রকাশিত হয় শেলির প্রথম উল্লে­খ্যযোগ্য দীর্ঘ দার্শনিক কবিতা ‘Queen mab’ —এই কবিতায় কাব্য চরিত্র ইয়ানথির মাধ্যমে শেলি আশা করেছেন একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে, মানুষ এবং প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হবে, হিংসা হানাহানি বিদ্বেষ সব শেষ হবে। এই কবিতায় গওউইনের সমাজ দর্শনের ছাপ রয়েছে, যেহেতু ইতোমধ্যে শেলি গওউইনের সংস্পর্শে এসেছিলেন। এর মধ্যে আবার গওউইনের কন্যা মেরির সাথে শেলির প্রেম অনিবার্য হয়ে ওঠে। দ্রুত বিয়েও হয়ে যায় তাদের। দুজনে পালিয়ে গিয়েছিলেন, আবার অর্থকষ্টে ফিরে আসেন। ফিরে এসে জর্জ গর্ড, লর্ড বাইরন প্রমুখের সাথে লেক জেনেভায় কিছু সুন্দর সময় কাটান। এখানে বসেই মেরি শেলি রচনা করেন ‘ফ্রাঙ্কেসস্টাইন’, একই বছরে প্রকাশিত হয় শেলির Alastor এবং The Spirit of Solitude। শেলির সুসময় শেষ হয়েছিল হ্যারিয়েটের আত্মহত্যার মধ্যে দিয়ে। হ্যরিয়েট আত্মহত্যা করেন ১৮১৬ সালে। এ সময় শেলিকে কিছুদিন জেল খাটতেও হয়েছিল।

১৮১৭ সালে শেলি Laon and Cythna নামে একটি দীর্ঘ বর্ণনামূলক কবিতা লেখেন। ধর্মের প্রতি সরাসরি অনাস্থা প্রকাশিত হবার ফলে বইটি প্রকাশিত হবার পর পর তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে। পরবর্তীতে The Revolt of Islam নামে ১৮১৮ সালে বইটি আবার প্রকাশিত হয়। শেলির জীবনের শেষ চারটি বছর কেটেছে ইতালিতে এবং এই সময়েই রচিত হয়েছে তার বেশীরভাগ শ্রেষ্ঠ লেখা। ১৮২০ সালে লিখেছিলেন তার বিখ্যাত গীতিকবিতা ‘Prometheus Unbound’ —এটি গান, নাটক এবং কবিতার অপূর্ব এক সম্মেলন।

সমস্ত ইতালি ঘুরে ঘুরে দেখার অভিপ্রায় ছিল তার। এ সময় ফ্লোরেন্সে এক অধ্যাপকের সাথে শেলির পরিচয় হয়। এখানেই পরিচয় হয় আশ্রম আশ্রিত দুইজন রুপসী তরুণীর সাথে। কবির প্রেম আবারো অনিবার্য হলো! বড় বোন এমিলিয়ার রূপে মুগ্ধ হলেন তিনি। শেলির জীবনের এই নতুন নারীকে মন থেকে মেনে নিতে না পারলেও মেরি কখনো মুখ খোলেননি— হয়ত এতদিনে তিনি বুঝে গিয়েছিলেন কবি মন অস্থির হবেই, প্রকৃতির প্রেমে সে পড়বেই, তাই বলে মোহময় প্রকৃতিকে সে কখনো রক্তাক্ত করবে না, বিপরীতে রক্তক্ষরণ হবে তার নিজের হৃদয়ে।

অবশ্য এমিলিয়ার সাথে শেলির সম্পর্ক বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি। মেরিএমিলিয়া সতীর্থ হবার আগেই এমিলিয়ার অন্যত্র বিবাহ হয়ে যায়। এবার ব্যথিত শেলি আরো বেশি করে ডুব দিলেন কাব্য চর্চায়। একে একে জন্ম নিল—

ode to the west wind, The cloud, The skylark, Song to prosperine, The Indian serenadae, Music, When soft voices die, On a Faded violet, To night.

শেলি যখন সৃষ্টির আনন্দে মেতেছেন, একের পর এক রচনা করে চলেছেন অমর সব কবিতা, এমন সময় একটি দুঃসংবাদে তিনি শোকাহত হয়েছিলেন। খবর আসল বন্ধু জন কিটস্ মারা গিয়েছেন। কবি কিটসের এই প্রয়াণে তিনি রচনা করলেন Adonais —মর্মস্পর্শী শোকগাঁথা হিসেবে বিশ্বসাহিত্যে এটি অমর হয়ে আছে।

…. He lives, he wakes—’tis Death is dead, not he;

Mourn not for Adonais. —Thou young Dawn,

Turn all thy dew to splendour, for from thee

The spirit thou lamentest is not gone;

Ye caverns and ye forests, cease to moan!

Cease, ye faint flowers and fountains, and thou Air

Which like a mourning veil thy scarf hadst thrown

O’er the abandoned Earth, now leave it bare

Even to the joyous stars which smile on its despair!

শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি পাবার জন্যে ১৮২২ সালে শেলি বন্ধু লা স্পেজিয়ার সাথে সাগর তীরে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন। শেলি সমুদ্র ভালবাসতেন কিন্তু সাঁতার জানতেন না। জুন মাসে সংবাদ পেলেন কবি লে হান্ট ইল্যান্ড থেকে ইতালিতে এসেছেন। বন্ধু স্পেজিয়াকে সাথে নিয়ে গেলেন হান্টের সাথে দেখা করবার জন্য। কয়েকদিন হান্টের সাথে কাটিয়ে আবার ফিরে আসেন লেগহর্নে। সেদিন আবহাওয়া ভালো ছিল না। জেলেরা নৌকায় চড়তে না করেছিলেন। জেলেদের কথায় পাত্তা দিল না কেউ। নৌকা নিয়ে ভেসে চললেন। কিছুক্ষণ পরেই ঘন মেঘে ছেয়ে যায় আকাশ, ঝড়ে সাগর উত্তাল হয়ে ওঠে। অল্প সময়ের মধ্যেই ঝড় থেমে যায়, মেঘও কেটে যায়, কিন্তু শেলির নৌকা আর খুঁজে পাওয়া গেল না। কয়েকদিন পরে সমুদ্র তীরে একটি মৃতদেহ পাওয়া যায় যার এক পকেটে ছিল কিটসের লেখা একটি কবিতার কপি অন্য পকেটে ছিল সফোক্লিসের নাটক।

শেলির মূল পরিচয় বিপ্ল­বী আদর্শবাদের কবি হিসেবে। ফরাসি বিপ্ল­বের আদর্শ তার মনোজগতকে এক নতুন প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। সে যুগের অন্ধ সমাজের বন্ধাত্বে তার অন্তর বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। তার প্রকাশ দেখা যায়- The Revolt of Islam এবং Promethous Unbound এ । শেলির চিত্ত চিরস্বাধীন। জিউসের পতনেই তার মুক্তি। শেলি কল্পনার মধ্যে খুঁজে ফিরেছেন এক আদর্শ জগৎ— সন্ধান করেছেন অনাগত যুগকে। যেখানে থাকবে প্রেম, সৌন্দর্য, স্বাধীনতা। তিনি দেখতে পেয়েছেন পৃথিবীর মানুষ সেই পথেই এগিয়ে চলেছে। একদিন সব অন্ধকার দূর হবে। পশ্চিমা বাতাস সব মলিনতা দূর করে দেবে। তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা Ode to the west wind এ লিখেছেন— এক প্রলয়ঙ্কারী ঝড় এসে সব মলিনতা, মৃত চিন্তা উড়িয়ে নিয়ে যাবে, সৃষ্টি করে যাবে নব জীবনের সূচনা। স্কাইলার্ক পাখির ডানায় ভর দিয়ে কবি সমস্ত মলিনতা, জীবনের সব অন্ধকার, সব কলুষতা থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন। কবি লিখেছেন–

The trumpet of a prophecy! O Wind,

If Winter comes, can Spring be far behind?


পরিচয়  কবি
জাতীয়তা  ব্রিটিশ
সাহিত্য আন্দোলন  রোমান্টিসিজম
উল্লেখযোগ্য রচনাসমূহ  Ode to the west wind, Ozymandias, Adonaïs, Love’s Philosophy, Queen Mab

লিখেছেন

দিব্যেন্দু দ্বীপ

লেখক ও গবেষক

Dibbendu Dwip