নাস্তিক ।। শেকস্ রাসেল

শালা একটা নাস্তিক!
– ক্যামনে বুঝলি?
– নিজেই কইছে একদিন।
– কী কইছে?
– কইছে, “কোন ঈশ্বর নেই, থাকার দরকারও নেই।” ও শালা বেজন্মা।
এরপর মহব্বতের সাথে দীর্ঘদিন দেখা নেই। নিতাই সম্পর্কে ও যে কথাগুলো বলেছিল তা অবশ্য ভুলতে পারি না। আমরা এত ভাল বন্ধু ছিলাম, অথচ নাস্তিকতার কথা বলায় নিতাই মহব্বতের শত্রু হয়ে গেল!

এরপর অনেক দিন গিয়েছে। আমিও সংসারে থিতু হয়েছি। মহব্বত বাংলাবাজারে বিশাল একটা প্রেসের মালিক। প্রকাশনীও দিয়েছে একটা। কী যেন নাম… মনে নেই। গাইড বই বের করে। একটা সৃজনশীল প্রকাশনীও নাকি আছে। বইমেলায় স্টল নেয়। শুনলাম, প্রচুর টাকা করেছে।

হঠাৎ একদিন নিতাইয়ের সাথে দেখা। নিতাইও খুব খারাপ নেই। লেখালেখি করে, কিছু বইপত্রও বেরিয়েছে। কিন্তু … মানে, ভাবছিলাম, এসব লেখালেখি দিয়ে তো টাকা আয় হওয়ার কথা না, তাহলে ও চলে ক্যামনে!

রাগঢাক না করে কথাটা পাড়লাম। নিতাই, বিয়ে করেছিস?
– কি যে বলিস ! আমার বয়স কি কম হয়েছে নাকি? ছেলের বয়স চার বছর হতে চলল।
– থাকিস কোথায়? মানে ঢাকায় তো আছিস, বাসা কোথায়?
– তাঁতি বাজার থাকি। ওখানে ছোট্ট একটা ফ্লাট কিনেছি।
– নিতাই, তুই কি কোন ব্যবসা করিস, নাকি শুধু লেখালেখি করিস?
– ছোটখাট একটা ফার্ম আছে, তাছাড়া একটা বইয়ের খুব কাটতি হয়েছে। ওটা দিয়ে বছরে যা পাই, বলতে গেলে তা দিয়েই চলে যায়। তাছাড়া, মহব্বতের প্রকাশনীর কিছু কাজও আমি করে দিই।

আমি থতমত খেয়ে গেলাম। মহব্বতের প্রকাশনীর কাজ নিতাই করে দেয়!
– নিতাই, তুই কি আমাদের বন্ধু মহব্বতের প্রকাশনীর কাজ করিস?

নিতাই কিছু বুঝে উঠতে পারে না। আমিও আর কথা বাড়াতে চাইলাম না। মহব্বত ওর সম্পর্কে কী বলতো তাও আর ওকে জানালাম না। এতদিন পর তার তো কোন প্রয়োজন নেই।

ওর ভীষণ কাটতি হওয়া ঐ বইটি সম্পর্কে কৌতুহল হল। বইটি চাইলাম।
দেশের খ্যাতনামা একটি প্রকাশনী থেকে বইটি বের হয়েছে।

– নিতাই, তুই হঠাৎ এই বইটি লিখলি যে? বিশ্বাস থেকেই লিখেছিস, নাকি অন্য কোনো কারণে?
– আমি বিশ্বাস থেকেই লিখেছিলাম, তবে মানুষকে যা বোঝাতে চেয়েছিলাম, তা বোঝেনি; মানুষ যা বুঝতে চেয়েছে, তাই বুঝেছে।

– তুই কি তোর বিশ্বাসে এখনো অটল আছিস?
– আছি। দ্যাখ, ঈশ্বর নিয়ে কোনোদিন আমার কোনো মাথাব্যথা নেই, আমি শুধু বলতে চেয়েছি, ধর্মগুলো কিছু মানুষকে ঠকাচ্ছে, কিছু মানুষ স্বেচ্ছায় ঠকছে। বাংলাদেশের কথাই ধর না, ষোলো সতেরো কোটি মানুষ, কীভাবে চলছে আসলে?

আড়ম্বরের তো অভাব নেই, আছে? কোথা থেকে আসছে এত আড়ম্বর? অনেক মানুষ নিশ্চয়ই ঠকছে বলে কিছু মানুষ এরকম আড়ম্বর করতে পারছে।

কিন্তু এ নিয়ে বঞ্চিত-পীড়িতদেরও তেমন কোনো মাথা ব্যথা নেই, কারণ, তারা পরকালে পুশিয়ে নিতে চায়। এজন্য তারা বিক্ষুব্ধ নয়। বেঁচে থাকার মত কিছু খাবার, মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই, এবং নিয়মমাফিক নামায পড়তে পারলে বেশিরভাগ বাঙ্গালী মুসলামান খুশি। শুনেছি আরবের মুসলমানদের প্যাটার্ন এমন নয়।

এত অল্পতে মানুষ তুষ্ট থাকার কথা নয়, এত বঞ্চনা স্বাভাবিকভাবে সহ্য করার কথা নয়। এদের (অন্ধভাবে ধর্ম বিশ্বাসী দরিদ্র মুসলমান) ত্যাগের মহিমার উপর (পরিশ্রম) দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান বাংলাদেশ। ওদের পূর্বপুরুষও সারাজীবন কষ্ট করে গেছে বর্ণপ্রথায় পিষ্ঠ হয়ে।

সমস্যা হচ্ছে, কেউ যখন সচেতনভাবে-আদর্শিকভাবে ত্যাগ করে সেটি বৃহত্তর স্বার্থে কাজে লাগে, সে ত্যাগ কল্যাণকামী হয়, কিন্তু অনেক মানুষ যখন শুধুমাত্র ধর্মবিশ্বাসে না বুঝে বঞ্চিত হয়, তখন সে সুযোগ নেয় কতিপয় শয়তান মানুষ, যারা ধিরে ধিরে আগ্রাসী হয়ে ওঠে, হননকারী হয়ে ওঠে, ধর্ম সেখানে শুধু ব্যবহৃতই হয়।

এই বিষয়গুলোই আমি বইতে তুলে ধরেছি। বইটাতে কিছু কেস স্টাডি আছে, আমার নিজের কথা তেমন কিছু নেই। আমি শুধু বর্ণনা করেছি।

– বইটার নামটা কি ঠিক আছে?
– নামটা নিয়ে আমারও একটু আপত্তি আছে। আসলে নামটা প্রকাশক দিয়েছেন বাণিজ্যিক প্রয়োজনে। আমিও একই প্রয়োজনে মেনে নিয়েছি।

মূলত এ বইটির ব্যবসায়ীক সাফল্য দেখে মহব্বত আমার সাথে যোগাযোগ করে। ওর কিছু কাজ করার অনুরোধ করে। আমার একটি বই প্রকাশ করার কথা বলে।
এমনিতে মহব্বত সম্পর্কে লেখকদের মধ্যে ভাল কথা শোনা যায় না, কিন্তু আমার সাথে তো ও খুব ভাল ব্যবহার করছে, ভালই টাকা পয়শা দেয়।

মেজবাহ আর কথা বাড়ায় না। মনে মনে বলে, “দুনিয়াটা আজব, আজব দুনিয়া।”