Headlines

অধমের তীর্থ দর্শন // মতিন বাঙালি

মতিন মোহাম্মদ

লুৎফর সৌখিন পর্যটক। শখ তার ঘুরে বেড়ানো। বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখতে তার ভীষণ ভালো লাগে। বিশেষ করে সে স্থানে যদি অনেক প্রাচীন গাছ থাকে তো কথাই নেই। আর যদি সেটা হয় কোনো পুরণো বিল্ডিং, তাহলে সে নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে সেখানেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারবে। দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করবার জন্যে সে তার বাবাকে ধরে একখানা পাসপোর্ট করিয়ে নিয়েছিল বটে, তবে বেশি দূর যেতে পারেনি। দুবার ভারত ভ্রমণের পরই পকেটে টান পড়েছে। ফলে আর বেশি এগুবার চেষ্টাও আর করা হয়নি। ইতিমধ্যে পাসপোর্ট এর মেয়াদ শেষ হবার পথে।
বিদেশ না হয় নাই-বা হলো যাওয়া, দেশে তো ঘুরে বেড়াবার মতো জায়গার অভাব নেই। ইচ্ছে হলেই যে দিকে ইচ্ছে সেদিকে ঘুরতে যাওয়া যায়।
আমরা এক সাথে প্রতি শুক্কুরবার ঘুরে বেড়াই।
উনিশে জৈষ্ঠ্য সাধক লোকনাথ ব্রক্ষ্মচারীর তিরোধান দিবস। দিনটি শুক্কুরবার। ছুটির দিন। ঠিক হলো, ঘুরে আসা যাক। যেমন কথা, তেমনি কাজ। বিষ্যুদবার রাতে ভিক্ষেয় বের হলাম। উদ্দেশ্য হলো, যা পাব, সেটা দিয়ে রাহাখরচ চলে যাবে। সারা সপ্তাহ কাজ করবার পর এই দিনটিতে আমার রিজিকদাতাদের কাছে যাই বিলের জন্যে। আমি যখন আমার রিজিকদাতাদের কাছে অর্থাৎ প্রকাশকদের কাছে যাই, সে সময় ভিখিরিরাও যায় ভিক্ষের জন্যে। বিষ্যুদবার ভিখিরিরা ভিক্ষে পেলেও, আমার রিজিকদাতা প্রকাশক মহোদয়ের কাছ থেকে প্রতি সপ্তাহে আমার ভিক্ষে পাওয়ার গ্যারান্টি থাকে না বললেই চলে।
অতি কষ্টে ৪০০/ টাকা ভিক্ষে যোগার হয়। ফোনে লুৎফরের সঙ্গে সময় ঠিক হয়, আগামীকাল ঠিক সকাল এগারোটার সময় যাত্রা করা হবে। নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলার বারদি গ্রাম।
আমার অতীত অভিজ্ঞতা থেকে ধরে নিলুম যে, লুৎফরের এগারোটা অর্থ অন্তত পক্ষে বারোটা না হয়ে যায় না। দুপুর একটা বা দুটোও হতে পারে। সময়মতো কাজ করা নিয়ে তার সঙ্গে আমার একদমই বনে না। সে যদি বলে ‘এই এক্ষুণি আসছি’, তাহলে আমাকে ধরে নিতে নিতে হবে যে, তার অন্ততপক্ষে এক বা দুই ঘণ্টা দেরি হবেই। হয়ত এমনও হতে পারে, সে পাঁচ ঘণ্টা পরে এসে বলবে, ‘আহা! একদম ভুলে গেছি’।
আর যদি সে বলে, ‘একটু দেরি হবে’, তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে, তার আসতে অন্ততপক্ষে সাত দিন লাগবে। অবশ্য এখন একটুখানি পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয়।
আমি বার বার খোটা দিয়ে দিয়ে তাকে কিছুটা সংশোধন করিয়ে নিয়েছি। হয়ত বিকেল পাঁচটায় আমি আছি ক্যাফে কর্নার-এ। সে ডালপট্টি থেকে রওনা করেছে। ফোন দিয়ে বলল, ‘এই আসছি। ’
লুৎফর এই এলো বলে। আমি অপেক্ষায় রইলাম। বিশ মিনিট পর রিং দিলাম, ‘লুৎফর, তুমি কোথায়?’
‘এই এক্ষুণি আসছি’
পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, বিশ মিনিট, আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা। লুৎফরের দেখা নেই। আবার রিং দিলাম।
‘এই একটু পর আসছি।’
‘তুমি আসতে না পারলে, সে কথাটা জানাবে তো।’
‘পাঁচ মিনিট,’ স্পষ্ট জবাব তার।
রাত দশটা অবধি অপেক্ষা করেও তাকে না পেয়ে ফিরে গেলাম আমি।
পর দিন সে এসে বলল, ‘আহা! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। ’
এই হচ্ছে আমাদের লুৎফর।
শুক্কুরবার সকাল এগারোটার সময় আমি প্রস্তুত হয়ে আছি। রিং বেজে উঠলো।
মনে মনে ভাবলাম, লুৎফরের ফোন হবে।
হ্যাঁ, লুৎফর ছাড়া আর কে?
‘আধা ঘণ্টা লেইট হবে’
‘ঠিক আছে,’ বললাম আমি। মনে মনে না-খোশ হলেও মুখে সেটা প্রকাশ করলাম না।
‘কোথায় দেখা হবে?’
‘বাহাদুর শাহ পার্ক এর পূব গেইটে।’
‘আচ্ছা,’ বলে কেটে দিলাম ফোনের লাইন।
সকাল সাড়ে এগারোটার সময় যখন রাস্তায় নামলাম, তখন মাথার ওপর সূর্য যেন আগুন ঢেলে দিচ্ছে। আমার মাথা ফুটবল খেলবার স্টেডিয়াম বলে কথা। দু মিনিট সময়ের মধ্যেই মাথা গরম হয়ে উঠল। গরম মাথা আর ঘামে ভিজতে থাকা শরীর নিয়ে হাজির হলুম বাহাদুর শাহ পার্ক এর পূব দিকের গেইটে।
না, লুৎফর নেই সেখানে। চারদিকে তাকালাম। কোথাও লুৎফরের টিকির দেখাটি মিলল না। ফিরে যাওয়ার জন্যে আবার পথে নামলাম। ফিরে যেতে হবে।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠল।
‘হ্যালো, কোথায় তুমি, লুৎফর?’
‘এই তো আমি। একটু ডান দিকে তাকান। কবি নজরুল কলেজের উল্টো দিকে। হা- হা- হা’
সে হাসে। কারণ আমি তাকে দেখতে পেরেছি। সে আনারসের দোকানীর কাছ থেকে আনারস কিনে খাচ্ছে।
‘শসা খান।’ উদাত্ত আহ্বান লুৎফরের কণ্ঠে।
বাসে করে এলাম গুলিস্তান। বারদি’র বাসে উঠতে হবে। বাসের হেলপার ভাড়া হাঁকলেন, এক শ টাকা।
ভাড়া কতো সেটা আমার জানা নেই। তবে এ কথা ঠিক যে, ভাড়াটা তারা বরাবরই বেশি চায়।
ভাড়া এত বেশি কেন?
ধরা পড়ে গেল বাসের হেলপার।
‘এমনিতেই ভাড়া ষাট টাকা। আজ, কাল ও পরশু এই তিন দিন এক শ টাকা,’ বিড়িতে টান দিতে দিতে বলল হেলপার। তার মুখ থেকে বিড়ির ধোঁয়া এসে ভরে দিয়ে গেলো আমাদের মুখ।
প্রকাশ্য স্থানে ধূমপান করাটা অপরাধ, এ রকম একটা আইন আছে এ দেশে। ওরা এ সবের ধার ধারে না। ওদেরই বা কী দোষ? পুলিসের লোক ইউনিফরম পড়া অবস্থায় ধূমপান করছে। স্কুল কলেজের ছেলেরা ইউনিফরম পরা অবস্থায় বই রাখবার ব্যাগ থেকে সিগারেট বের করে তাতে আগুন দিচ্ছে। ডাক্তার তার চেম্বারে বসেই ধূমপান করছেন, যদিও তিনি রোগির জন্যে যে ব্যবস্থাপত্রখানা সই করে দিলেন তাতে লেখা আছে ‘ধূমপান মৃত্যু ডেকে আনে’। স্কুল কলেজের শিক্ষকরাও নিজ নিজ অফিসে বসেই ধুমপান করছেন। রাজনীতিবিদরা ধূমপান করতে করতে ধূমপানবিরোধী শোভাযাত্রায় অংশ নিচ্ছেন।
হেলপারের বিড়ির ধোঁয়া হাত দিয়ে মুখের ওপর থেকে সরিয়ে বাসে উঠে বসলাম।
ফ্লাইওভার পার হয়ে হালকা জ্যাম। আর চিটাগাঁং রোড পার হয়ে ভারি জ্যামে আটকা পড়ে গেলাম আমরা। তবু আনন্দ আমাদের মনে এই জন্যে যে, বারদি যাচ্ছি, নতুন জায়গায় বেড়াতে যাচ্ছি।
নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর অবশেষে মিলল বারদি বাজার। মোড় ঘুরলেই মন্দির। অনেকেই নেমে গেল এখানেই। আমিও নামতে চাইলাম। কারণ আমার বড্ড খিদে পেয়েছে ততক্ষণে। আমি বারদি বাজারে হোটেল দেখিয়ে দিয়ে লুৎফরকে বললাম, ‘এখানে খেয়ে নিই।’
লুৎফর আমাকে নামতে দিল না। সে বলল, ‘মেলায় খাওয়া যাবে।’
আমার কথা টিকল না। কারণ আমি এখানে প্রথম এসেছি। লুৎফর এখানে অনেকবার এসেছে। ফলে আমি তার কথা মেনে নিলাম।
মেলায় অনেক কিছু থাকলেও আমার দৃষ্টি কেবল খাবারের দোকানের দিকে। আর খাবারের দোকানঅলারা কীভাবে যেন বুঝে গেছেন আমার অবস্থার কথা। ওরা বার বার ডাক দিচ্ছিলেন।
একটি দোকানে এসে দাঁড়ালাম। লুচি আর তার সঙ্গে সব্জির আয়োজন দেখে আমার আর তর সইছিল না। সেখানে মিষ্টি আর দইও ছিল। আমি খেতে বসতে যাব। বাধ সাধল সেই লুৎফর।
‘সামনে ভালো হোটেল আছে। চলেন, ওখানে খাব।’
হাত দিয়ে পেট চেপে ধরে গেলাম লুৎফরের পিছু পিছু।
‘হোটেলের নাম কী?’
‘পূর্ণিমা হোটেল,’ পান চিবোতে চিবোতে বললেন হোটেলের পরিচারিকা। সবাই দিদি বলে সম্বোধন করছেন তাকে। বয়সটা বাইশ হবে। গায়ের রং কালো বললে চলে, মান সম্মান বাঁচিয়ে বলতে গেলে কালো খয়েরি বলতে হয় আর কী? ভাতের পাতে যাতে চুল না পড়ে, সেজন্যে তার খাটো চুল খোঁপা করে বাঁধা। তবে চুল তো দূরের কথা, ঘরের ঝুলও যে সকলের পাতে পড়বে, সেটা সেখানকার পরিবেশ দেখে অনুমান না করে উপায় নেই। কথা বলবার সময় শ্রীমতির মুখ থেকে একটু আধটু পানের রসের আস্বাদন পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকখানি রয়েছে।
‘পূর্ণিমা হোটেল? নায়িকা পূর্ণিমার নামে না কি?’ প্লেটের পানি ফেলতে ফেলতে বললাম কথাগুলো। খিদের জ্বালায় আমি এতটাই অস্থির ছিলুম যে, পূর্ণিমার পরিবারের সবাইকে যে আমি অনেক ছোটবেলা থেকেই চিনি এবং জানি -এ কথাটা বলে বাহবা নেওয়ার লোভটা সামলিয়ে নিলুম।
শ্রীমতি আমাদের জন্যে খাবার দিলেন। ভাতের সঙ্গে করলা ভাজি, বেগুন ভাজি আর একটা সব্জি।
‘কী দেব? মাছ না মাংস?’
আমার সময় নেই। বললাম, ‘যা ভালো হয়, তাই দিন।’
রুই মাছের সবার শেষের পিচখানা আমাকে দেওয়া হলো। লুৎফর মাছ বা মাংস কিছুই নিল না।
একদম বিস্বাদ আর পচা গন্ধ মাছের। নাক বন্ধ করেও খাওয়া গেলো না।
এবার বিল দেওয়ার পালা। অসম্ভব রকমের উচ্চ মূল্যের খাবারের বিল পরিশোধ করবার পর আমার কাছে রইল মাত্র তিরিশ টাকা। আর তখন লুৎফরের কাছে ছিল তখন পঁচিশ টাকা। হোটেলঅলার গলাকাটা দাম পরিশোধ করবার কারণে আমরা সর্বস্বান্ত হলাম। আমাদের দুজনের পকেটস্থ সম্পদ একত্র করলেও বাড়ি ফিরবার জন্যে একজনের ভাড়াও হয় না।
কীসের মেলা দেখা! কীসের তীর্থ দর্শন!
চোখে পড়ল লোকনাথ বাবার সেই অমোঘ বানী ‘রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে যেখানেই বিপদে পড়িবে, আমাকে স্মরণ করিও। আমি তোমাকে উদ্ধার করিব। আমি মনে মনে কয়েকবার বাবাকে ডাকলাম বটে, কিন্তু তিনি আমাদের উদ্ধার করতে এলেন না।
প্রথমে ফোন দেওয়া হলো রনোকে বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠাবার জন্যে। সে সাফ জানিয়ে দিল, তার কাছে টাকা নেই।
এরপর রিং দেওয়া হলো হাবিবের ফোনে। সে তখন ঘুমোচ্ছিল। বলল যে, সে টাকা পাঠাবে। তবে একটু দেরি হবে।
বাঁচা গেল।
তীর্থ দর্শনে এসে সবাই ঈশ্বরকে খোঁজে। আর আমরা বিকাশের দোকান খুঁজতে বের হলাম। পাওয়া গেল, তবে তাদের পার্সোনাল নম্বর নেই, এজেন্ট নম্বর। কিন্তু হাবিব টাকা দিতে পারবে কেবল পার্সোনাল নম্বরে।
লুৎফর পরামর্শ দিল, ‘টাকাটা আমরা বাসে উঠে বাসের হেলপার বা ড্রাইভারের নাম্বারে বিকাশ করতে বলি,’ শিশুর মতো কথাগুলো বলল লুৎফর।
আমি বললাম, ‘এমনটাও তো হতে পারে যে, হাবিবকে ঐ সময় ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না, বা বাসঅলারা ফোনে টাকা নিতে চাচ্ছে না, বা নেটওয়ার্ক নেই বা আমাদের মোবাইলের চার্জ নেই বলে বন্ধ হয়ে গেলো সকল যোগাযোগ।’
তখন লুৎফর বুঝল। সিদ্ধান্ত হলো, টাকাটা আগে হাতে পাওয়া হোক।
আবার খোঁজ করতে বের হলাম। অবশেষে পাওয়া গেল।
‘এক শ টাকায় দশ টাকা দিতে হবে,’ সুযোগ বুঝে মুখ কালো করে বললেন বিকাশঅলা মোটা লোকটা।
এবার মেলা দেখা আর তীর্থ দর্শন। বেশিক্ষণ থাকা হলো না। কবিগান, মারফতি, মুর্শিদি গান শুনে সময় কাটানোর মতো উপায় নেই। সূর্য ঢলে পড়েছে। ফিরতে হবে।
পরামর্শ করা হলো, যে রাস্তায় আসা হয়েছে, সে রাস্তায় না গিয়ে আমরা অন্য কোনো রাস্তা ধরে ফিরব। যেমন কথা, তেমন কাজ। উত্তর দিক দিয়ে আমরা ঢুকেছিলাম। এবার দক্ষিণ দিক দিয়ে বের হবো।
বাসে প্রচ- ভিড়। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, হেঁটে কিছু দূর যাওয়া যাক।
হাঁটা শুরু হলো। বারদি থেকে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে নাগপাড়া থেকে সেনপাড়া পর্যন্ত পাকা রাস্তা। রাস্তার দুধারের অপরূপ দৃশ্য মন ভরিয়ে দিল আনন্দে। আমরা মূহুর্তেই ভুলে গেলাম সব কষ্ট। এই রাস্তায় তেমন ভিড় থাকে না। কিন্তু আজ মেলার কারণে রাস্তায় ভিড় দেখা যাচ্ছে।
পথের পশ্চিম দিকে এক বিশাল সাইনবোর্ড। বারদি স্কুল ও কলেজ।
লুৎফর বলল, ‘‘আমি এই কলেজে চাকরি করেছি কিছুদিন।’’
‘‘ও, তাই তুমি এখানকার সব কিছু চেন। তা, কতদিন ছিলে এখানে?’’
‘‘বেশি দিন না। অল্প কয়েক দিন মাত্র।’’ লুৎফরের কণ্ঠে ফুটে ওঠে রাজ্যের বিরক্তি আর ঘৃণা। আমি এর কারণটা বুঝলাম না। অবশ্য জিজ্ঞেসও করলাম না। সেই আবার নিজের থেকে বলতে থাকে।
“এখানকার লোকগুলো ভালো নয়। স্থানীয় একটা লোকের কারণে আমি থাকতে থাকতে পারিনি। আসলে তার একটা লোককে আমার জায়গায় চাকরিটা দিতে হবে। এ জন্যে লোকটা আমার পিছনে লেগেছিল।”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। এই এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করবার অভিজ্ঞতা আমারও আছে। ভিন্ন দুটো উপজেলা রূপগঞ্জে ও বন্দরে চাকরি করেছি আমি। আমিও বেশি দিন চাকরি করিনি। আসলে বলতে গেলে কী, বেশি দিন চাকরি করতে পারিনি। এখানকার স্কুল-কলেজগুলোতে অধিকাংশশিক্ষকই বাইরের থেকে আসা। কারণ স্থানীয় লোকজন বেশি লেখাপড়াও করেন না। আর তাদের বেশি লেখাপড়া করবার দরকারও হয় না। অষ্টম শ্রেণি পাসের সার্টিফিকেট যোগার করে তারা কল কারখানায় চাকরি নিয়ে নেয়। এই এলাকাগুলোতে অনেক কল কারখানা রয়েছে। আবার যারা বেশি লেখাপড়া করে, তারা এই এলাকায় থাকে না। অন্যত্র গিয়ে পড়ালেখা করে। দু একজন শিক্ষিত লোক, যারা এই এলাকাতে থাকে, তারা স্কুলের কেরানি হয়ে নিজেকে শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মনে করে। এই এলাকাগুলোতে শিক্ষকদের মর্যাদা দেওয়া হয় না। এমপি তো দূরের কথা, ইউএনও অফিসের পিয়নও যখন তখন হেড মাস্টারের কান ধরে ওঠ-বস করান।
সে জন্যে দেখা যায়, এখানে লেখাপড়ার গুরুত্ব কম। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি।
প্রায় দু কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করবার পর মাথায় চাপল আর এক খেয়াল।
‘মেটো রাস্তা ধরে মদনপুর পর্যন্ত হেঁটে গেলে কেমন হয়?’ আমি প্রস্তাব দিলাম লুৎফরকে।
লুৎফর রাজি হয়ে গেল। আমরা এবার দক্ষিণ দিকে না গিয়ে একটা মেটো রাস্তা ধরে পশ্চিম দিকে যেতে থাকলাম। লোকজন আমাদের পাগলামি দেখে অবাক হয়েই জানতে চাচ্ছিলেন যে, আমরা কোথায় যাব। আমরা খুব খুশি হয়েই তাদের জবাব দিচ্ছিলাম আর এগিয়ে যাচ্ছিলাম।
গ্রামের নাম ফুলদি। রাস্তার উত্তর দিকে উঁচু উঁচু গাছপালার ভেতর সারি সারি বাড়িঘর। বাড়িঘর দেখে সবাইকে অবস্থাপন্ন বলেই মনে হয়। রাস্তায় পাশে কেউ গরু ছাগলের জন্যে ঘাস কাটছে, আবার কেউ বিকেলের বাতাস গায়ে লাগাচ্ছে। কোনো যানবাহন রাস্তাটিতে আমাদের চোখে পড়েনি। কেবল পায়ে হাঁটা মানুষের দল। কেউ মেলায় যাচ্ছে, আবার কেউ মেলা থেকে ফিরছে। দু এক জনের সঙ্গে আমাদের আলাপও হলো। রাস্তাটা ঘাসে ঢাকা। নরম ঘাস। তবে রাস্তার দুধারে কোনো গাছগাছালি নেই।
কাঁচা রাস্তা ছেড়ে এবার আমরা উঠলাম পাকা রাস্তায়। ইতিমধ্যে লুৎফর অনেকটাই পেছনে পড়ে গেছে। সে বরাবরই আমার সঙ্গে হাঁটায় পেরে ওঠে না। লুৎফরকে দূরে দেখে থামলাম আমি। লুৎফর এগিয়ে আসছে। স্যান্ডেল ইতিমধ্যে তার হাতে উঠে এসেছে। জামার বোতাম খুলে দিয়েছে সে। মাঝে মাঝে দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলছে, ‘আহ! কী বাতাস!’
বারদি ইউনিয়ন পরিষদের এলাকা ছেড়ে এখন আমরা চলে এসেছি সানমানদি ইউনিয়ন পরিষদের এলাকায়।
‘মদনপুর কত দূর এখান থেকে?’ লুৎফর যাকে পায়, তাকে এই প্রশ্ন করে।
‘চার-পাঁচ কিলো হবে আর কী।’
অবশ্য দুঘণ্টা আগেও লোকজন বলেছিলো চার-পাঁচ কিলো হবে। তাহলে কি আমাদের পথ এগুচ্ছে না? নাকি লোকজনের এক কিলোমিটার দূরত্ব সম্পর্কে ধারণাই নেই।
‘জলদি করো, লুৎফর,’ অনেক পিছিয়ে থাকা উদোম গায়ের লুৎফরকে বললাম আমি।
‘বেবি বা অটোরিক্সা নিয়ে যাওয়া যায় না?’ ক্লান্ত শ্রান্ত লুৎফরের প্রস্তাবটা আমি না শুনবার ভান করে এমন করে চুপ মেরে রইলাম, যেনো, সে কিছুই বলেনি।
‘এই যে, খালি অটোরিক্সা, মদনপুর কত নিবেন?’
‘না, লুৎফর। হেঁটেই যাব। তুমি তো পর্যটক। ইবনে বতুতার উত্তরসুরী। ইবনে বতুতা কি হেঁটে মাইলের পর মাইল পথ অতিক্রম করেননি?’ বললাম আমি।
অগত্যা আবার হাঁটা। আমি রাস্তার পাশে যেখানেই বাজার দেখেছি, সেখানেই দাঁড়িয়েছি পিছিয়ে থাকা লুৎফরকে আমার সঙ্গে নেওয়ার জন্যে। আমরা কয়েক স্থানে পানি আর চা পানও করেছি।
লুৎফরের শরীর আর চলে না। সে একটা ছোট বাজারের কাছে এসে বলল, ‘‘আর সম্ভব নয়।’’
‘‘কী সম্ভব নয়?’’ বললাম আমি।
‘‘আমি আর হাঁটতে পারব না,’’ একটা অটোরিক্সার কাছে গিয়ে সে আত্মসমর্পণ করল।
আমরা অটোরিক্সাতে করে চলে আসি কেওডালাতে। সেখান থেকে বাসে করে আবার নিজনিজ গন্তব্যে। পথে সে নেমে পড়ল, কারণ তার বাসা সেখান থেকে একেবারে কাছেই।