“হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে” // দিব্যেন্দু দ্বীপ

শশ্মানের ঠিক কাছে আসতেই অবসেশনে আক্রান্ত হলাম, শশ্মানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ, প্রার্থণা নয়, কিচ্ছু নয়, শুধু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে আসলাম। কিছুদূরে এসে আবার ফিরে গেলাম ঐ জায়গাটিতে, এভাবে তিনবার ফিরে গিয়েছিলাম।


আগে যখন নাইট কোচে বাড়ি যেতাম, বাধাল বাজারে নামিয়ে দিত ভোর ৩টা বা ৪টায়। ওখান থেকে বাড়ি আরো ৩ কিলোমিটার দূরে।

গ্রামের রাস্তা, একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দশ বারো কেজি ওজনের একটা ব্যাগ তো সাথে থাকতই, ফলে খুব জোরে হেঁটে যাওয়াও সম্ভব নয়।

হাঁটা শুরু করতাম। এমন অন্ধকার যে পাঁচ হাত দূরে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলেও দেখা যাবে না। কলাগাছের শুকনো পাতা দেখে মনে হয় কবর হতে কঙ্কাল উঠে এসে ঝুলে রয়েছে।

খুব দূরে কোনো বাড়িতে আলো জ্বলতে দেখে মনে হত ধীরে ধীরে আলোটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। হু…ম হু…ম আওয়াজ হত চারপাশে, এর মধ্যে সামনে থেকে কোনো কুকুর বা শেয়াল দৌঁড় দিলে তো আর কথাই নেই! হৃদয় তখনই স্পন্দন থামিয়ে দেওয়ার কথা।

ছোটবেলার শিক্ষা ছিল, এরকম পরিস্থিতিতে “হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ” করতে থাকলে ভূত পেতনি ধারে ঘেষবে না। কিন্তু কোনোদিন আমি “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ” করে ভূত তাড়াইনি, যদিও ততদিন পর্যন্ত বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে আমার কোনো ভাবনা নেই।

কিন্তু কোনোভাবেই আমি কনভিন্সড্ ছিলাম না, “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ” বললে ভূত কাছে আসবে না। আমি মূলত পথ চলতাম গল্পে গল্পে, কল্পনার ফানুস উড়িয়ে, হঠাৎ মনে পড়ত, আরে আমি তো এখন ভয়াবহ অন্ধকারে পথ চলছি।

তখন যুক্তিগুলো আওড়াতাম, ভূত বলে কিছু নেই, দেখি না দাঁড়িয়ে আসলে আলোটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে কিনা, মন্ত্রমুগ্ধের মত গ্রামের শুনশান মাঠের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে দূরের অলো দেখতাম, দেখতাম আলোটা একটুও এগিয়ে আসছে না, হয়ত জ্বলছে কোনো মুমূর্ষু রোগীর পাশে।

আমি বরং তখন পরিবারটার কথা ভাবতাম, ভাবতাম, ঠিক কী কারণে এত রাতে অালো জ্বলছে একটা পর্ণো কুটিরে।

একদিন রাস্তার পাশে কেটে রাখা একটি গাছে হোঁচট খেয়ে ছিটকে পড়লাম। ব্যথা সয়ে উঠে এসে আবার ঐ গাছের পরেই বসলাম। খানিক জিরিয়ে আবার হাঁটতে থাকলাম।

দেখি পা ব্যথা ব্যথা করে, হাত দিয়ে অনুভব করলাম বুড়ো আঙ্গুল থেকে রক্ত পড়ছে। ব্যাগ থেকে গামছার কোণা ছিড়ে উল্টানো নখ বেঁধে দিয়ে আবার হাঁটতে থাকলাম।

মাঝে মাঝে মৃতদের কথা মনে পড়ত। আমার দাদুর মা ছিলেন, যাকে আমরা বুড়ো মা বলতাম, বাবার কথা মনে পড়ত, তখন দাদু বেঁচে ছিলেন, বড় মামা বেঁচে ছিলেন, এখন ওভাবে গেলে হয়ত মৃতদের তালিকাটা লম্বা হবে।

কিন্তু কোনোভাবেই তাদের কথা মনে করে ভয় পেতে আমি রাজি ছিলাম না। শুধু যুক্তিবোধই আমাকে তখন ভয় পাওয়া থেকে বিরত রাখত। কিন্তু আমি বুড়ো মাকে দেখতে পেতাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভীষণ নীরবতায় আবছায়া স্মৃতি ভর করত বলে বাবাকে দেখতে পেতাম- লুঙ্গি পরে, সুঠাম দেহের, সুদর্শন, বহুভাবে বঞ্চিত এবং বিবিধভাবে বিত্রস্থ একজন মানুষ আমার দিকে এগিয়ে আসছে।

খুব কাছে চলে আসলে চোখ বুঝে ফেলতাম, চোখ খুলে দেখতাম, “আর নেই”।

বেশ আগের কথা, সম্ভবত ২০০৩ সালে। বাবার শশ্মানটা আমাদের বাড়ির পিছনে (কোয়ার্টার কিলোমিটার দূরে) একটা খালের পাড়ে। ওদিকে একটু দূরে, কিছুটা দুর্গমে “ডরের বাড়ি” নামে গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন কয়েকটা বাড়ি আছে।

কী কারণে জানো রাত বারোটার দিকে ঐ ডরের বাড়ি থেকে বাবার শশ্মানের পাশ দিয়ে আসছিলাম। শশ্মান বলতে খাল পাড়ে উন্মুক্ত একটা জায়গা।

শশ্মানের ঠিক কাছে আসতেই অবসেশনে আক্রান্ত হলাম, শশ্মানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ, প্রার্থনা নয়, কিচ্ছু নয়, শুধু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে আসলাম। কিছুদূরে এসে আবার ফিরে গেলাম ঐ জায়গাটিতে, এভাবে তিনবার ফিরে গিয়েছিলাম।