রোজার মাসে তো বটেই অন্যান্য সময়েও বাঙালির রসনা বিলাসের অন্যতম একটি খাবার হয়ে উঠেছে হালিম। তাই বলে হালিম মাত্রেই সুস্বাদু এমন ধারণা কিন্তু ভুল। সব উপকরণ দিলেই বা মাংস এবং মশলা বেশি দিলেই হালিম সুস্বাদু হয়ে যায় না।
হালিম তৈরিতে হাতযশ যেমন লাগে, পাশাপাশি প্রয়োজন পড়ে উপকরণগুলো সঠিক সময়ে সঠিক উপায়ে মিশ্রিত করা। জ্বালের তারতম্যও একটি বড় বিষয়। অনেকের গোপন রেসিপি থাকে। খুলনার আপ্যায়ন হোটেল দীর্ঘদিন যাবত সুনামের সাথে অন্যান্য খাবারের সাথে হালিম বিক্রি করে থাকে। আপ্যায়ন হোটেলের হালিম এতটাই সুস্বাদু হয়— দূরদূরান্ত থেকে কেউ আসলে আপ্যায়ন হোটেলের হালিম ছেঁকে দেখে।
বিশেষ করে রোজার মাসে আশেপাশের জেলা থেকেও আপ্যায়নের হালিমের অর্ডার হয়। এ বিষয়ে হোটেলটির স্বত্বাধিকারী বিষ্ণু পদ দাশ বলেন, ১৯৮৪ সালে হোটেলটির প্রতিষ্ঠাতা স্বপন কুমার দাশ বিশেষ ধরনের হালিমের এ রেসিপিটি নিয়ে আসেন সুদূর দিল্লি থেকে শিখে আসেন। বর্তমানে তারই শিষ্য মোহাম্মদ জলিল স্বাদের সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন। বাজারের সেরা মশলা, চুইঝাল, ডাল-চাল এবং পিওর খাসির মাংসের সাথে গোপন রেসিপি সহযোগে বিশেষ এই হালিম তৈরী হয়। যেহেতু নিজের ঘরে হোটেল পরিচালনা করি, ফলে আমরা কম লাভে ভালো খাবার সরবরাহ করতে পারি। চলতি মাস থেকে আমরা হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা রেখেছি। ডেলিভারে পেতেঃ ০১৭৫৪ ৮০২ ৭৭০।

ভোক্তা হিসেবে খেতে খেতে সাঈদুল ইসলাম বললেন, আমি ১২০ টাকার হালিম খেতে ৬০ টাকা রিক্সা ভাড়া দিয়ে আসি। এমনি এমনি কি আসি?
এবারও আপ্যায়ন হোটেল গত বছরের মতো একই মূল্যে হালিম বিক্রি করছে। এখন আছে ২৫০ গ্রাম (৯৫ টাকা), ১/২ কেজি (১৯০ টাকা), ৭৫০ গ্রাম (২৯০ টাকা) এবং ১ কেজির প্যাকেজ (৩৮০ টাকা)। চাহিদাসাপেক্ষে ২ কেজির প্যাকেজও সরবরাহ করা হয়। বাসায় পৌঁছে দিতে হলে রিক্সা ভাড়া দিতে হবে।
আপ্যায়ন হোটেলের হালিম যে কারণে সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর
অন্যান্য হালিমের সাথে আপ্যায়ন হোটেলের হালিমের প্রধান পার্থক্য হচ্ছে— আপ্যায়নের হালিমে তেল ভাসে না, মশলা এবং তেলের উৎকট গন্ধ আসে না। উচ্চমানের খাসির মাংস ব্যবহার করা হয়। মুগ ডাল, মাসকলাই ডাল এবং আতপ চালের এমন একটি অনুপাতে রান্না করা হয়, ফলে আপ্যায়নের হালিমে উচ্চমানের স্বাদ এবং পুষ্টিগুণ বজায় থাকে। মানসম্মত তেল ব্যবহার করা হয় পরিমাণমতো। পাশাপাশি রয়েছে অভিজ্ঞ বাবুর্চির হাতযশ।
হালিমের পুষ্টিগুণ
রমজানে সারাদিন রোজা রাখার পর শরীর দ্রুত শক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য পুষ্টিকর খাবার চায়। আবার হঠাৎ করে শক্ত খাবার খাওয়াটাও ঠিক নয়। হালিম এমন একটি খাবার যা বহু বছর ধরে ইফতারের সময় জনপ্রিয়। হালিমে সব ধরনের পুষ্টি উপাদান থাকলেও তরল হওয়ায় শরীর তা সহজে গ্রহণ করতে পারে। ইফতারে হালিম খেতে পছন্দ করেন অনেকেই। শুধু স্বাদ নয়, পুষ্টিগুণে হালিম অসাধারণ যদি সকল উপাদান, রান্না এবং সংরক্ষণ পদ্ধতি স্বাস্থ্যসম্মত হয়। ফলোআপ নিউজ-এর খাদ্য এবং পুষ্টিবিষয়ক সম্পাদক বর্ণনা করছেন হালিমের পুষ্টিগুণ।
হালিমে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন ও খনিজ উপাদান থাকে, যা শরীরের জন্য উপকারী।
হালিমে মাংস থাকে। যেহেতু হালিমে পরিমিত পরিমাণ মাংস খাওয়া হয়, ফলে মাংসের পুষ্টিউপাদান পাওয়া গেলেও ক্ষতির দিকটা বর্জন করা যায়।
১. মাংস
প্রোটিনের অন্যতম উৎস যা পেশি গঠনে সাহায্য করে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। আয়রন সরবরাহ করে, যা রক্তস্বল্পতা রোধে সহায়ক।
২. ডাল (মসুর, মুগ)
ডালে উচ্চমাত্রার ফাইবার রয়েছে, যা হজমের জন্য ভালো। প্রোটিন ও খনিজ উপাদান (যেমনঃ ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস) সরবরাহ করে। রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে করে।
৩. গম ও চাল
শক্তি প্রদানকারী কার্বোহাইড্রেটের ভালো উৎস। ফাইবার সরবরাহ করে, যা দীর্ঘক্ষণ ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
৪. মসলা (জিরা, ধনে, গরম মসলা, আদা-রসুন, পেঁয়াজ)
রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং হজমে সহায়তা করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা দেহের কোষের ক্ষতি কমায়।
৫. ঘি ও তেল
ভালো ফ্যাটের উৎস হলেও বেশি পরিমাণে ব্যবহার করা হলে ওজন বৃদ্ধির ঝুঁকি থাকে।
আপ্যায়ন হোটেল খাঁটি ঘি এবং তেল ব্যবহার করে থাকে। তেলের পরিমাণ কম থাকায় যে-কেউ এ হালিম পরিমিত পরিমাণে খেতে পারে।তা
নিয়মিত মেনুর পাশাপাশি ইফতারে হালিমের বিশেষ উপকারিতা রয়েছে। তাই এ সময়ে খাবারটি বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
দ্রুত শক্তি পুনরুদ্ধার করে
হালিমে গম, চাল ও ডালের মতো জটিল কার্বোহাইড্রেট থাকে, যা শরীরকে দ্রুত শক্তি সরবরাহ করে এবং দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয়।
দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখে
প্রোটিন ও ফাইবার সমৃদ্ধ হওয়ায় এটি ধীরে হজম হয় এবং দীর্ঘক্ষণ ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে রাখে। ফলে রাতের খাবারে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমে।
পেশি গঠনে সহায়ক
মাংস ও ডালে থাকা প্রোটিন শরীরের পেশি গঠনে সাহায্য করে, যা রোজার সময় শক্তিশালী ও কর্মক্ষম থাকতে সহায়তা করে।
ইমিউনিটি বুস্ট করে
হালিমে থাকা মসলা, বিশেষ করে আদা, রসুন, জিরা, ধনে ও হলুদ, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং ঠান্ডা-কাশির মতো সমস্যা থেকে সুরক্ষা দেয়।
হালিম রান্নার ক্ষেত্রে সতর্কতা
হালিম যদি স্বাস্থ্যকর উপায়ে তৈরি করা হয়, তবে হালিম বিকালের নাস্তায় তথা ইফতারের জন্য একটি ভালো বিকল্প হতে পারে।
কম তেল ও ঘি ব্যবহার করুন
অনেক দোকানের হালিম অতিরিক্ত ঘি ও তেলযুক্ত হয়, যা ওজন বৃদ্ধি ও কোলেস্টেরল বাড়াতে পারে। তাই বাড়িতে তৈরি হালিমে কম পরিমাণে তেল ব্যবহার করা ভালো।
বেশি মসলা পরিহার করা
অতিরিক্ত ঝাল ও মসলা থাকা হালিম এসিডিটি ও হজমের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই মশলা পরিমাণমতো ব্যবহার করা উচিৎ।
আপ্যায়নের হালিমের এদিক থেকে সুনাম রয়েছে।
লবণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করুন
বেশি লবণ উচ্চ রক্তচাপ ও পানিশূন্যতার ঝুঁকি বাড়ায়, তাই হালিমে অতিরিক্ত লবণ দেওয়া উচিৎ নয়।
স্বাস্থ্যকর শাকসবজি যোগ করুন
গাজর, ক্যাপসিকাম, পালং শাক বা অন্যান্য সবজি যোগ করলে হালিমের ফাইবার ও ভিটামিন বৃদ্ধি পাবে, যা শরীরের জন্য ভালো।
সবখানে হালিম খাওয়া ঠিক নয়
হালিমে অতিরিক্ত তেল, মসলা ও প্রিজারভেটিভ থাকতে পারে, যা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। তাই স্বাস্থ্যকর উপায়ে তৈরি করা হালিম খেতে হবে।
কারা বেশি পরিমাণে হালিম এড়িয়ে চলবেন?
হালিম সাধারণত স্বাস্থ্যকর, তবে কিছু মানুষের জন্য এটি কম পরিমাণে খাওয়া ভালো।
যারা ওজন কমানোর চেষ্টা করছেন
হালিম উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার, তাই ওজন কমানোর চেষ্টা করলে কম পরিমাণে খাওয়া উচিৎ।
উচ্চ রক্তচাপ রোগীরা
বেশি লবণযুক্ত বা তৈলাক্ত হালিম রক্তচাপ বাড়াতে পারে। তাই নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে খাওয়া উচিৎ।
যাদের হজমজনিত সমস্যা আছে
অতিরিক্ত মসলা ও তেলযুক্ত হালিম গ্যাস্ট্রিক ও বদহজমের সমস্যা বাড়াতে পারে।
ডায়াবেটিস রোগীরা
হালিমে থাকা কার্বোহাইড্রেট রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়াতে পারে, তাই ডায়াবেটিস রোগীদের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে খাওয়া উচিৎ।