খেজুর গাছের রস জ্বাল দিলে খেজুর গুড় পাওয়া যায়। খেজুরের গুড় আমাদের দেশে বহুল পরিচিত একটি খাবার। কিন্তু এ খাবারের গুনাগুণ সম্পর্কে আমরা খুব বেশি জানি না। প্রধানত মিষ্টি হিসেবে গুড় ব্যবহৃত হয়, খেজুরের গুড়ও তার ব্যতিক্রম নয়।
খেজুরের গুড় হজমে সাহায্য করে। বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, আমাশার মতো রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় নিয়মিত খেজুর গুড় খেলে।
খেজুরের গুড়ে থাকে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, আয়রন ও ম্যাগনেসিয়াম। যারা রক্তস্বল্পতার ভুগছেন এবং যাদের রক্ত চলাচলে সমস্যা রয়েছে তাঁরা খেজুরের গুড় খেলে উপকার পাবেন, কারণ, খেজুর গুড়ে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন। হাড় ও বাতের ব্যথা কমাতে খেজুরের গুড় উপকারী বলে জানা গিয়েছে। খেজুরের গুড় শরীরের ভেতর থেকে চুল ও ত্বকের উজ্জ্বল বাড়ায়, ফলে রূপ সচেতন ব্যক্তিরা প্রতিদিন কিছু পরিমাণ খেজুরের গুড় খেতে পারেন। তবে যাঁদের ডায়াবেটিস আছে, তাঁদের খেজুরের গুড় খাওয়া একেবারেই নিষেধ।
বর্তমানে বাজার সয়লাব ভেজাল খেজুর গুড়ে। কমদামী চিনি এবং রং সহ নানান ক্যামিকেল উপাদান দিয়ে তৈরি বিষসম এসব খেজুরের গুড়ই মানুষ খাচ্ছে।
খেজুরের গুড়ে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত হাইড্রোজ
স্বপ্নের এবং স্বাদের খেজুরের গুড়ে চিনি আর বিষ ঢুকেছে, এবং এটা হচ্ছে প্রায় বাজারের সব গুড়ে। অনেক আগে থেকেই চিনি কেড়ে নিয়েছে খেজুরের রসের যশ, তবুও যারা গুড় খেতে চাচ্ছে তাদের সে গুড়ে বালি দিচ্ছে কিছু বাজে লোকেরা, আর এই বাজেদের দাপটই এখন এক্ষেত্রে বেশি।
লালচে রঙের কথিত খেজুরের গুড় কিনে ঠকছে ক্রেতারা এবং ক্রমেই তারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে গুড় কেনা থেকে, তবে আগে একবার ঠকে নিচ্ছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, ভেজাল গুড়ে সয়লাব বাজার। ফলোআপনিউজ থেকে যশোরের খাজুরা থেকে নিয়ামুল ইসলাম ঘুরে এসে জানালেন, আসলেই সেখানেই এখন সবচে বেশি সমস্যা। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি গাছিরাও ভেজাল দিচ্ছে, ফলে নিজেরা তদারকি করে না আনলে আসল খেজুরের গুড় সংগ্রহ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
নিয়ামুলের কথার সত্যতা মিলল এই কলেজ শিক্ষকের বক্তব্যে। যশোর খাজুরার বাসিন্দা, খাজুরা সরকারি সিরাজুদ্দীন কলেজের (সদ্য সরকারি) শিক্ষক অজয় মণ্ডল জানালেন, নিজেরা থেকে বিশ্বস্ত লোকের কাছ থেকে সংগ্রহ না করলে আসলেই প্রকৃত খেজুরের গুড় সংগ্রহ করা অসম্ভব।
বাজারে সোনালী, হালকা লাল, চকচকে, উজ্জ্বল সাদাটে গুড় দেখে সবাই আকৃষ্ট হয়। কিন্তু এই গুড়েই যে হাইড্রোজ নামক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ আছে তা আমরা অনেকেই জানি না। আখ, খেজুর, তাল রসের গুড়ের রঙ হাইড্রোজ দিয়ে আকর্ষণীয় সোনালী করা হয়। অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে চিনি, ময়দা ক্ষতিকর চিটাগুড় এবং রং করার জন্য বিষাক্ত কেমিক্যাল হাইড্রোজ ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে ভেজাল পাটালি গুড়। এই গুড় তৈরির প্রণালী হলো-চিনি, ময়দা, আলু, ঝোলা গুড়, চিটাগুড় খেজুরের পাটালি গুড় মিশিয়ে বিশাল আকৃতির কড়াইতে জ্বাল দেয়া হয়।
১০০ কেজির ভেজাল গুড়ের মধ্যে ৫০০ গ্রাম বিষাক্ত কেমিক্যাল হাইড্রোজ ও সালফেট মিশিয়ে আকর্ষণীয় রং তৈরি করে ‘খেজুরের পাটালি গুড়’ বানানো হয়। চিনির মূল্য পাইকারি হিসাবে প্রতি কেজি ৫৫ টাকা। আর গুড় প্রতি কেজি পাইকারি বিক্রি করা হয় ৬০-৪০০ টাকায়, ক্ষেত্র বিশেষ আরও বেশি। জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এই ভেজাল গুড়ে সয়লাব দেশের বাজার। শীত মৌসুমকে সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীরা এক থেকে দেড় মাস আগে থেকেই ভেজাল গুড় তৈরি শুরু করেন।
আসল খেজুর গুড় যেভাবে চিনবেন
বাজার নকল খেজুরের গুড়ে সয়লাভ। নকলেরও রকমফের আছে। খারাপ, খুব খারাপ, ভয়ঙ্কর -এভাবে ভাগ করা যায়। বাজারে ৬০ টাকা থেকে শুরু করে ৬০০ টাকা পর্যন্ত দামে খেজুর গুড় রয়েছে। নকলের ভিড়ে বাড়ছে আসলের কদর ও দাম। তবে আসল গুড় খুঁজে কেনাটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ এখন। সব অভিজ্ঞতাই যেন এখন এখানে হার মানে।
ফলে একথা বলাই যায় যে নকল ব্যবসায়ীরা আসলদের জন্যও একটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, তাদের বিরল করেছে, বিশেষ করেছে। না হলে খেজুর গুড়ের কেজি দেশীয় বাজারে কেন হাজার টাকা হবে? এক কেজি খেজুর গুড়ের দাম এক হাজার টাকা যে আছে, একথা হয়ত অনেকেই জানেন না। না জানলে কেউ সহজে অবশ্য মানতে পারবেন না।
প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে চিনবেন যে কোন গুড়টা আসল আর কোন গুড়টা নকল, যেখানে রসেরই রয়েছে অনেক প্রকার, তাছাড়া গুড় বানাবার প্রক্রিয়ার ওপরও গুড়ের মান ও রূপ পরিবর্তন হয়। রসের হেরফের হলে গুড়ের রং ও স্বাদের পরিবর্তন আসে। তবে মোটা দাগে কয়েকটি বিষয় আছে যেগুলো দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে যে কোন গুড়টা আসল আর কোন গুড়টা নকল।
১.আসল গুড় টনটনে শক্ত হবার কথা নয়। কোনো কিছু না মিশিয়ে শুধু ফুট দিয়ে গুড়ের পাটালি বানালে সেটি নরম নরম হওয়ার কথা। অর্থাত গুড় চেনার এক নম্বর উপায় হচ্ছে, দেখতে হবে পাটালিটি যথেষ্ট নরম এবং রসালো কিনা।
২.নতুন গুড় নোনতা লাগার কথা নয়। খুব নোনতা লাগলে বুঝতে হবে, এতে কিছু মেশানো হয়েছে। সাদা করার জন্য রসে ফিটকিরি দিয়ে পরিষ্কার করে নেওয়ার একটা চল আছে। তবে পুরনো গুড় এমনিই একটু নোনতা লাগতে পারে। রসে পঁচন ধরলে গুড় টক টক স্বাদের হয়, নোনতা হয় না।
৩.তবে গুড়ে চিনি এবং রং মেশালে সেটি সাদা চোখে ধরা খুব কঠিন। যেহেতু চিনিও মিষ্টি, তাই মিষ্টত্ব দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। একটা উপায় কিছুটা কাজে লাগতে পারে- ঘুটে গুড়ের পাটালি বানালে, বিশেষ করে সরাসরি রস দিয়ে, তাতে খুব দানা থাকার কথা নয়। যদি নতুন পাটালি গুড় ভাঙার পর খুব দানাদার মনে হয়, তাহলে বুঝতে হবে এতে চিনি মেশানো রয়েছে।
৪. অনেকে গুড়ের ঘ্রাণ দিয়ে আসল বুঝতে চায়, যেহেতু খেজেুরের গুড়ে বিশেষ ঘ্রাণ রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, প্রথম কাটার রসে যেমন ঘ্রাণ থাকে, দ্বিতীয় কাটার রসে সেরকম ঘ্রাণ থাকে না, তাই ঘ্রাণ দিয়ে খুব যে আসল নকল সবসময় চেনা যাবে সেটি একদম সঠিক নয়, তবে এটিও আসল গুড় চেনার একটি উপায়।
৫.স্বাভাবিকভাবে গুড় বানালে সেটি স্ফটিকের মতো চকচক করবে না। খুব চকচকে হলে বুঝতে হবে, এতে কিছু মেশানো হয়েছে। গুড়ে একটু তেতো হলে বুঝতে হবে বানানোর সময় গুড়টা একটু বেশি জ্বাল দিয়ে ফেলেছে, ফলে এটা একটু পোড়া পোড়া বা তেতো স্বাদের হবে।
শেষ কথা হচ্ছে, যতই বুঝদার হই না কেন আসল খেজুর গুড় চেনা যাবে না, ভুল হবেই। বিশ্বস্ত লোকের কাছ থেকে কিনতে হবে, এবং যে বানাচ্ছে তার কাছ থেকে কিনতে হবে, সেক্ষেত্রে একজন ভালো হলেই আপনি গুড়টা ভালো পাবেন। কিন্তু যে বিক্রি করছে তাকে বিশ্বাস করলেও কাজ হচ্ছে না, কারণ, সে ভালো হলেই গুড়টা ভালো হবে, এই নিশ্চয়তা নেই, যেহেতু সেও গুড়টা কিনে এনেছে।
সবচে ভালো হয় যদি সরাসরি গাছিদের সাথে আলাপ আলোচনা করে গুড় কেনা যায়। কারণ, সবচে বেশি ভেজাল গুড় তৈরি করে ভুঁইফোড় ব্যবসায়ীরা। তারা বাজার থেকে নিম্নমানের গুড় কিনে, তাতে নানান উপাদান মিশিয়ে ভালো মানের গুড় তৈরি করে, যেটি অনেক সময় তিনশো চারশো টাকা কেজি দরেও বিক্রি হয়, তাই বেশি দাম দিয়ে কিনছেন বলে এটা ভাবার কোনো উপায় নেই যে এটা আসল গুড়।
ভয়ঙ্কর দিক হচ্ছে, যশোরে গাছিদের বাড়িতে গিয়েও আমরা খুব বেশি আশ্বস্ত হতে পারিনি, তারাও জেনে গেছে, শিখে গেছে যে কীভাবে স্বচ্ছল হতে হয়, কীভাবে ধনী হতে হয়, কীভাবে একটু বেশি উপার্জন করতে হয়।
খেজুরের গুড় কোথায় পাবেন:সুহৃদ গ্রামোন্নয়ন সমবায় সমিতি লিমিটেড কিছু খাঁটি খেজুরের গুড় সংগ্রহ করে থাকে। তবে যেহেতু খুব বেশি পরিমাণে সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না, তাই শুধুমাত্র ফুড কনজুমার ক্লাব মেম্বারদের মধ্যে সুহৃদ খেজুরের গুড় সরবরাহ করে থাকে। এটা সমিতির মেম্বারশিপ নয়, কনজুমার মেম্বারশিপ।
অর্গানিক ফুড কনজুমার ক্লাবের (OFCC) মেম্বার হতে যোগাযোগ করুন (০১৭৭ ৮৮৩৪ ০৮৮)। এই মুহূর্তে সুহৃদ শুধু সীমিত আকারে ঢাকায় পণ্য সরবরাহ করছে মেম্বারদের মধ্যে। মনে রাখবেন, আপনি একজন সাধারণ ক্রেতা নন, আপনি একজন দায়িত্বশীল ক্রেতা। সুহৃদ আপনার টাকাটা পৌঁছে দিচ্ছে গ্রামোন্নয়ন সমিতির সদস্যদের মধ্যে, তারাই পণ্য উৎপাদন অথবা সংগ্রহ করছে। গ্রামের নারীদের সংগঠিত করে সুহৃদ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক খাবারের উৎস এবং ঐতিহ্য।