-
মোটা চালের ক্ষেত্রে কিছু উৎস বলছে, ২০০১ সালে দাম ১০ টাকা প্রতি কেজি ছিলো।

১ ভরি স্বর্ণের দাম (বাংলাদেশ, ২০০০ সাল, ২২ ক্যারেট)
-
“বাংলা ট্রিবিউন”-এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছেঃ ২০০০ সালে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের মূল্য (১ ভরি) ছিলো প্রায় ৬,৯০০ টাকা।
চালের বর্তমান বাজার দর গড়ে ৬৫ টাকা ধরলে চালের দাম গত পঁচিশ বছরে বেড়েছে ৬ থেকে ৭ গুণ। কিন্তু সোনার দাম বেড়েছে ২৫ থেকে ৩০ গুণ।
তাহলে এটা সহজেই বোধগম্য যে, শুধু সাধারণ ভোক্তাদের কাছ থেকে শুধু নয় ‘চাল ব্যবসায়ী’-এর টাকাও হাতিয়ে নিতে পেরেছে স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা।
সাধারণ শ্রমজীবী এবং চাকরিজীবীরা (ঘুষ খায় না ধরে নিয়ে, আসলে ১০ শতাংশের বেশি চাকরিজীবীর ঘুষ খাওয়ার সুযোগ নেই) কতটা ঠকেছে সেটি বুঝতে হলে বুঝতে হবে ব্যাংকে গত পঁচিশ বছরে টাকার প্রবৃদ্ধি কতটা হয়েছে, এবং টাকার অবমূল্যায়নের প্রকৃত চিত্র।
গত পঁচিশ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত, বাংলাদেশের টাকার অবমূল্যায়ন বা ক্রয়ক্ষমতার পতন কতটা হয়েছে, তা কিছুটা “ডলারের বিপরীতে মূল্য হ্রাস”-এর মাধ্যমে দেখা যায়।
তথ্য
-
২০০০ সালে, ১ মার্কিন ডলারের বিপরীতে ≈ ৳৫২.১৪ ছিলো।
-
২০২৫ সালে, বর্তমান বিনিময় হারে ১ মার্কিন ডলারের বিপরীতে ৳১২১-১২২ এর মতো।
হিসাব
ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে
১২১৫২.১৪ ≈ ২.৩২৫২.১৪১২১ ≈ ২.৩২
অর্থাৎ, গত ২৫ বছরের ব্যবধানে টাকার মূল্য প্রায় ২.৩২ গুণ কমে গেছে ডলারের বিপরীতে।
আরেকভাবে বলতে গেলে, ২০০০ সালে এক ডলার কিনতে ≈ ৳৫২ লাগতো, এখন লাগছে ≈ ৳১২১।
প্রকৃত চিত্র কিছুটা পাওয়া যাবে ডলারের ক্রয় ক্ষমতা কতটা কমেছে, সেটি হিসেব করলে।
গত ২৫ বছরে, অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত, মার্কিন ডলারের ক্রয়ক্ষমতা বা মূল্যস্ফীতি (CPI) পরিমাপ অনুযায়ী গড় বার্ষিক হার ছিলো ২.৫৫%। এই হার অনুযায়ী, ডলারের মূল্যস্ফীতি মোটামুটি ৮৭.৬০% বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ, ২০০০ সালে $১ যেভাবে পণ্য কিনতে পারতো, ২০২৫ সালে তার জন্য প্রায় $১.৮৮ প্রয়োজন হয়েছে।
বিশ্ব বাজারে গত পঁচিশ বছরে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ২.৫ গুণ (প্রায়)। সে তুলনায় বাংলাদেশে বৃদ্ধি অনেক বেশী। ফলে বিদেশী পণ্য কিনতে গিয়ে বাংলাদেশ ডলারের সাথে বিনিময় হারে বিশ্ববাজারের তুলনায় কিছুটা ঠকলেও দেশের মানুষ দেশের মাফিয়াদের কাছে ঠকছে অনেক বেশি। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে যে হারে শোষণ করছে বাংলাদেশের হর্তাকর্তারা দেশের মানুষকে চুষে খাচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি গতিতে।

চালের দাম থেকে বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশে টাকার অবমূল্যায়ন বাজার হিসেবে হয়েছে এর চেয়ে (ডলারের সাথে বিনিময় হার হিসেবের তুলনায়) অনেক বেশী। অন্যান্য পণ্যের মূল্যস্ফিতি চালের দামের দিগুণ বা কয়েক গুণ। দেখা যাচ্ছে— চালের দামের ক্ষেত্রে মূল্য বৃদ্ধিও যৌক্তিক পর্যায়ে নেই, কৃষিতে নানাবিধ ভর্তুকি থাকার পরেও। সোনার দামের কথা তো বলাই বাহুল্য।
রাষ্ট্রের হিসেবকৃত মূল্যস্ফিতি হিসেবে এবং ব্যাংকে আমানতকারীদের টাকার প্রবৃদ্ধি হিসেবে ২৫ বছরে চালের মতো চরম ভোগ্যপণ্যের দামও ৫ গুণের বেশি বাড়ার কথা ছিলো না। অতএব, চালের দামেই যদি ভোক্তারা এতটা ঠকে, তাহলে অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে কী হচ্ছে সেটি সহজেই বোধগম্য।
যুক্তরাষ্ট্রে গত পঁচিশ বছরে পণ্যের মূল্য যে হারে বেড়েছে তার চেয়ে আমাদের কাছে ডলার বিক্রি করছে বেশি হারে। অতএব, সে দিক থেকে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ঠকেছি। আগেই বলেছি দেশের পাণ্ডারা আমাদের ঠকাচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি। অবশ্য সেই টাকাও পাচার হয়ে আবার উন্নত দেশে গিয়েই জমা হচ্ছে।
জাপানে ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পণ্যমূল্য বাড়েনি, বরং কমেছে। এর পরের ১০ বছরে ১৫/২০ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু জাপান যে সকল দেশের সাথে ব্যবসা করছে, সেক্ষেত্রে বিশাল প্রবৃদ্ধি কামিয়ে নিচ্ছে সেসব দেশে জাপানি পণ্য বিক্রি করে।
প্রশ্ন ছিলো শুধু বেতনে চলে এমন চাকরিজীবীরা কতটা ঠকছে?
শ্রমজীবীরা কতটা ঠকেছে?
বাংলাদেশের ব্যাংক সঞ্চয় ও FD-এর সুদের হারঃ
| সময়কাল | সাধারণ সঞ্চয় হিসাব (বার্ষিক) | স্থায়ী আমানত/FD (বার্ষিক) |
|---|---|---|
| ২০০০ | ৪–৫% | ৬–৭% |
| ২০১০ | ৪–৫% | ৬–৭% |
| ২০২০ | ৪–৫% | ৫–৬% |
| ২০২5 | ৪–৫% | ৫–৬% |
লক্ষ্য করুনঃ সুদের হার প্রায় স্থিতিশীল, তবে মূল্যস্ফীতি হার প্রায় ৬–৭% (সরকারি হিসেবে)। প্রকৃত মূল্যস্ফিতি অনেক বেশি।
২️⃣ আনুমানিক হিসাব
-
ধরুণ, ২০০০ সালে ব্যাংকে ১০,০০০ টাকা রাখা হয়, FD-তে বার্ষিক সুদ ≈ ৬%।
-
২৫ বছরের শেষে (সুদের সংযোজনসহ) মোট হবেঃ
FV = 10,000 × (1+0.06) 25 ≈ 10,000 × 4.29 ≈ 42,900 টাকা ।
FV = 10,000 × (1+0.06) 25 ≈ 10,000 × 4.29 ≈ 42,900 টাকা।
-
মূল্যস্ফীতি (CPI) অনুযায়ী ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস ≈ ৫.৩ গুণ।
-
অর্থাৎ, ৪২,৯০০ টাকার ক্রয়ক্ষমতা ≈ ২০০০ সালের ৮,০০০ টাকার সমান।
তবে ২০১৩ সালে সরকার বেতন হঠাৎ দিগুণ করায় সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন মূল্যস্ফিতির সাথে পাল্লা দিতে শুরু করে।
সরকারি বেতন বৃদ্ধির হার
| বছর | সর্বনিম্ন বেতন (টাকা) | সর্বোচ্চ বেতন (টাকা) | বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি | মোট বৃদ্ধি (গুণে) |
|---|---|---|---|---|
| ২০০০ | ৯০০ | ১০,০০০ | – | – |
| ২০১০ | ৩,৫০০ | ২০,০০০ | ~৬–৭% | ~৩.৮ |
| ২০২০ | ১০,০০০ | ৭০,০০০ | ~৫% | ~৭.০ |
| ২০২৫ | ১৭,৫২০ | ৭৮,০০০ | ~৫% | ~৭.৮ |
মোট বৃদ্ধিঃ সর্বনিম্ন বেতন প্রায় ১৯ গুণ এবং সর্বোচ্চ বেতন প্রায় ৭.৮ গুণ বাড়ে। তারপরও বেতন গ্রেডে ভয়াবহ বৈষম্য থাকায় নিচের গ্রেডের চাকরিজীবীদের ক্রয়ক্ষমতা নগন্য।
গত পঁচিশ বছরে দেশের গড় মূল্যস্ফিতি ১০ থেকে ১২ গুণ হয়েছে ধরলে সরকারি চাকরিতে বেতন বৃদ্ধি সন্তোষজনক। চাকরিজীবীরা ঠকছে টাকা সঞ্চয় করতে গিয়ে। খরচ করতে গিয়ে তারা খুব বেশি ঠকেনি, বিশেষত ২০১৩ সাল থেকে। তবে নিচের পাঁচ ছয়টি গ্রেডের চাকরিজীবীদের পক্ষে বাজারের সাথে তাল মিলিয়ে চলা কঠিন।
বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন একই হারে বাড়েনি। বেসরকারি চাকরিজীবী এবং শ্রমজীবীরা ২০১৩ সালের পরে বেশি ঠকেছে। বাংলাদেশে শ্রমবাজার বেসরকারি খাত হিসেবেই পরিগণিত। ফলে সাধারণ মানুষের সম্পদ হারানোর চিত্রটা হিসেবে করতে হবে শ্রমজীবী এবং বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের আয় ব্যয় হিসেব করে।
প্রকৃতপক্ষে যা হয়েছে— ৯০% মানুষ (প্রায়) ১০% (প্রায়) মানুষের কাছে লাগাতার কষ্টার্জিত সম্পদ হারিয়েছে, হারাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে— কাদের কাছে জমা হয়েছে, হচ্ছে এ সম্পদ?
একজন রিক্সালার স্ত্রী বা একজন ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভের স্ত্রী যদি এক ভরি স্বর্ণ কেনে সাথে সাথে সে ঠকছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। বলা যায়— তার পকেট থেকে ৬০ হাজার টাকা এক রকম সিনতাই করে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এ ‘সিনতাই’ নিয়ে কথা বলার সুযোগ নেই। এক কেজি ইলিশ মাছের দাম স্বাভাবিকভাবে বাড়লে ১২০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা হওয়ার কথা ছিলো। দাম ২৫০০ টাকা হওয়ার অর্থ আমার কাছ থেকে কেউ না কেউ অথবা কতিপয় ১০০০ টাকা ‘সিনতাই’ করে নিচ্ছে। সম্পদহানি হিসেব করলে এটি পিস্তল ঠেকিয়ে নেওয়ার মতোই। কিন্তু এর জন্য কোনো বিচার আচার নেই!
গত পঁচিশ বছরে দেশীয় পণ্য চালের দাম বেড়েছে ৭ গুণ, ইলিশ মাছের দাম বেড়েছে ২০ গুণ, অথচ শতভাগ রাজস্ব বসানোর পরেও বিদেশী পণ্য আপেলের দাম বেড়েছে ৫ গুণ। অর্থাৎ, উৎপাদন এবং সংরক্ষণ প্রক্রিয়া এবং পরিবহন ব্যবস্থায় প্রভূত উন্নয়ন হওয়ার কারণে বিশ্ববাজারে ভোগ্য পণ্যের দামের প্রবৃদ্ধি কম হলেও, তুলনায় বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্যের প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি। আবার কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে এ প্রবৃদ্ধি এতটাই যে, সাধারণ মানুষ লাগাতারভাবে নিয়ন্ত্রকদের কাছে তাদের সম্পদ হারাচ্ছে।
গত পঁচিশ বছরে দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি সম্পদ হারিয়েছে জায়গা এবং ফ্লাট কিনতে গিয়ে। এক হিসাব থেকে দেখা যায়— ঘুষের টাকা এবং লাগামহীন উপার্জনের টাকা ভোগ করার পরে যে দুই খাতে বেশি ব্যয় হয়, সেটি হচ্ছে স্বর্ণ এবং জমি/ফ্লাট। এ দুই খাতের লাগামহীন উল্লম্ফনই বলে দেয়— সাধারণ মানুষ দুইভাবে ঠকছে দুবৃত্তদের কাছে। একবার তারা টাকা হাতিয়ে নিয়ে ঠকাচ্ছে। আরেকবার ঠকাচ্ছে স্বর্ণ এবং জমিতে বিনিয়োগ করে। এর বাইরে ট্যাক্স ফাঁকি তো আছেই।
জমির মূল্যবৃদ্ধির কিছু উদাহরণ
-
ঢাকার Institute for Planning and Development বলেছে যে, ২০০০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ল্যান্ডের দাম প্রায় ২,৭৪০% বেড়েছে। The Business Standard
-
একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে ২০০০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ল্যান্ডের দাম প্রায় ২,৭৫০% বেড়েছে। bti
যদি ২৫ বছরের হিসাব করা হয়
-
গত ২৫ বছরে জমির দাম বেড়েছে প্রায় ২,৭৫০%। অর্থাৎ আগে যা দাম ছিলো, এখন প্রায় ২৮.৫ গুণ।
-
যদি ১০০ টাকা ছিলো ধরি, এখন তা হবে প্রায় ২,৮৫০ টাকা।
এ বৃদ্ধি ইলিশ মাছ এবং স্বর্ণের চেয়েও অনেক বেশী। জমির দাম লাগাতার বৃদ্ধি পাওয়ায় গরীবেরা জমি হারায়, হারাচ্ছে।
