“ক্রেতার চেয়ে যেন বিক্রেতা বেশী!”
কথাটি রূপকার্থে বলা হলেও মেঘের মতো সত্য। খুলনা অঞ্চলে জনতা ব্যাংকের প্রায় সব শাখাতেই প্রয়োজনের তুলনায় লোকবল বেশী। খুলনা শহরের শাখাগুলোতে এটা অনেক বেশী। বিশেষ করে খুলনা শহরের হাদিস পার্ক সংলগ্ন খুলনা কর্পোরেট শাখায় এ চিত্র খুবই দৃষ্টিকটু। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশী লোকবল থাকলেও শাখাটিকে সচল করার জন্য বিশেষ কোনো তৎপরতা নেই। আমানতের তুলনায় ঋণ অনেক বেশী, ঋণ খেলাপিও বেশি। জেনারেল ব্যাংকিং (সাধারণ সেবা) এখানে খুবই কম, দৈনিক কাস্টমারের সংখ্যা ৫০০ থেকে ৮০০ জন, অথচ এ শাখায় লোকবল রয়েছে ৬১/৬৩ জন, এবং চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করছে আরো ২৪ জন। সহকারী মহাব্যবস্থাপক ৩ জন, সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার ৭ জন, প্রিন্সিপাল অফিসার ১০ জন, সিনিয়র অফিসার ১৯ জন সহ অন্যান্য পদের কর্মকর্তা এবং কর্মচারী রয়েছেন।
শাখাটির মাসিক পরিচালন ব্যয় ৬০/৭০ লক্ষ টাকা, শুধু কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন হিসেবেই খরচ হয় প্রতিমাসে ৪৩/৪৪ লক্ষ টাকা। এর সাথে বাৎসরিক ছয়টি বোনাস যোগ করলে অংকটি প্রায় ৫০ লক্ষে গিয়ে দাঁড়ায়। এর বাইরে বড় খরচের মধ্যে রয়েছে চুক্তিভিত্তিক লোকবলের বেতন, দৈনিক ভোজন ভাতা, অফিস বাড়া, টিএ-ডিএ বিল, ডেপ্রিসেয়েন কস্ট এবং কম্পিউটার সহ অন্যান্য যন্ত্রাংশের পিছনে খরচ। সাথে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেশের সার্বিক মুদ্রাস্ফিতির তুলনায় কম সুদের ঋণ সুবিধার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করা যায়। খরচের বিশাল এ হিসেবের বিপরীতে শাখাটিকে গণমুখী বা ব্যাংকের ভাষায় লাভজনক করার মতো কোনো কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়।
৭ জানুয়ারি ২০২৫-এর তথ্যমতে শাখাটতে ঋণ স্থিতি ৯৯৮ কোটি টাকা, বিপরীতে আমানত রয়েছে ৪৮০ কোটি টাকা। এত বেশি টাকা বিক্রি করেও জনতা ব্যাংকের এই শাখাটি ক্রমাগতভাবে তাহলে ক্ষতিতে পড়ছে কেন? প্রশ্ন উঠেছে— এত লোকবলের এখানে কাজটা আসলে কী?
সবাইকে যদি সৎও ধরে নেওয়া হয়, তাহলেও তো কাজের হিসেবে এবং ব্যাংকের সার্বিক পারফরম্যান্স বিবেচনায় বছরে প্রায় ৪টি লভ্যাংশ বোনাস যুক্তিসঙ্গত নয়। উল্লেখ্য ২০০৩-২০০৪ অর্থ-বছরে জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পোনে চারটি লভ্যাংশ বোনাস পেয়েছে।
কেন এ শাখাতে লোকবল এত বেশি?
এ বিষয়ে খুলনা অঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক জনাব আবুল কালাম আজাদ বললেন, খুলনা অঞ্চলে অনেকগুলো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, এর কারণে হয়ত খুলনা অঞ্চলে চাকরিজীবীর সংখ্যা বেশি। যেহেতু ব্যাংকের চাকরির ক্ষেত্রে নিজ জেলায় পোস্টিং দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে, ফলে এটি ঘটে থাকতে পারে।
তবে কর্পোরেট শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক (সহকারী মহাব্যবস্থাপক) জনাব মোহাম্মদ মেহেদী হাসান বললেল, বিভাগ লোকবল দিয়েছে বলেই এই শাখাতে লোকবল এত বেশি। তবে লোকবল এত প্রয়োজন নেই, এটা তিনি স্বীকার করেছেন।
লাভ না হলে লভ্যাংশ বোনাস চাকরিজীবীরা কীভাবে পাচ্ছেন?
লভ্যাংশ বোনাস ঘোষণা করে হেড অফিস। ফলে যদিও কার্যত একটি শাখার লাভ-লসের ওপর এ বোনাস নির্ভর করে না, কিন্তু সব মিলিয়েও কি জনতা ব্যাংক লাভে আছে? ব্যাংকের এ শাখাটিতে বর্তমানে ঋণ স্থিতি ৯৯৮ কোটি টাকা, আমানত রয়েছে ৪৮০ কোটি টাকা। সাথে সাধারণ ব্যাংকিং সেবা যোগ করলে ব্যাংকের এ শাখাটি অনেক লাভে থাকার কথা। কিন্তু কার্যত শাখাটিতে লাগাতার লস হচ্ছে, সেটি যেমন ব্যাংকের ভাষায়, পাশাপাশি কল্যাণমুখী অর্থনীতি বিবেচনায় নিলেও। ব্যাংকটি মূলত অন্য শাখার (মফস্বলের) আমানত ব্যবহার করে ঋণ দিয়েছে। ক্ষতির অংক সামাজিক অবদান হিসেবে পরিমাপ করেও যদি বুঝতে চাওয়া হয়, তাহলে তথ্য বলছে স্বজনপ্রীতি এবং যোগাযোগে বাইরে স্বতস্ফূর্তভাবে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সৃষ্টির মতো কোনো উদ্যোগ তারা নেয়নি।
ব্যাংকের জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ শাখায় ফোন করা হলে জনাব মুহাম্মদ এহতেশাম জলিল (উপ-মহাব্যবস্থাপক) বলেন, এখনো ব্যাংক চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেনি, ফলে ব্যাংকের লাভ-ক্ষতি বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারছেন না। ফলোআপ নিউজ প্রশ্ন করেছিলো— তাহলে কীসের ভিত্তিতে ব্যাংক কর্মকর্তাদের লভ্যাংশ বোনাস দিয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর তিনি দেননি, জানতে হলে লিখিত আবেদন করতে বলেছেন।
শাখাটিতে এত লোকবল তাহলে করে কী?
প্রতিদিন গড়ে মাত্র ৬০০ থেকে ৭০০ ভাউচারের বিপরীতে ব্যাংকের নিজস্ব এবং চুক্তিভিত্তিক মিলিয়ে ৮০-এর অধিক লোকবল তাহলে কী করেন, কতটা দায়িত্বের সাথে তারা কাজ করছেন? অনেকেই অধিকাংশ সময় অলস সময় কাটান গ্রাহকদের এমন অভিযোগ আমলে না নিলেও সরোজমিনে গিয়ে দেখা গিয়েছে— ব্যাংকের এ শাখাটিতে কখনই ভিড় থাকে না, বেলা বারোটার পরে গেলে মনে হবে এটা এমন একটি হাট যেখানে শুধুই বিক্রেতা, কোনো ক্রেতা নেই।
বিশেষজ্ঞের মতামত হচ্ছে— অধিক লোকবল থাকার মূল কারণ ব্যাংকারদের শহরে বাড়ি করে শহরে থাকার প্রবণতা। দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার মানসিকতা জাতিগতভাবেই আমাদের নেই, ফলে এটি শুধুমাত্র জনতা ব্যাংকের এই শাখার কর্মজীবীদের সমস্যা নয়, এটি আমাদের সমস্যা। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ চাকরিজীবীরা চাইলে শাখাটির এ অলসতা উদ্ভাবনী ব্যাংকি-এর কাজে লাগাতে পারতো, তারা ছোটো ছোটো উদ্যোক্তা তৈরি করতে পারতো। জমার বিপরীতে এতটা ঋণ স্থিতির পরও জনতা ব্যাংকের এই শাখাটির লসে থাকার এ বিষয়টিকে বিস্ময়কর বলেছেন তিনি।
অত্র শাখাতে খেলাপি ঋণ এবং মন্দ-ঋণের পরিমাণ কত?
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, নির্দিষ্ট সময় পর ঋণগ্রহীতা যদি ঋণ বা ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করে,তখন ঐ অনাদায়ী ঋণকে খেলাপি ঋণ বলা হয়।
জনতা ব্যাংকের এ শাখাটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখনো জানা সম্ভব হয়নি। তবে বাগেরহাটে অবস্থিত লকপুর গ্রুপকে দেওয়া বড় অংকের একটি ঋণ খেলাপি রয়েছে। লকপুর গ্রুপের মালিক সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের সাবেক চেয়ারমান এসএম আমজাদ হোসেন। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক, ব্যাংকিং অর্থনীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ একজন অধ্যাপক বলেছেন, সরকারি ব্যাংকে ঋণ খেলাপি থেকে একইসাথে নিজেই একটি ব্যাংক খুলে বসার নজির সম্ভবত পৃথিবীতে আর কোথাও নেই।
উল্লেখ্য, ৮ আগস্ট সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশেরকালে বিজিবির হাতে আটক হয়েছিলেন এ ব্যবসায়ী।
…