ভাবলাম, ভুল হয়েছে কর্মরতদের। ওরা ভুল মেনে নিয়ে ঠিক করে দিল।
অনেক গ্লানিবোধ আছে, অনেক কথা আছে, হয়ত সেগুলো বলার সময় এখনো আসেনি। কোনোদিন হয়ত আসবেও না। নিশ্চিত ঘুরে না দাঁড়িয়ে এসব বলে হাস্যস্পদ হতে চাই না।
মানুষ হাসতে পছন্দ করে, অপমান করতে পছন্দ করে, অবিশ্বাস করতে পছন্দ। মানুষের ঈশ্বর বিশ্বাসের প্রত্যয় কোনোভাবেই সহজিয়া নয়, এটা মানুষকে অবিশ্বাসেরই পরোক্ষ আয়োজন, আধ্যাত্মিকতা নামমাত্র। মানুষের এই সহজাত প্রবৃত্তি থেকে নিজের জীবনের দিকনির্দেশনা তৈরি করে নেওয়া খুব জরুরী।
সব বুঝেও মাঝে মাঝে কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করে, বলে যাওয়া প্রয়োজন মনে হয়। মানুষের জীবন তো আসলে কিছুই না। একটা পিঁপড়ের মৃত্যু আর একজন মানুষের মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য শুধু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে, প্রকৃতির কাছে দুইই মূল্যহীন।
পার্থক্য শুধু এই যে পিঁপড়ার বেঁচে থাকা বৈ কোনো শক্তি নেই। (হয়ত আছে আমরা জানি না) কিন্তু দৃশ্যত মানুষের বহুমুখী কর্মের সুযোগ রয়েছে। বেঁচে থাকার তাগিদে দৈনন্দিন কর্মগুলো ঐ গরুর ঘাস খাওয়ার মতোই। গরু সোজা পথে মাঠ থেকে ঘাস খায় এবং ইচ্ছেমত মলত্যাগ করে বাঁচে, আমরা অনেক আয়োজন করি, কিন্তু এতে প্রাণ-বৈচিত্র এবং পৃথিবীর কী যায় আসে?
প্রাণীদের মধ্য মানুষ সভ্যতার দাবীদার, দাবী করার মতো কিছু মানুষ করেছে ঠিকই, আবার প্রকৃতির জন্য, প্রাণের জন্য মানুষ হুমকিও বটে। তদুপরি মানুষ যে শক্তিতে, বুদ্ধিমত্তায় অন্যপ্রাণীদের চেয়ে এগিয়ে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
মানুষের এই বুদ্ধিমত্তা এমনি এমনি হয়নি। অভিজ্ঞতা, জ্ঞান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তরের মাধ্যমে তা সম্ভব হয়েছ। এটি না করতে পারলে মানুষ এই পর্যায়ে এসে পৌঁছুতে পারত না।
পাথরে খোদাই না করা থাকলে প্রাচীন সভ্যতার কিছুই জানা হত না। লিখতে পড়তে যখন জানে না, তখনও মানুষ প্রজন্মের জন্য এঁকে রেখে গিয়েছে নানান নির্দেশনা। অঙ্কন তাই লেখ্যরূপের মধ্যে সর্বাধিক প্রাচীন।
অন্যদিকে চলে যাচ্ছি। প্রসঙ্গে ফিরি। বলতে চাচ্ছিলাম, কিছু গ্লানির কথা, বঞ্চনার কথা। অবশ্য এ আমার ব্যক্তিগত পাওয়া না পাওয়ার ফিরিস্তি নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি অপূর্ণ নই, হতাশ নই।
আধুনিক সভ্যতায় মানুষ যত কর্ম করে বাঁচে এর মধ্যে সর্বাধিক সহজ এবং ঝুঁকিমুক্ত জীবিকা হচ্ছে চাকরি, সরকারি চাকরি হলে তো কথাই নেই। সেই চাকরিটা যদি হয় কোনো দুর্নীতিযুক্ত দেশে, তাহলে তো একেবারে পোয়াবারো।
চাকরিতে আয়-উপার্জনের বিষয় আছে, দারোগাগিরিও আছে প্রচুর, তাই জীবনটাকে যারা ধাবিত হওয়া এবং ধাওয়া করার বিষয় ভাবতে চায় বা সেভাবে অভ্যস্ত হয় তাদের জন্য এসব চাকরি বিশাল আশীর্বাদ।
নইলে আমাদের আমলাতন্ত্রে ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে ভালোভাবে চাকরি করতে গেলে তার নাভিঃশ্বাস উঠে যায়। চোরের দলে না ভিড়লে নিশ্চিতভাবে সে কোণঠাসা হয়ে যায়।
কৃষি ব্যাংকে চাকরিটা আমি বাই-চয়েজ নিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল গ্রামে থাকব, স্বচ্ছলভাবে চলব, কিছু কাজ করব। খামার-কৃষি -এসবের প্রতি আকর্ষণ আমার বহুদিনের।
আপনাদের বিশ্বাস করা হয়ত কষ্ট হবে যে, পারা জিনিসও পরীক্ষায় লিখে আসতে আমার কষ্ট হয়। এসব পরীক্ষা দিতে আমার ভালো লাগে না। তড়িঘড়ি করে যেমন তেমন করে দিয়ে শুধু পাস করতে চাই। চাকরির পরীক্ষাও সিরিয়াসলি দেয়া আমার জন্য কঠিন।
কিন্তু যেহেতু কৃষি ব্যাংকের চাকরিটা আমি করতে চাই, পরীক্ষাটাও দিলাম সিরিয়াসলি। ফলে চাকরিটা হল। শুধু হল না, ফোর্থ পজিশনে থেকে আমি যোগদান করেছিলাম। ঢাকার পাঠ চুকিয়ে গ্রামে যাওয়ার পালা, আমি মনে মনে ভাবছি—সুইট হোম, মাই সুইট হোম!
খুলনায় গিয়ে বিভাগীয় কার্যালয়ে যোগদান করলাম। এটা জানতাম যে, জাতীয়ভাবে ফোর্থ হলেও খুলনা অঞ্চলে মেধাতালিকায় আমি প্রথম ছিলাম, কিন্তু লিস্টে দেখি আমি দ্বিতীয় অবস্থানে। প্রথম অবস্থানে যে ছিল তাকে জিজ্ঞেস করলাম সে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হয়েছে কিনা, যখন জানলাম সে ১৬০তম তখন বিষয়টা ভালো লাগল না।
ভাবলাম, ভুল হয়েছে কর্মরতদের। ওরা ভুল মেনে নিয়ে ঠিক করে দিল।
অফিশের কাজ সেরে ঐদিন ফিরে আসার সময়, ঐ অফিসের একজন আমাকে কানে কানে বলল, বিষয়টি ভুল ছিল না, ইচ্ছাকৃত ছিল, জিএম স্যার আপনার উপর খুব খেপেছে। খুলনার জিএম ঐদিন আমাদের যোগদানের কাজ সেরে বরিশাল বদলী হয়ে যাচ্ছেন। যাওয়ার আগে আমাদের ধার্মিক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে গেলেন, যেহেতু তিনি ধার্মিক মানুষ ছিলেন। ধর্মকে সম্বল করে তিনি জিএম হতে পেরেছন, তাই অন্যকে ধার্মিক হতে বলার মধ্যে তার নৈতিকতার প্রকাশ ছিল বটে!
রীতিমাফিক একটা সাক্ষাৎকার হল। নতুন জিএম সাক্ষাৎকার নিলেন। আসলে শুধু জানালেন কোথায় পোস্টিং। আগের জিএম আমার পোস্টিং দিয়ে গিয়েছিলেন বাগেরহাটের রায়েন্দা। আমার নিজ জেলায় হলেও তা বাড়ি থেকে ভীষণ দূরে, দুর্গম পথে। সাধারণত মেধা তালিকায় উপরে থাকলে পোস্টিংটাও সেভাবে দেওয়ার একটা অলিখিত রীতি আছে।
যাইহোক, নতুন জিএম পরিবর্তন করে দিলেন মোল্লাহাট। মোল্লাহাট চাকরি করতে গিয়ে প্রথম ছয়মাস অনুগত ছাত্রের মত কাজ করেছি। পিয়নকেও বস মেনেছি, নতুন হিসেবে মানা উচিৎ বলে। গভীর মনোযোগে প্রতিদিনের লেনদেন এবং লেজারগুলো দেখতাম।
দুটো ক্লোজিং পেয়েছি সাত মাসে, তাই কিছু বোঝাও হয়েছে। ঢুকেই একটা ক্লোজিং পেয়েছিলাম। ডিসেম্বর ক্লোজিংএই মারাত্মক মারাত্মক ঘাপলা চোখে পড়েছিল। নতুন বলে সেগুলো অত বুঝতে চাইনি। পরে আস্তে আস্তে বুঝেছি যে মোল্লাহাট শাখা ব্যাংকিং করেনি এতদিন, ডাকাতি করেছে শুধু।
তখন কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। ওনাকে জনালাম কৌশলে কিছু বিষয়। জানি না উনি কীভাবে বিষয়টা ডিল করেছিলেন, একটা তদন্ত শাখায় হয়েছিল দু’জন ডিজিএম-এর নেতৃত্বে। আমি চলে আসার পরে আরো অনেক কিছু হয়েছে শুনেছি।
উনি যতদিন চেয়ারম্যান ছিলেন ততদিন আমার কিছু হয়নি। কিন্তু উনি চলে যেতেই আমার উপর খড়গ নেমে আসে। আমাকে বদলী করে পাঠানো হয় সেই ধার্মিক জিএম-এর কাছে, যোগদানের দিন বরিশালে বদলী হয়েছিলেন যিনি। দিনের দিনে তিনি আমাকে দিয়ে দেন ভোলার চরফ্যাশন।
ঐদিন চরফ্যাশন যাচ্ছি আর সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, কী করা যায়। চরফ্যাশনের মাস দুই থেকে অসুস্থ হয়ে ঢাকায় চলে যাই। তার আগে বিসিএস রিটেন পরীক্ষা খুলনায় বসে দিয়েছিলাম। নিঁখুত পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কৃষি ব্যাংকের চাকরির অভিজ্ঞতা খারাপ হওয়ায় পাঁচ মাস চাকরি করার পর বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই এবং সেইমত পড়াশুনাও করি। রিটেন পরীক্ষার অনেক দিন পর ভাইভা পরীক্ষা হল। ভাইভা পরীক্ষাও খুব ভালো হয়েছিল। যেহেতু পররাষ্ট্র ক্যাডার ফাস্ট চয়েজ ছিল, তাই প্রশ্ল করেছিলেন তারা ইংরেজিতে। সেটি আমার জন্য বোনাস ছিল, যেহেতু আমি ইংরেজি বলায়, লেখায়, শোনায়, পড়ায় বেশ ভালো বলে মনে করি। প্রশ্নকর্তাদের চেয়ে আমার ফ্লুয়েন্সি অনেক ভালো ছিল।
তবে তাদের শেষ প্রশ্ন আমাকে দিগ্বিদিক করে দেয়। একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে বসে, প্রশ্নটি ছিল আমার বিবাহ বিষয়ে। আরেকটি প্রশ্ন করে আমাকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করে। বলেন, আপনি চাকরি করেন তাতো উল্লেখ করেননি। উল্লেখ অনেকেই করে না। আমার ধারণা, কৃষিব্যাংক থেকে কেউ আমার বিষয়ে পিএসসি তে ফরোয়ার্ডিং পাঠিয়েছিল। ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো।
এর আগে ভাইভার জন্য মূল সনদপত্রগুলো আনতে যখন বরিশাল গিয়েছিলাম তখন যেভাবে আমাকে হেনস্থা করা হয়েছিল তা ছিল এক কথায় সৃষ্টিশীল! এর চেয়ে বেশি হয়রানি কাউকে করা যায় না। আমাকে রিজাইন দিতে বাধ্য করে তারপর সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছিল, অথচ সার্টিফিকেটগুলো তারা রেখেছিল অবৈধভাবে।
এসবের জন্য আমার কোনো আফসোস হয় না, নিজে আমি ঠিকই আছি, ঠিক ট্রাকে আছি। কিন্তু যেভাবে এসব প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ কর্ণধার অসভ্যের মত মানুষ শোষণ করছে, অধস্তনদের শোষণ করছে, অধস্তনদের মাধ্যমে শোষণ অত্যাচার করছে—তা কোনোভাবেই মানা যায় না।
#দিব্যেন্দু দ্বীপের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ “আমার আমি: টুকরো গল্প” থেকে নেওয়া।