বাংলাদেশে প্রতিবছর যে বিমানে যে সোনা আসে, চোরাচালানের পাশাপাশি সেগুলো আসলে বৈধপথেই আসে। কিন্তু এ বৈধ উপায় নিয়েই রয়েছে প্রশ্ন।
পাশাপাশি তথ্য বলছে— “প্রতিবছর দেশে সোনার যে চাহিদা রয়েছে, তার ১ শতাংশও বাণিজ্যিকভাবে আমদানি হচ্ছে না। ব্যাগেজ রুলসের মাধ্যমে বছরে ৫-৬ মণ স্বর্ণ আসলেও বাকি স্বর্ণের হদিস নেই। প্রশ্ন উঠছে এত স্বর্ণ গেল কই? সহজ করে বললে, বৈধ আমদানি যতটা হচ্ছে, তার কয়েকগুণ বেশি সোনা চোরাচালানের মাধ্যম আসছে।” এই তথ্যের সূত্র ধরে বললে বলা যায়— অনেক প্রতিবেদন ব্যাগেজ নীতিমালায় ঢোকা স্বর্ণকেও চোরাচালানের আওতায় ফেলে দিচ্ছেন। যোগশাযোশে কর ফাঁকি এবং ব্যাগেজ নীতিমালায় ঢোকা স্বর্ণের উদ্দেশ্য বিবেচনা করলে বিষয়টি যদিও চোরাচালানই হয়, কিন্তু সেটি বলার সুযোগ নেই।
স্বর্ণ নীতিমালার আওতায় লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে সোনা আমদানি করতে পারে। আবার ব্যাগেজ রুলসের আওতায় সোনা ও সোনার বার শুল্ক পরিশোধ করে আনার সুযোগ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি ১০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণ বিনা শুল্কে আনা যায়। তবে বাণিজ্যিক আমদানিতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ একেবারেই কম। সোনার ব্যবসা বৈধতার মধ্যে আনতে ২০১৮ সালে সরকার স্বর্ণ নীতিমালা করে। স্বর্ণ নীতিমালা অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর ৪০ মেট্রিক টন সোনার চাহিদা রয়েছে। এ চাহিদার এক শতাংশও বাণিজ্যিকভাবে আমদানি হচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের মতে বাণিজ্যিকভাবে স্বর্ণ আমদানী হচ্ছে না উচ্চ শুল্কের কারণে। সরকারি কর্মকর্তারা বলছে শুল্ক কমানো বাড়ানোর সাথে সোনা চোরাচালানের তেমন কোনো সম্পর্ক আসলে নেই।
বাংলাদেশে সোনা প্রবেশ করে প্রধানত আকাশপথে এবং পানিপথে, বেরিয়ে যায় স্থলপথে। তবে ব্যাগেজ রুলের আওতায় আসা স্বর্নের পরিমাণও বিশাল। করোনা অতিমারির পর থেকে এটি হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। ২০২০ সালে ব্যাগেজ রুলের আওতায় যাত্রীরা স্বর্ণ এনেছে ৫.৫ টন, ২০২১ সালে এনেছে ৩৫.২ টন, ২০২২ সালে এনেছে ৫৩.৮৫ টন। যাত্রীরা কোনো শুল্ক ছাড়া যেমন ১০০ গ্রাম স্বর্ণ আনতে পারেন, পাশাপাশি প্রতি ভরিতে ২০০০ টাকা কর দিয়ে ২৩৪ গ্রাম স্বর্ণ আনতে পারেন। চোরাচালান থাকলেও সেটি প্রধানত স্বর্ণ বেরিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে, দেশে স্বর্ণ ঢোকার সবচেয়ে বড় উপায় এটির (ব্যাগেজ) রুল। বাকী সোনা প্রবেশে করে ভারত থেকে গয়না হিসেবে। বিশেষ করে ডায়মন্ডের নামে সকল গয়নাই ভারত থেকে প্রবেশ করে। এবং এক্ষেত্রে বৈধপথে প্রবেশের রেকর্ড নেই বললেই চলে।
ব্যাগেজ নীতিমালায় ঢোকা স্বর্নের ক্ষেত্রে যেমন কর ফাঁকির বিষয় রয়েছে, পাশাপাশি এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপরও প্রভাব পড়ছে। স্বর্ণ না এনে বিদেশ ফেরৎ যাত্রীরা বৈদেশিক মুদ্রা আনলে তা ব্যাংক ব্যবস্থায় যুক্ত হতো। বিপরীতে এখন যেভাবে স্বর্ন ঢুকছে এবং বেরোচ্ছে তাতে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে।
যাত্রীরা (অপর্যটক) ব্যাগেজ বিধিমালা অনুযায়ী, বিদেশ থেকে আসার সময় একজন যাত্রী ২৩৪ গ্রাম বা ২০ ভরি সোনার বার শুল্ক-কর পরিশোধ করে আনতে পারেন। প্রতি ভরিতে শুল্ক-কর দিতে হয় দুই হাজার টাকা। সাধারণত দুটি বারেই ২৩৪ গ্রামের কাছাকাছি ওজন হয়।
বিনা শুল্কে যাত্রীরা ১০০ গ্রাম বা সাড়ে আট ভরি পর্যন্ত সোনার গয়না আনতে পারেন। এই গয়নার হিসাব কাস্টমস্ নথিভুক্ত করে না। ২০২২ সালে যে ৪৫ হাজার কোটি টাকার সোনা এসেছে, তার মধ্যে এই গয়না নেই। ভরিতে ২০০০ টাকা শুল্ক পরিশোধ করে স্বর্ণ আনলেও বাংলাদেশের বাজারের সাথে প্রতি ভরিতে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার পার্থক্য থেকে যায়।
বাংলাদেশে যাত্রীদের হাত ধরে সোনার বেশির ভাগই আসে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। কোনো কোনো যাত্রী নিজে থেকেই সোনার বার নিয়ে আসেন। অনেক সময় সোনা পাচারকারীর প্রতিনিধিরা বাংলাদেশগামী যাত্রীদের বৈধ পথে দুটি সোনার বার বহন করার জন্য অর্থ দিয়ে থাকে। বিমানবন্দরে শুল্ক পরিশোধ করার পর যাত্রীদের কাছ থেকে তা নিয়ে নেওয়া হয়। ঝুঁকি না থাকায় এবং আয়ের অতিরিক্ত সুযোগ থাকায় যাত্রীরা সোনা বহনে আগ্রহ দেখিয়ে থাকে। ফলে এই আইনটি নিয়েই এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
তথ্য-উপাত্ত বলছে, সোনা আনা বাড়ছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে শুল্ক কমানোর পর। ওই অর্থবছরে যাত্রী (অপর্যটক) ব্যাগেজ বিধিমালার আওতায় সোনা আনার ক্ষেত্রে ভরিপ্রতি শুল্ক এক হাজার টাকা কমিয়ে দুই হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়।
দুই বিমানবন্দরের তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ সালে সাড়ে ৫ টন, ২০২১ সালে ৩৫ টন ও ২০২২ সালে প্রায় ৫৪ টন সোনা এসেছে। উল্লেখ্য, ৫৪ টনে প্রায় ৪৬ লাখ ভরি স্বর্ণ হয়।
২০২০ সালে করোনার কারণে উড়োজাহাজে যাত্রী পরিবহন কম হয়েছিলো। ঐ বছর ২৩ হাজার ৬৭৪ জন, ২০২১ সালে ১ লাখ ৫১ হাজার ৯১৭ জন ও ২০২২ সালে প্রায় ২ লাখ ৩২ হাজার জন যাত্রী ব্যাগেজ নীতিমালার আওতায় সোনা বাংলাদেশে এনেছিলো।
সোনা ঢোকার পথটি মোটামুটি দৃশ্যমান হলেও সোনা বেরিয়ে যাওয়ার পথের প্রায় পুরোটাই অদৃশ্য। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল ২০১৭ সালে ভারতের সোনার বাজারবিষয়ক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ভারতের সরকার সোনা আমদানি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়ার পর ২০১৩ সাল থেকে অবৈধ পথে দেশটিতে সোনা পাচার বাড়তে থাকে। প্রতিবছর ১০০ টনের মতো সোনা পাচার হয় ভারতে। এর উৎস বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীন। ২০২১ সালের প্রতিবেদনেও মিয়ানমার ও চীনের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে ভারতে সোনা পাচারের কথা উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
স্বর্ণ পাচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রুট হচ্ছে খুলনা। মূলত ঢাকা থেকে খুলনা হয়েই সাতক্ষীরা এবং যশোর সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণ ভারতে ঢোকে। ভারত থেকে স্বর্ণ অলংকার হয়ে বাংলাদেশে আসেও একই পথে। এক্ষেত্রে পুরো বিষয়টিই আসলে গোপন এবং অবৈধ। কাস্টমস্ জড়িত থাকলেও এক্ষেত্রে প্রধান সহযোগিতাকারী মূলন্ত দুই দেশের সীমান্তরক্ষীরা। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিষয়টি কাস্টমস্ পর্যন্ত পৌঁছায় না। কাস্টমস্ কর্মকর্তারাও তাদের ভাগ কোনো-না-কোনোভাবে পেয়ে যায়, ফলে এটি নিয়ে তাদেরও বিশেষ কোনো মাথাব্যথা নেই।
প্রতিবেদন বলছে— ভারতেও বিভিন্ন দেশ থেকে অবৈধ পথে স্বর্ন প্রবেশ করে, তবে সেটি গয়না হয়ে আবার বিদেশে রপ্তানিও হয়। কিন্তু বাংলাদেশ এক্ষেত্রে শুধুমাত্রই একটা রূট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ কোনো দেশেই সোনার গয়না রপ্তানি করে না, বরং ভারত থেকে আমদানী করে, তাও বিশেষত অবৈধ পথে। এক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে— বাংলাদেশে আভ্যন্তরীণভাবে স্বর্ণ (গয়না) কেনাবেঁচা করে যতটুকু ব্যবসা হয়, তার চেয়ে অনেক বড় ব্যবসা হয় স্বর্ণ পাচার, মজুদ এবং এ সংক্রান্ত বিষয়গুলো সমন্বয় করে।
সার্বিক বিবেচনায় বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বিদেশ ফেরৎ যাত্রীরা ব্যবহারের জন্য কিছু গয়না আনতে পারলেও সোনার বার আনার অনুমতি থাকবে কিনা। এ ধরনের আইকেই অর্থনীতিবিদরা ‘বেআইন’ বলে দাবী করেছেন। অপরদিকে কাস্টমস্-এর দাবী ভারতের সাথে সোনার বার এবং গয়নার যে চোরাচালান হয়, সেটির সাথে কাস্টমস্ জড়িত নয়। এটি হয় সীমান্তের বিভিন্ন চিহ্নিত/অচিহ্নিত অঞ্চল দিয়ে।