শিরোনামটি শুনে অনেকে চমকে ওঠার কথা। মাছের চেয়ে মাছের আঁশ রপ্তানি করে আসলেই কি বেশি আয় হতে পারে?পরিসংখ্যান দেখলে সেটি অবশ্য বিশ্বাস হওয়ার কথা নয়, তবে ভবিষ্যত চিন্তা করলে সেটি অবশ্যই সম্ভব। বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে মাছ রপ্তানি হয় পঞ্চাশটিরও বেশি দেশে এবং এ খাত থেকে আয় হয় চার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি। সে হিসেবে মাছের আঁশ একেবারেই মূল ধারার কিছু নয়। ফলে এই তুলনাটি বেমানান মনে হতে পারে। আসলে বিষয়টি বুঝতে হলে মাছের আঁশের বিদ্যমান এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ব্যবহার সম্পর্কে জানতে হবে। বাংলাদেশ থেকে এখন সাত আটটি দেশে দুইশো কোটি টাকার কিছু বেশি মূল্যের মাছের আঁশ রপ্তানি হয়। ফলে এ প্রশ্নটি জাগতেই পারে যে, আসলেই কি মাছের আঁশ থেকে রপ্তানি আয় মাছের রপ্তানি আয়কে ছাড়িয়ে যেতে পারে? পারে। বিষয়টি বুঝতে হলে আগে জানতে হবে মাছের আঁশ থেকে কী কী পণ্য উৎপাদিত হয়, এবং সেসব কী কাজে লাগে। ভবিষ্যতে মাছের আঁশ আরো কী কী কাজে লাগতে পারে।
প্রথমেই বুঝতে হবে যে, মাছের আঁশ একটি বায়োডিগ্রেডেবল পণ্য। মাছের আঁশের প্রধান দু’টি উপাদান হচ্ছে কোলাজেন এবং হাইড্রোক্সিপাটাইট। মাছের আঁশ থেকে কোলাজেন এবং জিলেটিন উৎপাদিত হয়। মাছের আঁশের গঠন মানুষের শক্ত টিস্যুর মতো, যা টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং, জৈবিক ভরাট, চিকিৎসা কাজে ব্যবহৃত তন্তু, এবং অপারেশনের আরো বিভিন্ন অংশবিশেষ হিসেবে, এছাড়া প্রক্রিয়াকরণ এবং নমনীয় ইলকেট্রনিক্স সহ এ ধরনের সম্ভাব্য অ্যাপ্লকিশেনগুলোর জন্য মাছের আঁশ খুবই উপযোগী। এতসব মূল্যবান ব্যবহারের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মাছের আঁশ এখনো এসব কাজে খুব বেশী ব্যবহৃত হয় না। অর্থাৎ এখনো খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে এসব কাজে মাছের আঁশ ব্যবহৃত হচ্ছে। সম্ভাবনা তাহলে আসলে ঠিক কতখানি? পৃথিবীতে এখন সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের সার্জিক্যাল সাচারের ব্যবহার রয়েছে। ২০৩২ সালে এটি সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। এই বাজারটি যেসব কোম্পানির দখলে তাদের মধ্যে অ্যাডভান্সড মেডিকেল সলিউশনস গ্রুপ পিএলসি (ইউকে), ইন্টারন্যাশনাল ফার্মাসিউটিকা এসএডি সিভি (মেক্সিকো), মেডট্রনিক পিএলসি (আয়ারল্যান্ড), জনসন অ্যান্ড জনসন (ইউএস), বি. ব্রাউন মেলসুঞ্জেন (জার্মানি), স্মিথ অ্যান্ড নেফেউ (ইউকে), ডেমে টেক কর্পোরেশন ( ইউএস), সার্জিক্যাল স্পেশালিটিস কর্পোরেশন (ইউএস), বোস্টন সায়েন্টিফিক কর্পোরেশন (ইউএস), পিটার্স সার্জিক্যাল (ফ্রান্স), ডলফিন সেউচার (ভারত), ডার্মা সায়েন্সেস (ইউএস), কনমেড কর্পোরেশন (ইউএস), সাটকন সেউচারস (ইন্দোনেশিয়া), স্ট্রাইকার কর্পোরেশন (ইউএস), হিলথিয়াম মেডটেক (ভারত), জিমার বায়োমেট (ইউএস), জিপিএস মেডিকেল (ভারত), লোটাস সার্জিক্যালস্ (ভারত), ভিটাল সাচারস্ (ইউএস), সিপিটি সাচারস্ (ভারত), ইউনিলিন (ভারত), মেলোন মেডিক্যাল (নেদারল্যান্ডস), রিভারপয়েন্ট মেডিকেল (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) অন্যতম। এই সাচারগুলো ব্যবহৃত হয় কার্ডিওভাসকুলার সার্জজারি, অর্থোপেডিক সার্জারি, গাইনোকোলজিক্যাল সার্জারি, অপথালমোলজিক্যাল সার্জারি, জেনারেল সার্জারি এবং অন্যান্যক্ষেত্রে।
এক্ষেত্রে কোলাজেন একটি গুরত্বপূর্ণণ উপাদান। মাছের কোলাজেনকে স্তন্যপায়ী কোলাজেনের একটি সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে অন্বেষণ করা হচ্ছে, কারণ, এর দাম কম, এবং কোনো জুনোটিক ঝুঁকি নেই। ফিশ স্কেল হচ্ছে উচ্চ যান্ত্রিক শক্তি সহ একটি বহুস্তর প্রাকৃতিক কোলাজেন সংমিশ্রণ, কিন্তু মাছের কোলাজেনের নিম্ন বিকৃত তাপমাত্রার কারণে এখন জৈব চিকিৎসায় এর প্রয়োগ সীমিত। তবে যেহেতু পরীক্ষা নীরিক্ষা অব্যাহত রয়েছে ফলে কিছুটা মডিফাইড হয়ে দ্রুতই এটা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হবে। যেমনঃ ঘাড়ের রোটেটর কাফ ছিঁড়ে গেলে সেটি মেরামত করার জন্য কোলাজেন ব্যবহৃত হয়। মুশকিল হচ্ছে- পোস্টঅপারেটিভ জটিলতায় প্রায়শই সেটি ছিঁড়ে যায়। সমস্যার সমাধান হিসেবে মাছের আঁশের কোলাজেনের কথা ভাবা হচ্ছে। চিকিৎসাবিদ্যা এবং বাণিজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাছের আঁশের ব্যবহারের সম্ভবনা তাই বিবিধভাবে বাড়ছে। যেসব ক্ষেত্রে বিস্তৃত পরিসরে মাছের আঁশের কোলাজেন ব্যবহৃত হতে পারে- বোন রিপেয়ার, সেল স্কাফোল্ড, কার্টিলেজ রিপেয়ার, কর্নিয়া রিজেনারেশন, ইরেকট্রোক্যাটালাইসিস, এডসরপশন. সিউয়েজ, বায়োলজিক্যাল ফিলিং ইত্যাদি। সার্জারিবিদ্যা এবং চিকিৎসাবিদ্যার বিভিন্ন অংশে ব্যবহারের পাশাপাশি প্রসাধনী, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং বায়োপ্লাস্টিকস-এর মতো বিভিন্ন শিল্প প্রয়োগের জন্য মাছের আঁশের ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে, তাদের অনন্য বৈশিষ্ট্য এবং জৈব অবনমনযোগ্যতার কারণে। উপরন্তু, মাছের স্কেল আহরণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নির্মাতাদের উচ্চ-মানের এবং মূল্য-সংযোজন পণ্য উত্পাদন করতে সক্ষম করে। পাশাপাশি মাছের স্কেল কারুশিল্প, গয়নাশিল্প এবং বিভিন্ন পরিবেশ-বান্ধব পণ্য উৎপাদনের জন্য একটি চমৎকার কাঁচামাল। মাছের আঁশের বাজারটি এই মুহূর্তে কতটা বড় সেটি বলা কঠিন। কারণ, বাজারটি একত্রে মাছের কোলাজেনের বাজার হিসেবে বিবেচিত হয়। এখন এটি পনেরোশো মিলিয়ন ইউএস ডলার, এবং ২০৩২ সাল নাগাদ এটি দুই হাজার মিলিয়ন ইউএস ডলারে দাড়াবে। অর্থথাৎ বাজারটির আয়তন দুই লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। পৃথিবীতে মাছ উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশর অবস্থান চতুর্থথ, তাহলে অন্তত দশ হাজার কোটি টাকার ফিশ কোলাজেন কি বাংলাদেশ রপ্তানি করতে পারবে না? তবে বাংলাদেশ মূলত কোলাজেন আমদানি করে। বিষয়টি হচ্ছে- কাঁচামাল থেকে কোলাজেন প্রক্রিয়াজাত করতে বাংলাদেশ পারে না। অর্থাৎ বাংলাদেশকে শুধু কাঁচামাল রপ্তানি করলে হবে না, কোলাজেন প্রক্রিয়াজাতকরণ প্লান স্থাপন করতে হবে। কাঁচামাল রপ্তানির কথাও যদি ধরি, তাহলে এখনো বেশিরভাগ বাজার থেকে এব্ং গৃহস্থালি থেকে মাছের আঁশ সংগ্রহ করা হয় না। বেশিরভাগ মাছের আঁশ এখনো নষ্ট হয়। এখনো বলতে গেলে বিচ্ছিন্নভাবে মাছের আঁশ রপ্তানি হচ্ছে। পুরো বিষয়টিকে একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে আনতে পারলে দ্রুতই এ সেক্টর থেকে হাজার কোটি টাকা রপ্তানি আয় আনা সম্ভব। এখন পর্যযন্ত ঢাকা সহ মূলত বড় কয়েকটি শহর থেকে মাছের আঁশ সংগ্রহ করা হয়, যেটি বাংলাদেশে মোট উৎপাদিত মাছের আঁশের তুলনায় একটি ছোট অংশ। বাজার পর্যায়ে এখন প্রতি কেজি মাছের আঁশ সংগ্রহ করা হচ্ছে কম বেশী ৫০ টাকা দরে, যেটি বিশ্ববাজারের তুলনায় যথেষ্ট কম। বাংলাদেশ থেকে এখন আঁশ রপ্তানি হয় আড়াই হাজার টনের মতো। চেষ্টা করলে এটিকে দ্রুতই দশ হাজার টনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন প্রতিশ্রতিশীল উদ্যোক্তা। জাপান, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো এ আঁশ কিনে থাকে। দেশের সংখ্যা আরো বাড়ানো সম্ভব।
যেভাবে সংগ্রহ করা হয়ঃ স্থানীয়ভাবে মাছের আঁশ সংগ্রহ, সংরক্ষণ করা হয়। পরে প্রক্রিয়াজাতকরণের অংশ হিসেবে এসব আঁশ শুকানো হয়। এরপর চালুনিকরণ, অন্যান্য বস্তু অপসারণ, অবমুক্তকরণ, শ্রেণীবিন্যাসকরণ করা হয়। চুন বা ক্যালসিয়াম জাতীয় পদার্থও অপসারণ করা হয়। এরপর আমদানিকারকের চাহিদা অনুযায়ী প্যাকেটজাতকরণ করা হয়। সর্বশেষ রফতানিকারক কর্তৃক পণ্য রফতানি করা হয়।
পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে প্রথম ধাপটি শুরু হয় মাছ কাঁটার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি কর্তৃক স্বউদ্যোগ থেকে। সংগ্রহের পর এসব আঁশ সংরক্ষণকারীর কাছে করে বিক্রয় করা হয়। সংরক্ষণকারী হাত বদল করে বাজারজাতকারী ব্যবসায়ী বা রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের মনোনীত এজেন্টের কাছে। এই এজেন্ট বা ব্যবসায়ীই মূলত রফতানিকারকের গুদামে মাছের আঁশ সরাসরি সরবরাহ করে।
বড় হচ্ছে রফতানির বাজারঃ মাছের আঁশ সাধারণত চীনে রফতানি করা হয়। প্রক্রিয়াজাতকালে ৫০ শতাংশ প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে প্রতি কেজি মাছের আঁশ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় ১.৯ থেকে ২ ডলারে রফতানি হচ্ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাছের আঁশের রফতানি মূল্য ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ দুই কোটি ৯৩ লাখ ২৫ হাজার ডলার।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ২ হাজার ডলার বা চার কোটি ২৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রফতানি আয়ের পরিমাণ আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ লাখ ৯০ হাজার ডলার বা ২৬ কোটি ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রফতানি আয় বেড়ে ৩০ কোটিতে উন্নীত হয়। বর্তমানে এ বাজার ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তবে সম্ভাবনাটি আরো অনেক বড়।
রফতানিতে যেসব সুবিধাঃ অপ্রচলিত পণ্য হওয়ার কারণে মাছের আঁশ রফতানিতে বেশ কিছু সুবিধা দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে আয়কর ও উৎসে আয়কর রেয়াত সুবিধা, বন্ডেড ওয়্যারহাউস, ডিউ্যটি ড্র ব্যাক, ব্যাক টু ব্যাক এলসি, ব্যাংক ঋণপ্রাপ্তি ও স্বল্প সুদ সুবিধা এবং রফতানি ঋণ গ্যারান্টি স্কীম সুবিধা।
সংগ্রহের বর্তমান ও ভবিষ্যৎঃ বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন তাদের সমীক্ষায় দেখিয়েছে, প্রতিদিন ২৫ টন মাছের আঁশ সংগ্রহ করা হচ্ছে। বর্তমানে রফতানিকারক কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন বিভিন্ন বাজার থেকে ১০ টন করে মাছের আঁশ সংগ্রহ করে থাকে। এতে প্রতি মাসে ৩০০ টন মাছের আঁশ রফতানির জন্য প্রস্তুত করা হয়।
তবে স্থানীয় বাজারে পাওয়া মাছের আঁশ সম্পূর্ণরূপে রফতানি উপযোগী করা গেলে এর পরিমাণ দাঁড়াবে প্রতি মাসে ৭৫০ টন। স্থানীয়ভাবে এর মূল্য সংযোজনের হার ৯৩. ৫০ শতাংশ।
চ্যালেঞ্জ কীঃ কৃষি শুমারি ২০০৮-এর হিসাব বলছে, দেশে পরিবারের সংখ্যা দুই কোটি ৮৬ লাখ ৯৫ হাজার ৭৬৩টি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর দেশে এ পরিমাণ পরিবারের মাছের চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন ৩৮ লাখ টন মাছের। এসব মাছের অন্তত ৪০ শতাংশের বহিরাবরণই আবৃত থাকে রুপালি আঁশে।
কাঁটার সময় এ আঁশ ছাড়ানো হয়। তবে কেনার পর খুব কমসংখ্যক বাজার থেকে মাছ কেটে বাসায় আনে।
সাধারণত বেশিরভাগ পরিবার পর্যায়ে মাছের এই আঁশ উচ্ছিষ্টাংশ বা বর্জ্য হিসেবে ভাগাড়ে ডাম্পিং করে থাকে। ফলে এর অর্থমূল্য মিলে না। এভাবে প্রতি বছর কী পরিমাণ মাছের আঁশ বর্জ্য হিসেবে ডাম্পিং হচ্ছে। তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান এখনো মেলেনি। ফলে চুল সহ অন্যান্য দ্রব্য হকাররা যেভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করে এক্ষেত্রেও সেটি প্রয়োজন। প্রতি মাসে গৃহিণীদের জমানো মাছের আঁশ কিনে নিলে বাৎসারিক সংগ্রহের পরিমাণ হতে পারে কয়েক লক্ষ্ টন।
আগেই বলা হয়েছে- মাছের আঁশ থেকে কোলাজেন ও জেলাটিন পাওয়া যায়, যা ওষুধ, প্রসাধনসামগ্রী ও সম্পূরক খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। ফলে মাছের আঁশ রপ্তানির পাশাপাশি বাংলাদেশে প্রক্রিয়াজাত করতে পারলে রপ্তানি আয়টি আরো অনেক বেড়ে যেত, বা এক্ষেত্রে আমদানী নির্ভভরতা কমতো। উল্লেখ্য, জিলেটিন এবং কোলাজেন বাংলাদেশ আমদানী করে থাকে।