করোনাকালেও থেমে নেই আফগানিস্তানে জঙ্গি হামলা

bamian

আফগানিস্তানে এত বেশি জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে যে, এগুলোকে বছর হিসেবে তালিকাবদ্ধ না করে মাস হিসেবে তালিকাবদ্ধ করে উইকিপিডিয়া। করোনা মহামারির সময়েও শুধু অক্টোবর মাসেই আফগানিস্তানে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে ২৭টি। নিহত হয়েছেন তিন শতাধিক, আহত হন সহস্রাধিক মানুষ। সেপ্টেম্বর মাসে হামলার ঘটনা ঘটেছে ৩০টি, নিয়ত হয়েছেন শতাধিক। শুধু রাজধানী কাবুলেই ২০২০-এ জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে ২১টি। গত দশ বছরে আফগানিস্তানে সর্বাধিক জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে ২০১৮ সালে। ২০১৮-এ শুধু রাজধানী কাবুলে হামলার ঘটনা ঘটেছে ২৫টি। এছাড়াও পুরো বছর জুড়ে আফগানিস্তানে জঙ্গি হামলার বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। ২০২০-এ করোনাকালীন সময়ে এসেও একই ধারা অব্যাহত রয়েছে। কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিকের এ সময়ে সবকিছু স্থবির হয়ে গেলেও আফগানিস্তানে জঙ্গি হামলা থেমে নেই।

১২ মে (২০২০) আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের এক হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে জঙ্গি হামলায় দুই শিশু সহ ১৬ জন নারী নিহত হয়। কোনো জঙ্গি গোষ্ঠী দায় স্বীকার না করলেও আফগানিস্তান সরকার মনে করছে জঙ্গি গোষ্ঠী তালেবান এই হামলার জন্য দায়ী।
একই দিন পূর্বাঞ্চলীয় নানগাহার প্রদেশে পৃথক আরেকটি হামলার ঘটনা ঘটে। এক পুলিশ কমান্ডারের জানাজায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় অন্তত ৩০ জন নিহত ও শতাধিক আহত হন। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) আফগানিস্তান শাখা ইসলামিক স্টেট খোরাসান নানগাহারের হামলার দায় স্বীকার করে বলে সাইট ইন্টেলিজেন্স গোষ্ঠী জানায়।
৬ মার্চ (২০২০) কাবুলে নির্মাণাধীন একটি ভবন থেকে দু’জন বন্দুকধারীরা গুলি চালালে ৩২ জন মারা গিয়েছিল এবং আহত হয়েছিল শতাধিক। আফগান শিয়া নেতা আবদুল আলী মাজারীর তালেবান কর্তৃক হত্যার ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানে এই ঘটনা ঘটে।
২৫ মার্চ (২০২০), আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে শিখ সম্প্রদায়ের উপাসনালয় গুরুদুয়ারায় জঙ্গি হামলা হয়। সকালে উপাসনালয়ে প্রার্থনার সময় সশস্ত্র এক জঙ্গি প্রায় দেড়শ ব্যক্তিকে জিম্মি করে। এরপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলে ২৫ জন নিহত, আহত হন অনেকে। নিহতদের বেশিরভাগই ছিলেন নারী ও শিশু। নারীরা শিশুদের নিয়ে প্রার্থনা করতে এসেছিলেন। জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস এই হামলার দায় স্বীকার করে। এর আগে ২০১৮ সালে নাঙ্গারহার প্রদেশে আইএস হামলায় কমপক্ষে ১৯ জন নিহত হয়েছিল, যাদের মধ্যে শিখ সম্প্রদায়ের লোকই বেশি ছিল।
বর্তমানে রাজধানী কাবুল ছাড়াও নাঙ্গারহার ও দক্ষিণ-পূর্বে গানিজ প্রদেশে সব মিলিয়ে শিখ সম্প্রদায়ের হাজারখানেক মানুষ অবশিষ্ট রয়েছেন। করোনাভাইরাসের কারণে আফগানিস্তানও সংকটে পড়েছে। সরকার ও প্রশাসন যখন পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, এরই মধ্যে পাকিস্তানের মদদপুষ্ঠ আইএস এবং তালেবান জঙ্গি গোষ্ঠী হিংসাত্মক কার্যকলাপে মেতে উঠেছে।

হামলা বেড়েছে পাহাড়ি অঞ্চল বামিয়ানে

২৪ নভেম্বর (২০২০) আফগানিস্তানের বামিয়ান শহরে জোড়া বোমা হামলায় অন্তত ১৭ জন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হয়েছেন। বামিয়ান শহরে বেশিরভাগই শিয়া হাজারা মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস।

গত কয়েক বছর ধরে বহুবার আফগানিস্তানে শিয়া হাজারা মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন হামলার শিকার হয়েছেন। গত মে মাসে রাজধানী কাবুলে হাজারা সম্প্রদায়ের একটি আবাসিক এলাকার মা ও শিশু হাসপাতালে উগ্র সন্ত্রাসীরা দিনের বেলায় হামলা চালিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটায় এবং তাতে কয়েকজন মা ও শিশু নিহত হন। (উপরে উক্ত)

বামিয়ানের জোড়া বুদ্ধমূর্তি

জোড়া বুদ্ধ মূর্তি
তালেবানদের উপড়ে ফেলা বড় বুদ্ধ মূর্তিটি ছাড়াও আফগানিস্তানের বামিয়ানে রয়েছে পাহাড়ে খোদাই করা এই জোড়া বুদ্ধ মূর্তি।

বৌদ্ধধর্ম ছিল প্রাক-ইসলামি আফগানিস্তানের অন্যতম প্রধান ধর্ম। বৌদ্ধ ধর্ম হিন্দুকুশ পর্বতমালার দক্ষিণে ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল। খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে ইসলামের আবির্ভাবের পর এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের পতন শুরু হয়। খ্রিস্টীয় ১১শ শতাব্দীতে গজনবিদের রাজত্বকালে তা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়। বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারিরা অন্যত্র চলে যায়, সুফী ইসলামে অনুপ্রাণিত অথবা ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হলেও রয়ে যায় বৌদ্ধ সংস্কৃতি এবং অসংখ্য বৌদ্ধমূর্তি। বিভিন্ন সময়ে তা ধ্বংসের মুখে পড়েছে– কখনো সংস্কারের অভাবে, কখনো ভেঙে ফেলা হয়েছে। আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ঐতিহ্য এবং পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ ছিল বিশেষ এক বুদ্ধমূর্তি। পাহাড়ের খাঁজ কেটে তৈরি করা বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা বুদ্ধমূর্তিকে দেখতে ছয়ের দশকের হিপি আন্দোলনের সময় থেকে পাশ্চাত্ত্যের ভ্রামণিকরা ভিড় করত সেখানে। কিন্তু তালেবানরা যখন আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ছিলো সে সময় ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ভেঙ্গে ফেলে মূর্তি দু’টোকে।

বামিয়ান শহর

বামিয়ান শহর আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশের প্রধান শহর ও রাজধানী। আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে এটি অন্যতম। দেশের রাজধানী কাবুল থেকে ২৩০ কিলোমিটার উত্তরপশ্চিমে বামিয়ান উপত্যকায় এই শহরটি অবস্থিত। বর্তমান জনসংখ্যার হিসেবে শহরটি যথেষ্ট ছোট হলেও, এর ইতিহাস সুপ্রাচীন। তাছাড়া শহরটির বিশেষ অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব রয়েছে। হিন্দুকুশ পর্বতমালা ও তারই একটি শাখা, সুউচ্চ কো-ই-বাবা পর্বতমালার সংযোগস্থলে দুই পর্বতমালার মধ্যবর্তী উপত্যকায় বামিয়ান শহরের অবস্থান। উত্তরে ও দক্ষিণে শহরটি তাই দুই পর্বতমালার প্রায় ১৫০০০ ফিট উঁচু বরফঢাকা শৃঙ্গগুলি দিয়ে ঘেরা। 

শহরের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে বামিয়ান নদী। সমগ্র উপত্যকার মূল নদী এটিই। শহরের ঠিক পাশেই অবস্থিত সুবিখ্যাত বামিয়ানের ঐতিহাসিক পর্বতগাত্রটি, ২০০১ সালের মার্চ মাসে তালিবানদের হাতে ধ্বংস হওয়া প্রায় ১৫০০ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক বুদ্ধমূর্তিদুটি, অসংখ্য কৃত্রিম গুহা ও বৌদ্ধ মঠের কল্যাণে বামিয়ান পৃথিবীবিখ্যাত, এবং আফগানিস্তানে পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ।

বড় বুদ্ধি মূর্তি
ধ্বংসের আগে ও পরে বামিয়ানের বড় বুদ্ধমূর্তি
জোড়া বুদ্ধ মূর্তি
২০১২ খ্রিষ্টাব্দে তোলা বামিয়ান উপত্যকার ছবি। ছবিতে পাহাড়ের গায়ে তালেবানদের হাতে ধ্বংস হওয়া বড় বুদ্ধমূর্তিটির ফাঁকা জায়গাটি দৃশ্যমান।