উইঘুর নির্বাসিতরা ৮ জুলাই ২০২০ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্তের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে, এটি মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টিকে জবাবদিহি করার জন্য আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগের প্রথম প্রচেষ্টা।
কম্বোডিয়া এবং তাজিকিস্তান থেকে বেআইনীভাবে গ্রেপ্তার বা নির্বাসনের মাধ্যমে কযেক হাজার উইঘুরকে প্রত্যাবাসন করার জন্য বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে লন্ডন ভিত্তিক দুই আইনজীবী দলের একটি দল এ অভিযোগ করেছে। এই মামলাটির প্রেক্ষিতে সীমানা ছাড়িয়ে ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়ার জন্য চীনের রাষ্ট্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্তর্জাতিক তদন্ত হতে পারে।
আইনজীবীদের ৮০-পৃষ্ঠার ফাইলিংয়ে ৩০ টিরও বেশি চীনা কর্মকর্তাদের একটি তালিকা রয়েছে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শি জিনপিং সহ। মিঃ শি’র সাম্প্রতিক বছরগুলিতে নীতিগুলি চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াংয়ের মুসলিম সংখ্যালঘুদের নজরদারি, আটককরণ এবং তাদের সামাজিক কর্মকাণ্ড কাঠামোবদ্ধ করতে বিশেষ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক বিস্তৃত জালের নিচে রেখেছে। প্রায় দশ মিলিয়ন জাতিগত উইঘুর এবং অন্যান্য মুসলিম সংখ্যালঘু সদস্যরা এই অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ শিবিরে অন্তরীণ রয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী নিন্দার বিষয় হয়েছে (নিউইয়র্ক টাইমস্, ৬ জুলাই ২০২০)।
আন্তর্জাতিক আদালতের নিয়ম অনুযায়ী গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং অন্যান্য নৃশংসতার শিকার বিশ্বের যে কোনো গোষ্ঠী বিচার চাইতে পারে, তবে চীন আন্তর্জাতিক আদালতের এ এখতিয়ারকে স্বীকৃতি দেয় না এবং এ কারণে এ মামলাটি কতদূর যাবে সে প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছে।
এই মামলার নেতৃত্ব দিচ্ছেন একজন ব্রিটিশ আইনজীবী— রডনি ডিকসন বলেছেন, আদালতের সদস্য দুটি দেশ কম্বোডিয়া এবং তাজিকিস্তানে চীন কর্তৃক বেআইনী আচরণের দাবির প্রতি মনোনিবেশ করে বেইজিংয়ের ওপর এখতিয়ারের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালত বাতিল করে দিয়েছে।
“বিষয়টি একটি সমালোচনার ক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে, কারণ এত দিন ধরে ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, আন্তর্জাতিক আদালতে চীনকে জবাবদিহি করার জন্য কিছুই করা যায় না।” মিঃ ডিকসন হেগ ভ্রমণ করার আগে লন্ডন থেকে টেলিফোনে নিউেইয়র্ক টাইমস্ পত্রিকাকে বলেছিলেন ।
আদালতের ২০১৮ সালের একটি রায়কে উদ্ধৃত করে মিঃ ডিকসন বলেন, “আদালত বলেছে যে, কোনও সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে অপরাধ শুরু বা শেষ হলে আদালতের এখতিয়ার রয়েছে এ ধরনের মামলা আমলে নেওয়ার, এবং এই বিবেচনায় চীনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলাটি প্রাসঙ্গিক।
২০১৮-এ একই ধরনের এখতিয়ার মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়েছিল, যারাও আন্তর্জাতিক আদালতের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। আদালত রায় দিয়েছে যে, তারা মিয়ানমারকে ‘নির্বাসিত’ হতে বাধ্য করা এবং বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাথে সম্পর্কিত অপরাধের জন্য মামলা পরিচালনা করতে পারে, কারণ, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতের সদস্য।
চীনের বিরুদ্ধে যে দুটি উইঘুর দল অভিযোগ দায়ের করেছে, তারা হলো “প্রবাসের পূর্ব তুর্কিস্তান সরকার” এবং “পূর্ব তুর্কিস্তান জাতীয় জাগরণ আন্দোলন”। গোষ্ঠীগুলি জিনজিয়াংয়ের স্বাধীনতার পক্ষে। জিনজিয়াং এমন একটি অঞ্চল যেটিকে তারা এর সরকারি চীনা নাম ‘জিনজিয়াং’ নামে চিনতে চায় না, বরং তারা ‘পূর্ব তুর্কিস্তান’ নামে পরিচিত হতে চায়, কারণ, এটাই তাদের প্রস্তাবিত উইঘুর প্রজাতন্ত্রের নাম।
জনাব ডিকসন আরও বলেছেন, “রাষ্ট্রপক্ষেও নিরব গণহত্যা তদন্ত করা দরকার। আপনি যদি লোকদের ধরপাকড় করেন এবং তাদের দমন করার জন্য আপনার একটি প্রচারণা থাকে এবং আপনি তাদের নির্বীজ (খোজা) করেন, তবে এটি একটি অপরাধ।”
এ অভিযোগ সম্পর্কে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে জিনজিয়াংয়ের সংখ্যালঘুদের ব্যাপক নির্যাতনের প্রমাণ চীন সরকার বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে।
“জিনজিয়াং ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতার নীতি পুরোপুরি প্রয়োগ করে”, মন্ত্রণালয়ে পক্ষ থেকে গত সপ্তাহে এই মামলাটি দায়ের হওয়ার আগে চীনের মানবাধিকার রেকর্ডের সাম্প্রতিক সমালোচনার প্রেক্ষিতে বলেছিল। তারা বলেছিল, “জিনজিয়াং কখনও উইঘুর বা অন্য কোনও নৃগোষ্ঠীর লোকদের ভ্রমণের স্বাধীনতা হ্রাস করেনি।”
সরকারি পরিসংখ্যান, রাষ্ট্রীয় নথি, সাবেক বন্দি, পরিবারের সদস্য এবং ডিটেনশন ক্যাম্পের সাবেক পরামর্শকের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে নিচের এই অনুসন্ধান চালিয়েছে মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি। তবে একে ‘ফেইক নিউজ’ আখ্যা দিয়েছে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে হোটান ও কাশগরের বেশিরভাগ উইঘুর অঞ্চলে জন্মহার ৬০ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে, ২০১৮ সালে চীন সরকার সর্বশেষ জরিপ পরিচালনা করে, সে অনুযায়ী। পুরো জিনজিয়াং অঞ্চলজুড়ে জন্মহার হ্রাস পেয়েছে, যা গত এক বছরের ২৪%। দেশজুড়ে এ হ্রাসের হার যেখানে মাত্র ৪.২%। জেনজের প্রাপ্ত বাজেটের নথিতে দেখা যায় যে, ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জিনজিয়াং সরকার জন্ম নিয়ন্ত্রণের শল্যচিকিত্সার প্রোগ্রামে লক্ষ লক্ষ মিলিয়ন ডলার, এবং মহিলাদের নির্বীজ হওয়ার জন্য নগদ প্ররোচনার কাজ শুরু করেছিল। যদিও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে নির্বীজননের হার হ্রাস পেয়েছিল, কিন্তু জিনজিয়াং-এ ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত এ হার সাতগুণ বেড়ে ৬০০,০০০-এরও বেশি হয়েছে। উইঘুর সংখ্যাগরিষ্ঠ শহর হোটান ২০১৯ সালে ১৪,৮৭২ টি নির্বীজকরণের জন্য বাজেট করেছিল, যা সন্তান জন্মদানের বয়সী সমস্ত বিবাহিত মহিলার ৩৪%-এরও বেশি (নিউইয়র্ক টাইমস্, জুন ২৯, ২০২০)।
ডয়েচে ভেলের তথ্য মতে ২০০৯ সালে ভয়াবহ এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল শিনজিয়াং-এর রাজধানী উরুমকুই শহরে। তাতে কমপক্ষে ১৪০ জন নিহত এবং কয়েকশো মানুষ আহত হয়েছিল। অসংখ্য ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর পাঁচ বছর পর, অর্থাৎ ২০১৪ সালে অপর এক সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয় ৩১ জন। উইঘুর মুসলমানদের ওপর সরকারের কঠোর নজরদারি এবং দমন-পীড়ন-নির্যাতন তখন থেকে বিভিন্ন মাত্রা পেয়েছে।
উইঘুররা এই অঞ্চলের সরকারিভাবে স্বীকৃত ৫৬টি নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অন্যতম। উইঘুর অঞ্চলের পূর্বের নাম ছিল পূর্ব-তুর্কিস্তান, চীন সরকার এ অঞ্চলের নাম দেয় জিনজিয়াং। জিনজিয়াংয়ের বাইরে উইঘুরদের সবচেয়ে বড় সম্প্রদায় দক্ষিণ মধ্য হুনান প্রদেশে রয়েছে। চীনের বাইরে মধ্য এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্র যেমন কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উইঘুর বাস করে।