ধর্মের নামে ভণ্ডামি, গুরু সেজে গুরুপাপ // জেনে নিন ভারতের এমন কয়েকজন ধর্মগুরু সম্পর্কে

ভারত

ধর্মগুরুদের নিয়ে মাতামাতি ভারতবর্ষের প্রাচীন অভ্যাস ৷ সাধু বাবাদের কুসংস্কার আর কেলেঙ্কারি ধর্মের নামে চাপা পড়ে যাওয়ার ইতিহাস আর ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্ম ভাঙিয়ে দুর্নীতি, নৈরাজ্য আর ব্যবসার ইতিহাস একই ইতিহাস। তাও হুঁশ ফেরে না কারোরই ৷

এত সব কেলেঙ্কারির পরও ভাঁটা পড়েনি ধর্মগুরুদের জনপ্রিয়তায় ৷ শুধু সাধাণ মানুষ নন, সেলেব্রেটিরাও রয়েছেন তাদের ভক্তের তালিকায় ৷ বছর তিনেক আগে ১৪ জন ‘ভন্ড বাবার’ তালিকা প্রকাশ করেছিল অখিল ভারতীয় আখড়া পরিষদ। সেই ‘ভন্ড বাবা’-র তালিকায় ছিল আসারাম, রাধে মা, নারায়ণ সাঁই, নির্মল বাবার মতো ব্যক্তিদের নাম। নাম ছিল আলোচিত রাম রহিমেরও। এইসব ধর্মগুরু বাবা ও ধর্মগুরু মায়েদের সন্দেহজনক কাজকর্মের জনেই ধর্মের এত দুর্নাম। নাস্তিক-আস্তিক বিতর্ক তুলে সবসময় পর্দালে আড়ালে চলে যায় এসব দুবৃত্তরা— তা যেমন ভারতে এবং বাংলাদেশেও। তবু ভারতে মাঝে মাঝেই এরকম সাধু বাবাদের নাম পত্রপত্রিকায় আসে। বাংলাদেশে যেন এদের ছোঁয়াই বারণ! 

এখানে সেরকম কয়েকজন  তথাকথিত ধর্মগুরুদের কাণ্ড কারখানার হদিশ রইল—

ভারত

১. গুরমিত সিংহ রাম রহিম: শুধু নামেই ধর্মগুরু। তিনি পরতেন আধুনিক পোশাক, সিনেমাতেও অভিনয় করতেন তিনি৷ ঝলমলে পোশাক গায়ে মিউজিক ভিডিওতে তার বিকট নাচের দৃশ্যও বিরল নয়। হরিয়ানা-পাঞ্জাবে অন্তত পাঁচ লাখ ভক্ত ছিল গুরমিত রাম রহিমের। তাদের দাবি, সারা বিশ্বে গুরু রাম রহিমের ছয় কোটি ভক্ত আছে। তবে বিতর্কের জেরে আপাতত শ্রীঘরে তিনি৷

রাম রহীম
রাম রহিম ও হানিপ্রীতের এরকম অনেক ছবি আলোড়ন তুলেছিল দেশে বিদেশে। পরবর্তীতে দুজনকেই যেতে হয় কারাগারে।

বিচারের কাঠগড়ায় রেখে রাম রহিম সম্পর্কে  বিচারক বলেছিলেন, গুরমিত রাম রহিম সিং ক্ষমার যোগ্য নন, তিনি দুই সাধ্বীর পবিত্রতা নষ্ট করেছেন এবং বন্য পশুর মত আচরণ করেছেন। ২০১৭ সালের অগাস্ট মাসে রোহতক জেলে ধর্ষক বাবার ক্ষমা চাওয়ার প্রেক্ষিতে এমনই বললেন বিচারক জগদীপ সিং। দুই নির্যাতিতাই তাঁকে ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছিলেন এবং তিনি বিশ্বাসভঙ্গ করেছেন।
ডেরা সাচ্চা সওদা নামের একটি সম্প্রদায়ের নেতা এই রাম রহিমের হরিয়ানার সিরসায় ছিল প্রকাণ্ড হাই-টেক আশ্রম। রাম রহিমকে ২৫ অগাস্ট (২০১৭) হরিয়ানার একটি আদালত ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে৷

২. রাম রহিমের হরিয়ানাতেই আরেক স্বঘোষিত ধর্মগুরু রামপাল কে গ্রেফতারের ঘটনাও সাড়া ফেলেছিল দেশে বিদেশে৷ স্বঘোষিত এই ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২১ (সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্ররোচনা), ১২১(এ) (দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র), ১২২ (ভারত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে অস্ত্র সংগ্রহ) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। খুনের চেষ্টা, দাঙ্গা ও বেআইনিভাবে আটক রাখার অভিযোগও ছিল তার বিরুদ্ধে। যৌন নির্যাতনের অভিযোগে ২০১৪ সালে তার আস্তানা থেকে তাকে গ্রেফতার করতে গেলে ভক্তদের বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল পুলিশকে। মহিলাদের টয়লেট থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল সিসিটিভি।
ধর্মগুরু
অক্টোবর (২০২০) দু’টি পৃথক খুনের মামলায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করে হরিয়ানার হিসারের বিশেষ আদালত। এদিন তার শুনানি ঘিরে শহর জুড়ে কঠোর করা হয়েছিল নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তাকে জেল থেকে বের করে আদালতে আনার ঝুঁকি নেয়নি প্রশাসন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মামলার শুনানি নিষ্পত্তি করেন বিচারক। ২০০৬ সালে তার বিরুদ্ধে এক মহিলাকে খুনের অভিযোগ ওঠে। প্রায় ১২ একরের সত্‍লক আশ্রমের এক প্রান্তে ওই মহিলার দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়। সেবার আর্য সমাজ এবং রামপালের ভক্তদের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধেছিল। অভিযোগ, তার জেরেই খুন করা হয় ওই মহিলাকে। সেই খুনের ঘটনায় ২০১৪ সালের ১৪ নভেম্বরে পুলিশ রামপালকে গ্রেফতার করে। তাও বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে। ৯ নভেম্বর থেকে আশ্রমের বাইরে ঘাঁটি গেড়েছিল হয়িয়ানা পুলিশ। ভক্তদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে রণক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল এলাকা। এতে আরও পাঁচ মহিলা ও এক শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। আহত হয়েছিল সংবাদকর্মীসহ অনেকে। পরে প্রায় ২৫ হাজার পুলিশ নিয়ে আশ্রমের ভেতরে ঢুকে গ্রেফতার করা হয় রামপালকে। এদিন তাই আগেভাগেই হিসার শহর জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে মোতায়েন করা হয় প্রায় ২০০০ সশস্ত্র পুলিশ। চারবছর মামলা চলার পর শুনানি শেষ হয়। দোষী সাব্যস্ত হন রামপাল।
৩. ভারতের আরেক জনপ্রিয় ধর্মগুরু স্বামী নিত্যানন্দও জড়িয়েছিলেন যৌন কেলেঙ্কারিতে। পরমহংস নিত্যানন্দ নামের এই গুরুর বিশ্বব্যাপী ২০ লক্ষ ভক্ত রয়েছে বলে দাবি করা হয়ে থাকে। একটি চ্যানেলের স্টিং অপারেশনে এক অভিনেত্রীর সাথে আপত্তিকর দৃশ্যেও দেখা যায় তাকে । তার আশ্রমে অভিযান চালিয়ে মেলে মাদকদ্রব্য ও জন্মনিরোধক সামগ্রীও।
ভারত
রাধে মা। ভারতে আসারাম বাপু নিজেকে বলেন ‘গডম্যান’। আর ‘রাধে মা’নিজেকে দাবি করেন ‘গডউওম্যান’ হিসেবে। ‘রাধে মা’-এর মহিমা ছড়িয়ে দিতে মাঝামাঝেই ছোট-বড় সভার আয়োজন করেন ভক্তরা। সেখানে ‘মা’ নিজের মহিমা দেখান। তবে রাধে মা-এর মহিমা ঠিক বাকিদের মতো নয়। রাধে মা নাচেন বলিউডের আইটেম সং বা পার্টি ঢং-এ। এই স্বঘোষিত গডউওম্যান অফ টাইমে জিনস পরে শপিং মলে যান। শর্ট স্কার্ট পরে সোফায় শুয়ে খোলাখুলি ছবি তোলেন। ‘মুন্নি বদনাম’ কিংবা ‘শিলা কি জওয়ানি’-র তালে কোমর দোলান। মাঝে মাঝে এমনও শোনা যায় পুরুষ ভক্তদের একেবারে কোলে উঠে আদরও করে দেন ‘রাধে মা’।
ভারত
স্বামী নিত্যানন্দ।
৪. আরেক ‘জনপ্রিয়’ ধর্মগুরু রাধে মা৷ এই গুরু মাকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই৷ এক ভক্তের অনুরোধে তিনি নাকি পণের দাবিতে নির্যাতন চালিয়েছিলেন ভক্তের পরিবারের বধূর উপরে৷ এছাড়াও একাধিকবার হিন্দি গানের সঙ্গে অশ্লীল ভাবে নাচতে দেখা গেছে তাঁকে৷ অথচ এই সাধ্বী-অন্ত-প্রাণ পরিচালক সুভাষ ঘাই৷ স্ত্রী মুক্তাকে নিয়ে তিনি প্রায়ই যান রাধে মায়ের চরণে৷
৫. এছাড়াও রয়েছেন Oneness University-র প্রতিষ্ঠাতা কল্কি ভগবান৷ এই সাধকের আশ্রম চেন্নাইয়ে৷ তার ঘরানার প্রচারিত মত হল, মহাবিশ্বে সবাই সমান৷ কেউ কারও থেকে কম নয়৷ আবার বেশিও নয়৷ এই দর্শনে মুগ্ধ তারকা ঋত্বিক রোশন, শিল্পা শেঠি৷ অন্যদিকে কল্কি ভগবানের বিরুদ্ধেই আর্থিক নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে ভুরি ভুরি৷
৬. অমৃতসরের রাধাস্বামী সত্‍সঙ্গ বিয়াসও রয়েছে জনপ্রিয় অথচ ভন্ড সাধুদের তালিকায়৷ এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কথা ছাড়া এক পা’ও নাকি নড়ে না শাহিদ কাপুরের পরিবার৷ শাহিদ নাকি স্ত্রীকেও পেয়েছেন গুরুর খুঁজে দেওয়া সম্বন্ধে৷ ধর্মীয় এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তারা জমি দখল করেছে৷ এক গুরুদ্বারের জমি নাকি তারা হস্তগত করে নিয়েছে৷ 
৭. রবি শঙ্কর কে কে না চেনে৷ তার “আর্ট অফ লিভিং” বলতে একসময় অন্ধ ছিলেন শিল্পা শেঠী৷ শিল্পা ছাড়াও তার তারকা ভক্ত নেহাত্‍ কম নয়৷ দিয়া মির্জা, লারা দত্তা নিয়মিত এই ভন্ডের আশ্রমে যাতায়াত করতেন৷ অভিযোগ ছিল তার ধর্মীয় উৎসবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যমুনা নদীর এক হাজার একর পলিজমি৷ যা ঠিক হতে সময় লাগবে দশ বছর৷ অর্থের প্রয়োজন হবে ৪২ কোটি৷ আদালতে এই মামলায় ভৎর্সনার শিকার হন তিনি৷
৮. সত্য সাঁই বাবা :
তিনি নিজেকে দাবি করেন শিরডির সাধক সাঁই বাবার এক অবতার বলে৷ তার তারকা ভক্তের সংখ্যা অগণিত৷ তাদের মধ্যে অন্যতম অমিতাভ বচ্চনের পরিবার৷ জীবদ্দশায় তার বিরুদ্ধে আর্থিক জালিয়াতি, যৌন হেনস্থা, বুজরুকি-সহ একাধিক অভিযোগ উঠেছিল৷ যদিও কিছুই প্রমাণিত হয়নি৷ এবং আজও ভক্ত স্রোতে টান পড়েনি তার৷
৯. ওশো রজনীশ :
তার সান্নিধ্যে বিনোদ খান্না হয়ে গিয়েছিলেন সন্ন্যাসী বিনোদ ভারতী৷ খ্যাতির শীর্ষে থাকার সময়েই ছেড়ে দিয়েছিলেন অভিনয়৷ পরবর্তীকালে পারভিন বাবি ও মহেশ ভাটও তার ভক্ত হয়েছিলেন৷ ওশোর বিরুদ্ধে এত অভিযোগ উঠেছিল কেচ্ছার, যে তার নামই হয়ে গিয়েছিল সেক্স গুরু৷
ধর্মগুরু
২০১৩ সালে যোধপুরে ১৬ বছর বয়সী কিশোরীকে ধর্ষণের জন্য আসরাম বাপুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
১০. নিজের যৌন কেচ্ছা দিয়ে দেশে (ভারতে) সাড়া ফেলেছিলেন আশারাম বাপু৷  গ্রেফতার হয়েছিলেন নাবালিকা ধর্ষণের মামলায়। রয়েছে নারী শিষ্যদের সাথে অন্তরঙ্গ মুহুর্তের ভিডিও তৈরির অভিযোগও। পিতার মতো পুত্র নারায়ন সাইয়েরও একই রকম অভিযোগ রয়েছে। টেলিভিশন চ্যানেলে লাগাতার ধর্মীয় বাণী প্রচার আর ভজন গোটা ভারত জুড়ে আশারাম বাপুর কোটি কোটি ভক্ত তৈরি করেছিল, সেই সঙ্গে উত্তর ভারতের নানা রাজ্যে তিনি তৈরি করেছিলেন বিশাল সব আশ্রম ও বহু কোটি টাকার সম্পত্তি।